ঢাকার ঈদ, মোহাম্মদপুরের আম্মা ও একজন লঙ্কান কিংবদন্তি

আবাহনীর সেই পাকীর আলি। ছবি: সংগৃহীত
আবাহনীর সেই পাকীর আলি। ছবি: সংগৃহীত
>১৯৮১ সালে ফুটবলের কাবুলিওয়ালা ট্যাগ নিয়ে এসে বাংলাদেশের নাড়ি-নক্ষত্রের সঙ্গে বন্ধন পাকির আলীর। পরবর্তী সময়ে লাল– সবুজের সঙ্গে এই শ্রীলঙ্কানের ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর থেকে হয়েছে গভীরতর।

 রঙিন পাঞ্জাবি, ঢাকার ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের ‘আম্মা’। ঈদ এলেই এই তিনে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি এক ফুটবলার। স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে ফিরে যান তিন দশকেরও বেশি পেছনে। বেদনার মধ্যেও খুঁজে পান উচ্ছ্বাস—সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি !


মোহাম্মাদ নিজাম পাকির আলী বাংলাদেশের ফুটবলে পাকির আলী নামে পরিচিত। শ্রীলঙ্কান ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকা বলা হয় তাঁকে। আর বাংলাদেশে খেলে যাওয়া বিদেশিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া ফুটবলারদের মধ্যে অন্যতম মুখ। আশির দশকে যে ফুটবল উপহার দিয়েছেন, সে গল্প এখনো কোনো ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ফুটবলপ্রেমীর মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য হলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মও আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে এই ডিফেন্ডারের ফুটবলশৈলীতে। খেলা ছাড়ার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শেখ জামাল ধানমন্ডি লিমিটেডের কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন শ্রীলঙ্কান জাতীয় দলের সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া এই কোচ।


১৯৮১ সালে ফুটবলের কাবুলিওয়ালা ট্যাগ নিয়ে এসে বাংলাদেশের নাড়ি-নক্ষত্রের সঙ্গে বন্ধন, পরবর্তী সময়ে বাংলার সঙ্গে এই শ্রীলঙ্কানের ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর থেকে হয়েছে গভীরতর। আশির দশকে আবাহনী–মোহামেডান যখন হৃদয়ে দোলা দিত, সেই সময়ে ১৯৮১ থেকে ৯ বছর খেলেছেন ঢাকার ফুটবলে।

পালন করেছেন ঐতিহ্যবাহী আবাহনী লিমিটেডের অধিনায়কের দায়িত্বও। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি, যা এখনো মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে । ভাষাতেও এখনো পুরোদস্তুর বাঙালি। বছর ঘুরে আরও একটি ঈদ আসা মানেই আবারও স্মৃতির অতল সাগরে ডুব মেরেছেন এই শ্রীলঙ্কান। কলম্বো থেকে হোয়াটসঅ্যাপে শোনালেন ফেলে আসা সেই রঙিন দিনগুলোর গল্প। অবশ্যই সব কথোপকথনই বাংলাতে।

ঢাকায় দীর্ঘ সময় অবস্থান ও জনপ্রিয় ক্লাবগুলোতে খেলার সুবাদে সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে ক্লাব কর্তা ও স্থানীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পাকির আলীর। ঈদের সময় ঢাকায় অবস্থান করলে চারপাশ থেকে দাওয়াতের ছড়াছড়ি। তত দিনে পাঞ্জাবি–পায়জামার সঙ্গেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। ঢাকার রাস্তাঘাট তো হাতের তালুর মতোই চেনা। জমিয়ে ঈদ পালন করার জন্য আর কী চাই !

৩০ বছরেরও বেশি সময় পর গতকাল সেই দিনগুলোতে ফিরে গেলেন পাকির আলী, ‘ঈদের দিন পাঞ্জাবিটা পরার পর অন্য রকম লাগত। আমার এখনো মনে আছে আড়ংয়ের পাঞ্জাবি পরতাম। দাম বেশি হলেও গায়ে দিলে খুব ভালো লাগত। ধানমন্ডিতে রিকশায় চড়ে গিয়ে অনেক সাপোর্টারের বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছি। ক্লাব কর্তাদের বাসায় গিয়েও একটু একটু খেতেই হতো। ঈদটা হয়ে উঠত আমারও। সেই দিনগুলো খুব মিস করি।’


ঢাকার ঈদ ও পাঞ্জাবির পর আসা যাক পাকির আলীর মোহাম্মদপুরের মায়ের পর্বে। একজন সমর্থকের সঙ্গে একজন খেলোয়াড়ের সম্পর্ক কেমন হতে পারে ? স্থান কাল পাত্র ভেদে সে যেমনই হোক না কেন, এক সমর্থকের মাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতেন এই শ্রীলঙ্কান। ঈদে সেই সাদেক নামের সমর্থকের বাসায় গিয়ে তাঁর আম্মার হাতের রান্না না খেলে চলতই না এই শ্রীলঙ্কানের, ‘সাদেক ভাই নামে আবাহনীর এক সমর্থক ছিলেন। আমি তাঁর মাকে আম্মা বলে ডাকতাম। ঢাকায় ঈদের সময় থাকলে আম্মার হাতের সেমাই খাব না, এটা ভাবাই যেত না। আম্মা আমার জন্য অনেক ভালো ভালো খাবার রান্না করতেন ।’ বাংলাদেশ ছাড়ার পর আর সেই আম্মার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি বলে এখনো কষ্ট পান বলে জানান শ্রীলঙ্কান এই ডিফেন্ডার। 


বুট জোড়া তুলে রাখার পর শ্রীলঙ্কার জাতীয় দলের কোচ হিসেবে বাংলাদেশে এসেছেন বেশ কয়েকবার। এ ছাড়া একবার তো শেখ জামাল ধানমন্ডির কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সুতোটা আলগা হয়নি কখনো। তাই বুঝি এখনো তাঁর শ্রীলঙ্কার বাড়িতে বসে ঈদের আমেজটা অনুভব করেন ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। বিশেষ দিনটিতে বাসায় বউয়ের হাতে রান্না হয় বিরানি। তবে করোনাকালীন ঈদটি বিশেষভাবে পালন করা যায়নি বলে হতাশ, ‘আমাদের এখানে গতকাল (রোববার) ঈদ হয়েছে। করোনার জন্য এবারের ঈদটা অন্য রকম গেল। এমনি সময় ঈদের দিন আমার বউ বিরানি রান্না করলেও এবার কিছুই হয়নি। আসলে করোনার জন্য দেশের অবস্থা ভালো না তো।’


করোনা থমকে দিয়েছে জনজীবন। ঈদে উৎসবে মাতার সুযোগ নেই। তবু প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরত্বে বসে ঢাকার ঈদের স্মৃতি মনে করে আনন্দ খুঁজে পান এই শ্রীলঙ্কান।