'অভিশপ্ত' এক রাজপুত্র

সিগারেট ঠোঁটে লেগেই থাকত হেলেনো ডি ফ্রেইতাসের। ছিলেন চেইন স্মোকার। ছবি: টুইটার
সিগারেট ঠোঁটে লেগেই থাকত হেলেনো ডি ফ্রেইতাসের। ছিলেন চেইন স্মোকার। ছবি: টুইটার

এদুয়ার্দো গ্যালেনো লাতিন আমেরিকার প্রবাদপ্রতীম লেখক। ফুটবলে রোমান্টিক ঘরানার ভক্ত। সেভাবেই লিখে গেছেন 'সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো' বইয়ে, '১৯৪৭ সাল। রিও ডি জেনিরোয় ফ্লামেঙ্গোর মুখোমুখি বোটাফোগো। বুক দিয়ে গোল করলেন বোটাফোগো স্ট্রাইকার হেলেনো ডি ফ্রেইতাস।'

'জালের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে হেলেনো। বলটা বাতাসে ভেসে আসতেই বুক দিয়ে লুফে ঘুরে দাঁড়ালেন। বল তখনো তাঁর বুকেই, ধনুকের মতো বেঁকে তাকাল সামনে। তিল ঠাঁই নাই ! ব্রাজিলের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি লোক যেন ফ্লামেঙ্গোর বিপদসীমায়! বলটা নিচে নামালেই সর্বনাশ। হেলেনো ঠান্ডা মাথায় দুই পায়ে ভর করে ঢুকে পড়লেন শত্রুব্যূহে। শরীরটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে, বুকের ওপর বল। ফাউল না করে কেউ ওটা নিতে পারবে না, আর সে গোল করার মতো জায়গায়। একটু এগিয়ে গোলপোস্টের সামনে বলটা পায়ে নামিয়ে গোল করল।'

'হেলেনো ডি ফ্রেইতাস এক নির্ভেজাল যাযাবর। সে দেখতে রুডলফ ভ্যালেন্তিনার (বিশের দশকে ইতালিয়ান অভিনেতা, সেক্স সিম্বল) মতো, কিন্তু রাগটা পাগলা কুকুরের। খেলার মাঠে দ্যূতি ছড়ায়। জুয়ায় সর্বস্ব খোঁয়ায় এক রাতে। আরেকদিন রাতে, কে জানে কোথায়, কীভাবে, সে বাঁচার ইচ্ছাটাই হারিয়ে ফেলল। সেবাসদনে জীবনের শেষ রাতে ছিল উন্মত্ত, বিকারগ্রস্ত।'

সৈকতে এক ফাঁকে হেলেনো। কোপাকাবানার সৈকতে তাঁর প্রতিভা চিনেছিলেন বোটাফোগো স্কাউট। ছবি: টুইটার
সৈকতে এক ফাঁকে হেলেনো। কোপাকাবানার সৈকতে তাঁর প্রতিভা চিনেছিলেন বোটাফোগো স্কাউট। ছবি: টুইটার

সোনার চামচ মুখে ফুটবলের সদর দরজা দিয়ে এসেছিলেন হেলেনো। ভেতরকার আগুনে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রস্থানটা তাই ফুটবলের পেছন দরজা দিয়ে, পাগল হয়ে। কিন্তু লোকে তো পাগল নয়! ব্রাজিলে হেলেনো চল্লিশ দশকের পেলে। রিও-তে 'অভিশপ্ত রাজপুত্তুর', আরেকটু গভীরে বোটাফোগো সমর্থকদের কাছে গারিঞ্চার পথের পূর্বপুরুষ; অপরিণামদর্শী জীবনের বলি অমিত প্রতিভা। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রথম অসাধারণ খারাপ ছেলে।

