বিমান দুর্ঘটনায় মরতে বসেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক

ভাগ্য সহায় হওয়ায় সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন ইমতিয়াজ সুলতান জনি। ছবি: সংগৃহীত
ভাগ্য সহায় হওয়ায় সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন ইমতিয়াজ সুলতান জনি। ছবি: সংগৃহীত

মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলো সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করলেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেগুলো। দুঃসহ দুঃখবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে মন–প্রাণ। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক তারকা ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনির জীবনে এমন একটা ঘটনা আছে, যেটি তাঁকে তাড়া করে বেড়ায় নিরন্তর। অনেক সময় নিজেকেই নিজে ছুঁয়ে আশ্চর্য হন—তিনি ভাগ্যবান, এখনো বেঁচে আছেন এবং ভালোই আছেন!

নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে একবার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় পড়তে পারতেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, কেবল তিনিই নন, তাঁর সঙ্গে দেশের ফুটবল ইতিহাসের বড় এক ট্র্যাজেডির চরিত্র হতে পারতেন আশির দশকে আবাহনীর হয়ে খেলে যাওয়া আলোচিত শ্রীলঙ্কান ফুটবলার পাকির আলী ও অশোকা রবীন্দ্র। 

১৯৮৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচলের ইতিহাসে বড় এক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছিল। আকাশপথে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এযাবৎকালের একমাত্র প্রাণহানির ঘটনাও সেটি।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরত একটি ফকার এফ–২৭ উড়োহাজাজ ঢাকা বিমানবন্দরের অদূরেই জলাভূমিতে বিধ্বস্ত হয়েছিল। সে দুর্ঘটনায় জাহাজটির পাইলট, কেবিন ক্রুসহ সব (৪৫ জন) আরোহী সেদিন নিহত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের মার্চে বেসরকারি ইউএস বাংলা বিমান কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটিই একমাত্র যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা। ইমতিয়াজ সুলতান জনি, পাকির আলী ও অশোকা রবীন্দ্র সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারতেন। ভাগ্য সহায় হওয়ায় তাঁরা সেদিন বেঁচে যান।

আজ ৩৬ বছর পর দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা এই তারকা সেদিনের সেই ঘটনাটি মনে করে শিউরেই উঠলেন, ‘ওই দিন আসলে আমার ভাগ্য সহায় ছিল। যেদিন দুর্ঘটনাটি ঘটে, ওই দিন সকালের ফ্লাইটে আমার চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা ছিল। দুপুরে একটা ম্যাচ খেলে সেদিন শেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। তখন আমি আবাহনীতে খেলতাম। আবাহনীতে আমার দুই শ্রীলঙ্কান সতীর্থ পাকির আলী ও অশোকা রবীন্দ্র আগেই চট্টগ্রামে চলে গিয়েছিল। আমার যেদিন যাওয়ার কথা সেদিন ঢাকায় প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা হই। কিন্তু বনানীর কাছে এসে দেখি পানিতে চারদিক থইথই। ওই রাস্তা দিয়ে বেবিট্যাক্সি যেতে পারবে না, তাই বাড্ডা হয়ে অনেক ঘুরে বিমানবন্দরে যখন পৌঁছি, তখন ফ্লাইটের সময় পেরিয়ে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে আসি।’

সেদিন সন্ধ্যাতেই বিমান দুর্ঘটনার খবরে কেঁপে ওঠে গোটা দেশ। সে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী বৈমানিক কানিজ ফাতেমা রোকসানা। টেলিভিশনে সে দুর্ঘটনার খবর দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন জনি। সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ করা শুরু করেন পাকির আলী ও অশোকার। কারণ, সে উড়োজাহাজটিতেই যে তাঁদের ফেরার কথা। জনির টিকিটও ছিল ওই ফ্লাইটটিতেও। পরে চট্টগ্রামে ফোন করে জানতে পারেন পাকির আলী ও অশোকাও দেরিতে পতেঙ্গা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কারণে সেই ফ্লাইটটি মিস করেছিলেন, ‘আমি চট্টগ্রামে ফোন করে যখন জানি পাকির আলী ও অশোকা ফ্লাইটটি মিস করেছে, তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। দীর্ঘদিন সেই দুর্ঘটনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এখনো কোনো আকাশ দুর্ঘটনার সংবাদ টিভিতে দেখলেই ভয় লাগে। গত ৩৬ বছরে খেলা ও অন্যান্য কারণে অনেকবারই আকাশযাত্রা করেছি। প্রতিবারই আমার ওই দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে। আল্লাহর রহমতে এখনো বেঁচে আছি। এটাই অনেক।’

জনি এরপর অধিনায়ক হিসেবে আবাহনীকে লিগ শিরোপা জিতিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে। আবাহনী ছেড়ে মোহামেডানে এসে খেলেছেন ১৯৯৩ পর্যন্ত। জীবন তাঁকে অনেক কিছুই দিয়েছে। কিন্তু সেদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুর্ঘটনায় নিহত ৪৫ যাত্রীর কথা মনে হলেই অসহায় বোধ করেন দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই লেফটব্যাক। কেবলই মনে তাঁর মনে হয় —জীবনটা আসলেই পদ্মপাতায় জল!