পেলে-গারিঞ্চাদের ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপ জয় ছিল ব্রাজিলের জন্য আট বছর আগের শাপমোচন। সেদিন মিনাস গেরেইসের বারবাকেনায় এক আশ্রম মতো বাড়িতে--রোগিদের চিকিৎসাও হতো সেখানে, রেডিওতে কান পেতে ছিল সবাই। শেষ বাঁশি বাজতেই রোগি থেকে চিকিৎসকদের আনন্দ হিস্টিরিয়ায় রুপ নিল। শুধু একজন, একা বসে ছিলেন নিজের কামরায়। হেলেনো। মুখের মধ্যে যতগুলো সম্ভব জলন্ত সিগারেট ঢুকিয়ে ফুঁকতে ফুঁকতে নিজেকে শেষ করার ফিকিরে মত্ত।

হেলেনো ছিলেন চল্লিশ দশকের পেলে। ছবি: টুইটার
হেলেনো ছিলেন চল্লিশ দশকের পেলে। ছবি: টুইটার

এক দশক আগেও হেলেনো ছিলেন ব্রাজিলের সেরা ফরোয়ার্ড। পেলে ১৭ বছর বয়সে যে চূড়ায় উঠেছিলেন, ১৯৫০ বিশ্বকাপে তা করার কথা ছিল হেলেনোর। প্রতিভাও ছিল। '৫৮-তে পেলের সফলতা তাই হেলেনোর সহ্য হয়নি। আত্মহত্যা থেকে সে যাত্রায় তাঁকে রক্ষা করা গেলেও পাগলামি কমেনি। হেলেনোর কামরার দেয়ালে তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের নানা সাফল্যের ছবি, সংবাদপত্রের কাটিং ঝুলিয়ে রেখেছিলেন সেবিকা। কোনো কোনো দিন এসে দেখতেন রোগি সেগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন কিংবা চিবোচ্ছেন।

অথচ একদিন এই হেলেনোর সময়টাই অন্যরকম ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা কালো চুল গোমালিনা জেলে সিঁথি করতেন বামে থেকে ডানে। পরনে দামি ক্যাশমেরে স্যুট (ভারত, মঙ্গোলিয়া, চীনের বিশেষ ছাগলের পশম থেকে বানানো), বানিয়ে দিয়েছেন ব্রাজিলের তখনকার প্রেসিডেন্ট গেতুলিয়ো ভার্হাসের দর্জি ডি সিক্কো। কবজিতে কার্টিয়ার, তর্জনিতে ক্যাডিলাকের চাবি, আর শরীরে ফরাসি সুরভি। তাঁকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সংযমের পরীক্ষাই দিতে হতো মেয়েদের। সেই সময় হেলেনোর আবেদন ব্রাজিলিয়ান লেখক মার্কাস এদুয়ার্দো নাভাস বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর বইয়ের নামে 'নানকা হাউভে উম হোমেম কমো হেলেনো'। বাংলায়, 'হেলেনোর মতো আর কেউ ছিল না।'

রিও ডি জেনিরোয় নারীদের কাছে ভীষণ আবেদনময়ী ছিলেন হেলেনো। মোটরবাইক ছিল তাঁর পছন্দের। ছবি: টুইটার
রিও ডি জেনিরোয় নারীদের কাছে ভীষণ আবেদনময়ী ছিলেন হেলেনো। মোটরবাইক ছিল তাঁর পছন্দের। ছবি: টুইটার

এরপরও কেউ থেকে থাকলে তিনি 'ভালোবাসার দেবি' রিটা হেওয়ার্থ। হলিউডে চল্লিশ দশকের আবেদনময়ী কিংবদন্তি অভিনেত্রী। ভীষণ সফল 'গিল্ডা' (১৯৪৬) সিনেমায় মেজাজি আবেদনময়ী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হেওয়ার্থ। হেলেনোকে গিল্ডার পুরুষ রূপ ধরে নিয়েছিল ব্রাজিলিয়ানরা। সেখান থেকে তাঁর নাম হয়ে গেল গিল্ডা। মাঠে দুর্দান্ত কোনো শরীরী মুভ কিংবা মেজাজ হারালে প্রতিপক্ষ গ্যালারি থেকে সমস্বরে ভেসে আসত নামটা, 'গিল্ডা'! এ সিনেমার ট্যাগলাইন ছিল 'দেয়ার নেভার ওয়াজ অ্যা ওম্যান লাইক গিল্ডা।' নাভাসের বইয়ের নামের উৎস।

ঠিকঠাক মতো প্রসব হলে দেবী সেন্ট হেলেনার নামে সন্তানের নাম রাখবেন, এই ছিল বাবা-মায়ের মানত। কফি ব্যবসায়ী বাবা ১৯৩৩ সালে (গারিঞ্চার জন্মের বছর) মারা যাওয়ার পর জন্মভূমি সান হোয়াওয়ের নেপোমুচেনো থেকে রিওতে চলে যায় তাঁর পরিবার। স্কুলে ফুটবলে হাতেখড়ি নেওয়া হেলেনোকে কোপাকাবানায় কমলা নিয়ে কসরত করতে দেখে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল বোটাফোগো স্কাউট নেনেম বোয়ার্ডের। ছুঁড়ে মারা কমলা উরুতে নিয়ে সেখান থেকে দু-পায়ে খেলিয়ে আলগোছে মাথার ওপর। বোটাফোগো পেয়ে গেল ১৭ বছর বয়সী হিরে, তাদের প্রথম কিংবদন্তিকে।

বোটোফোগোর জার্সিতে অনুশীলনে। ছবি: টুইটার
বোটোফোগোর জার্সিতে অনুশীলনে। ছবি: টুইটার

জীবনে দুটো সাধ ছিল হেলেনোর। নাহ, নারী ও মদ নয়। সে তো না চাইতেও মিলছে! কোপাকাবানা প্যালেসে সন্ধ্যা নামলে তাঁকে দেখা যেত সমাজের উচুঁস্তরের নারীদের ঘেরাটোপে আয়েশ করছেন। এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে পেয়ালা। ওদিকে মনের মধ্যে তিয়াস। বোটাফোগোকে লিগ জেতানো হয়নি। নির্মাণাধীন মারাকানায় ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানো বাকি।

সেন্ট বেনেডিক্ট কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি ছিল হেলেনোর। সে সময় ব্রাজিলে উচ্চ-বিত্তদের মধ্যেও খুব বেশি লোকের তা ছিল না। পেশাদার ফুটবলও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। হেলেনো বোটাফোগোকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন বলেই লাভজনক আইনি প্যাঁচ ফেলে মত্ত ছিলেন ভালোবাসায় (ফুটবলের প্যাঁচ)। নিজেই বলতেন, 'আমি ফুটবলার নই, বোটাফোগোর খেলোয়াড়।'

ব্রাজিলের কোপা আমেরিকা দলে সে সময়ের পাঁচ স্ট্রাইকার: আদেমির, জাইর, হেলেনো, জিজিনহো ও সউরিনহা। ছবি: টুইটার
ব্রাজিলের কোপা আমেরিকা দলে সে সময়ের পাঁচ স্ট্রাইকার: আদেমির, জাইর, হেলেনো, জিজিনহো ও সউরিনহা। ছবি: টুইটার

১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭, এ চার মৌসুম দুইয়ে থাকতে হয়েছে বোটাফোগোকে। শেষ মৌসুমে না পারায় হেলেনোর পেনাল্টি মিসের দায় ছিল। ড্রেসিং রুমে ফিরে রক্তাক্ত করেছিলেন নিজেকে। সেবার কোনো পারিশ্রমিক নেননি। নথিপত্র তা মনে রাখলেও লোকে রাখেনি। 'লোন স্টার'দের লিগ জেতাতে না পারা, প্রতিভার অপচয় আর রগচটা মেজাজটাই টিকে গেল মানুষের স্মৃতিতে।

হেলেনো চাইতেন দলের সবাই তাঁর মতো খেলুক। দক্ষতায় তাঁর সমান হোক। তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হোক আক্রমণ। সতীর্থরা বাজে পাস দিলে মাঠেই তেড়ে যেতেন। হজম করতে হতো কর্মকর্তাদেরও। ১৯৪৫ কোপা আমেরিকায় যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও হেরে গিয়েছিলেন নরবার্তো মেন্দেজদের আর্জেন্টিনার কাছে।

ব্রাজিলকে কিছু জেতাতে মরিয়া হেলেনো দেশে ফেরার পর নতুন মৌসুম সামনে রেখে তাঁকে ডাকা হয় বোটাফোগোর অনুশীলনে। দলের একতাবোধ ও সংহতি নিয়ে কথা বলতে হবে। মোটরবাইক চেপে সোজা মাঠে ঢুকে পড়েন হেলেনো। এরপর দলীয় সংহতি নিয়ে বক্তৃতা শেষ করতে পারেননি। হাতাহাতি লেগে যায়। দলে বাকিদের দক্ষতা ও নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন হেলেনো।

ছবিটি ১৯৫৫ সালের। মানসিক সদনে থাকতে বল পায়ে হেলেনো। চেহারা ও শরীরে পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। ছবি: সংগৃহীত
ছবিটি ১৯৫৫ সালের। মানসিক সদনে থাকতে বল পায়ে হেলেনো। চেহারা ও শরীরে পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। ছবি: সংগৃহীত

সতীর্থদের চেয়ে তাঁকে বেশি ভালোবেসেছে আসলে নারী ও ভক্তরা। মজা লুটেছে প্রতিপক্ষ সমর্থকেরাও। ফ্লুমিন্সের বিপক্ষে এক ম্যাচে ১-১ গোলে সমতায় বোটাফোগো। 'ফ্লু' গ্যালারি থেকে দুয়ো আসতেই হেলেনো তাঁদের দিকে ঘুরে শর্টস খুলে অন্ডকোষ দেখিয়েছিলেন (অথচ মাঠের বাইরে তাঁর মতো রুচিবান, সুপুরুষ, সংস্কৃতিমনা ব্রাজিলে দ্বিতীয়টি ছিল না)। এরপর দুটো আঙুল তাক করলেন স্কোরবোর্ডে। কিছুক্ষণ পরই তেইজেইরিনহোকে দিয়ে গোল করান হেলেনো, ব্যবধান ২-১।

কোপায় টানা দুবার ব্যর্থ হওয়ার পর বোটাফোগো সভাপতিও তাদের 'প্রবলেম চাইল্ড'কে বেচে দিতে মরিয়া। হেলেনোকে প্রাণের ক্লাব ছেড়ে (১৯৪৮) পাড়ি জমাতে হয় আর্জেন্টিনায়। বোকা জুনিয়র্সের জন্য দারুণ সিদ্ধান্ত (লিগ চ্যাম্পিয়ন) হলেও হেলেনোর জন্য সেটা ছিল 'প্রেয়সী'র বিশ্বাসঘাতকতার মাশুল। কিন্তু ভ্যালেন্তিনোরা কখনো একা থাকে না। আর্জেন্টিনার শীতে সমস্যা হতো হেলেনোর। অনুশীলন করতেন ওভারকোট পরে। আর একটু উঞ্চতার জন্য ছুটে যেতেন এভা পেরনের কাছে।

আর্জেন্টিনার ফার্স্ট লেডি, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনের স্ত্রী। আর্জেন্টাইন 'জাতির আধ্যাত্মিক নেতা' ছিলেন পেরন। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে হেলেনোর প্রেমের গুজব এখনো লাতিন ফুটবলপ্রেমীদের মুখরোচক গল্পের খোরাক। 'এভিটা' সিনেমায় এভাকে পর্দায় জীবন্ত করেছেন ম্যাডোনা।

নারীসঙ্গ প্রীতি থাকলেও বিয়ে জীবনে একবারই করেছিলেন হেলেনো। ছবি: টুইটার
নারীসঙ্গ প্রীতি থাকলেও বিয়ে জীবনে একবারই করেছিলেন হেলেনো। ছবি: টুইটার

হেলেনো ততদিনে বুঝে গেছেন, শেষ সুযোগ ১৯৫০ বিশ্বকাপ বিশ্বকাপ। বয়স ত্রিশ দেখছে। নাভাসের ভাষায়, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪২ ও ১৯৪৬ বিশ্বকাপ হয়নি। শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিচারে ১৯৫০ বিশ্বকাপ ছিল তাঁর শেষ সুযোগ।' হেলেনো সেই সুযোগও হারালেন অবিশ্বাস্যভাবে।

আর্জেন্টিনা থেকে প্রথম প্রেমের (বোটাফোগো) কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্লাব সভাপতি রোসা অজুহাত দেখালেন, অত টাকা দিয়ে বোকা থেকে তাকে কেনার সামর্থ্য নেই। হেলেনো মুফতে (ফ্রি) খেলে দিতে চাইলেন। তবু বরফ গলল না।

হেলেনো অগত্যা যোগ দিলেন ফ্লুমিন্সে, ফ্লামেঙ্গোর থেকে বোটা'র তুলনামূলক 'ভদ্র' প্রতিদ্বন্দ্বী ভাস্কো দ্য গামায়। যেন বোঝাতে চাইলেন, প্রথম প্রেম একটু সুবিধা পেয়েই থাকে। কিন্তু নারী, মদ আর ইথার স্প্রের নেশায় ততদিনে ভুলে গিয়েছিলেন আসল কাজটাই।

১৯৪৯ সালে ভাস্কোয় যোগদানের বছর লিগ জেতে 'পাহাড়ি দৈত্য'রা। হেলেনোকে খুব বেশি ম্যাচ খেলাননি ভাস্কো কোচ ফ্লাভিও কস্তা। অনুশীলনে মনোযোগ ধরে রাখতে পারতেন না, মেজাজ তো নয়ই। হেলেনো একদিন ভাস্কোর মাঠে গিয়ে পিস্তল ঠেকালেন কস্তার মাথায়। ট্রিগারে টান মারার শব্দটা শুনেছিলেন ভাস্কো কোচ। ভাগ্যিস, বুলেট ছিল না! হেলেনো টেরও পেলেন না, সেই পিস্তলের অদৃশ্য এক গুলিতেই এফোঁড়-ওফোঁড় হলো তাঁর বিধিলিপি।

প্রথম যতিটা পড়ল ব্রাজিল জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে (১৮ ম্যাচে ১৯ গোল)। সম্ভবত ঘরোয়া ফুটবলেও। এমনকি ঘরেও!

হেলেনোর নারীসঙ্গ প্রীতি সইতে না পেরেই সম্ভবত চরম প্রতিশোধটা নিয়েছিলেন ইলমা, তাঁর স্ত্রী। ছেড়ে গেলেন স্বামীকে। কিছু সূত্রমতে, হেলেনোরই সবচেয়ে কাছের বন্ধু-সতীর্থকে বিয়ে করেছিলেন ইলমা। আবার ইএসপিএন ব্রাজিলের প্রতিবেদনে দাবি, ইলমা বিয়ে করেছিলেন মিনাস গেরাসে খুব প্রভাবশালী এক রাজনীতিবিদকে ।

এরপর যেন হেলেনোর 'নেশা' কেটে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল বাস্তব দুনিয়া। হেলেনো ব্রাজিল ছাড়লেন।

এবার কলম্বিয়ায়। নতুন পেশাদার লিগের দল অ্যাথলেটিকো জুনিয়র। বারানকুইলার সংবাদমাধ্যম 'এল হেরাল্ড'-এর তরুণ সংবাদকর্মী ছিলেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। কেবল ত্রিশে পৌঁছালেও নেশা আর নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ধার হারিয়ে ফেলা হেলেনোর খেলায় মুগ্ধ ছিলেন মার্কেজ। 'ডক্টর ফ্রেইতাস' বলে ডাকতেন তাঁকে। লিখলেন, 'ফুটবলার হিসেবে হেলেনো ডি ফ্রেইতাস কখনো শীতল, কখনো গরম মাথার। সে সেন্টার ফরোয়ার্ডের চেয়েও বেশি কিছু। মানুষের বাজে কথা বলার স্থায়ী জায়গা।'

হেলেনো কলম্বিয়ায় যাওয়ার আগেই স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়েছিল। ১৯৫০ বিশ্বকাপ সামনে রেখে কস্তাকে জাতীয় দলের কোচ বানিয়েছিল ব্রাজিল। 'সুগারকম্ব' পাহাড় ভেঙে পড়তে পারে, রিও নদীর জল শুকিয়ে যেতে পাওে, কিন্তু কস্তা থাকতে হেলেনোর জাতীয় দলে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। গ্লোবো স্পোর্তের সংবাদকর্মী নেই মেদিনা এ বছর হেলেনোর জন্মের শতবর্ষপূর্তিতে (১২ ফেব্রæয়ারি) একটি তথ্যচিত্র বানালেন। সেখানে বিশ্বকাপ নিয়ে হেলেনোর দীর্ঘশ্বাসের গল্প শুনিয়েছেন হোয়াও ফারলান। বিশ্বকাপের পরদিন দুজনে বসেছিলেন নেপোমুচেনোর দিয়া ই নইতে পানশালায়, 'বিশ্বকাপের পরদিন সে টেবিলে আমাদের সঙ্গে বসেছিল। বলল “আমি খেললে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হতো। ওবদুলিও ভ্যারেলাকে (উরুগুয়ে অধিনায়ক ও সেন্টারব্যাক) খুন করে ফেলতাম! হয়তো মাঠ ছাড়তে হতো। কিন্তু আদেমির তখন একাই ম্যাচটা জিতিয়ে দিত। ভ্যারেলাকে আদেমির ভয় পেতে পারে, আমি নই।'

মিনাস গেরাইসের নেপোমুচেনোয় হেলেনো ডি ফ্রেইতাসের মূর্তি। ছবি: ফেসবুক
মিনাস গেরাইসের নেপোমুচেনোয় হেলেনো ডি ফ্রেইতাসের মূর্তি। ছবি: ফেসবুক

সাধের মারাকানায় খেলার সুযোগ হয়েছিল হেলেনোর। এর মধ্যে শরীরে বাসা বাঁধে সিফিলিস। কমছিল শরীরের ওজন। ইথার স্প্রে রুমালে মেরে সেটি ঘন ঘন শোঁকার কুফল। মদ আর মেয়ে মানুষ তো ছিলই।

জোনাথন উইলসন সম্পাদিত ব্রিটিশ সাময়িকী 'দ্য ব্লিজার্ড'-এর সপ্তম সংখ্যায় লেখা হয়েছে হেলেনোর কলম্বিয়া অভিযান নিয়ে। বারানকুইলায় মাছের রেঁস্তোরার মালিক গুস্তাভো হার্নান্দেজ দেখেছেন হেলেনোর খেলা, 'আমার কাছে সে কলম্বিয়ার মাটিতে খেলা সর্বকালের সেরা ফুটবলার। ছোট থাকতে জুনিয়রে দেখেছি। তাকে দেখে ফুটবল ভালোবেসেছি। (বল পায়ে) এমনকিছু নেই যে করতে পারত না। কিন্তু মনের সমস্যায় পুড়ে পুড়ে মরল। সে বিশাল এক জুয়াড়ি, এভা পেরনের সাবেক প্রেমিকা আর লোকে বলে, বারানকুইলায় এমন কোনো পতিতা নেই, যার কাছে সে যায়নি।'

সিফিলিসও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেরি করেনি। চিকিৎসকদেরা তাগাদা দিচ্ছিলেন। হেলেনো কলম্বিয়া থেকে ফিরে সান্তোস ঘুরে সই করলেন আমেরিকায়। এই আমেরিকার হয়ে প্রথম ও শেষ ম্যাচে যেতে পেরেছিলেন সাধের মারাকানায় (৪ নভেম্বর, ১৯৫১)। সংবাদপত্রের দাবি, হেলেনো ততদিনে অসুস্থ, উন্মত্ত। হোসে ফনসেকার পরিচালনায় ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'হেলেনো' সিনেমায়ও তাই দেখানো হয়েছে। ঘোলা চোখে মারাকানার সবুজ গালিচায় হেলেনো। ঠিক খেলার মধ্যে নেই। তাঁর দুই ভাতিজি হেরেলিন ও হেলেনিজ ডি ফ্রেইতাসের অবশ্য দাবি, শেষ বয়সে চাচা মোটেও তেমন ছিলেন না।

কিন্তু মারাকানায় হেলেনোর সেই প্রথম ও শেষ ম্যাচের নথিতে আছে, ২৫ মিনিটে নিজ দলের সতীর্থদের অপমান করায় লাল কার্ড দেখিয়ে তাঁকে মাঠ থেকে বের করে হয়ে দেওয়া হয়। ওটাই শেষবার, বুট পরে হেলেনোর মাঠে নামা।

ডি ফ্রেইতাস বংশের শুরুটা ছিল হেলেনোকে দিয়ে। ৭৭ বছর বয়সী হেরেলিন সাঁতারে ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে পনের শ-র বেশি পদক জিতেছেন বিশ্বের আনাচে-কানাচের সাগরে আর পুলে। হেলেনোর জ্ঞাতি ভাই বেবেতো ডি ফ্রেইতাস ভলিবল কোচ, বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন ইতালিকে। অলিম্পিকে ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন রৌপ্য। ছিলেন অ্যাথলেটিক মিনেইরো ও বোটাফোগোর ফুটবল কোচও!

আর আছেন ৭১ বছর বয়সী লুইজ এদুয়ার্দো ডি ফ্রেইতাস। মায়ের কাছে এদুয়ার্দো পরে শুনেছেন, বুয়েনস এইরসের হোটেলে অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় তাঁকে একা থাকতে হতো। সেখানে এভা পেরনকে জড়িয়ে নানা বাজে কথা শোনার পর স্বামীর ওপর থেকে তাঁর মন উঠে যায়। এক পর্যায়ে কোলের শিশুকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছাড়লেন। এরপর জীবনে এলেন সেই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, যাঁর সঙ্গে ১৪ বছর ঘর টিকেছে এদুয়ার্দোর মায়ের। সেই রাজনীতিবিদেও বাড়িতে এদুয়ার্দোর বাবাকে নিয়ে কোনো কথা বলা ছিল সম্পুর্ণ নিষেধ।

কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল যে অন্যরকম! শৈশবের শুরুতে 'বাটন ফুটবল' খুব ভালোবাসতেন এদুয়ার্দো। সেখানে তাঁর মূল খেলোয়াড় ছিলেন হেলেনো ডি ফ্রেইতাস। তাঁকে দিয়ে গোল করিয়ে বিমল আনন্দ পাওয়া এদুয়ার্দো তখনও বাবার সমন্ধে প্রায় কিছুই জানতেন না।

ভাগ্য তাঁকে বেশিদিন অপেক্ষায় রাখেনি। দশ বছর বয়সেই ধরা দেয় সত্য। ১৯৫৯ সালের ৮ নভেম্বর। খবরে জানাজানি হলো, বারবাকেনার এক মানসিক সদনে প্রায় (১৯-১২-১৯৫৪) পাঁচ বছর ধুঁকে ধুঁকে অবশেষে 'মুক্তি' মিলেছে হেলেনো ডি ফ্রেইতাসের। মৃত্যুর কারণ তৃতীয় মাত্রার সিফিলিস ও পক্ষাঘাত।

দশ বছর বয়সী এদুয়ার্দোর বোঝার কথা নয়, ফুটবল থেকে প্রায় কিছুই না পেয়ে একটি দাঁত আর ৩০ কেজি ওজন নিয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুর কী জ্বালা!