আজকের 'আগুনে আংটি' ৫০ বছর আগের পেলে-টোস্টাওদের জন্য

১৯৭০ জুলেরিমে বিশ্বকাপ হাতে ব্রাজিল দলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো। ছবি: টুইটার
১৯৭০ জুলেরিমে বিশ্বকাপ হাতে ব্রাজিল দলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো। ছবি: টুইটার

আজ বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ। চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগ মুহূর্তে দেখতে আংটির মতো লাগে। আগুনে আংটি! ৫০ বছর আগের সেই দলটা জন্য এটা কি প্রকৃতির উপহার?

১৯৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দল ইতিহাসের অন্যতম সেরা। কথাটা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলার কারণ, কোনো বিবেচনাতেই পেলে-টোস্টাও-জেয়ারজিনহোদের সেই দল এর নিচে নামেনি। বরং মারিও জাগালোর সেই দল অনেকের বিচারেই বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা। তাই প্রকৃতি মোটেই বেরসিক নয়। সময়ের কাজটা সময়েই করতে জানে। কীভাবে? সে কথাই বলছি।

বলা হয়, মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপ দিয়েই আধুনিক ফুটবলের পথচলা শুরু। সেটি শুধু খেলার ধরণে নয়। তার আগে গ্যালারির বাইরের মানুষের জন্য বিশ্বকাপ ছিল রেডিওতে শোনার উপলক্ষ্য। একটু ভুল হলো। বিশ্বকাপ টিভিতে প্রথম সরাসরি সাদা-কালো পর্দায় সম্প্রচার হয় ১৯৬৬ থেকে।

পরের সংস্করণ অর্থাৎ ১৯৭০ মেক্সিকো থেকে শুরু হলো টিভিতে রঙিন বিশ্বকাপ। মেক্সিকান সূর্যের খরতাপে সেবার হলুদ জার্সির সোনালী দ্যূতি ছড়ান রিভেলিনো, পেলেরা। তার আগে দেখে গেছে সাদা-কালো পেলেকে। রঙীন পেলেকে দেখার শিহরণটা তাই সেবার একদম অন্যরকম ছিল। এমন সব রঙিন অনুভূতিই সেবার জন্ম দিয়েছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের কিছু 'আইকনিক মুহূর্তের। ফাইনালে হেডে গোল করে সতীর্থের কোলে চড়ে পেলের উদযাপন তার অন্যতম।

পেলে নিজেও সময় পেলে '৭০ বিশ্বকাপের ভিডিও ফুটেজ বেশি দেখে থাকেন। ইউটিউব থেকে নানা মাধ্যমে অন্য যেকোনো বিশ্বকাপের তুলনায় অর্ধশতাব্দী আগের ফুটেজ একেবারে কম নেই। ফিফাকে পেলে বলেছেন, 'টিভি অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য মাধ্যমে প্রচুর ভিডিও থাকায় আমি ওটাই দেখে থাকি। খুব সতর্ক না থাকলে চোখ ভিজে আসে।'

মেক্সিকোয় পেলের গলায় উঠেছিল তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পদক। ওই সাফল্য তাঁকে তর্কযোগ্যভাবে অধিষ্ঠিত করে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের সিংহাসনে। এমনকি গোল মিসগুলোও মানুষ মনে রেখেছে। এর আলাদা ফুটেজও আছে। সাবেক চেকোশ্লোভাকিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রান্ত থেকে নেওয়া তাঁর শট, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর হেডে গর্ডন ব্যাঙ্কসের অতিমানবীয় 'সেভ'। আর সেই 'ডামি'! উরুগুয়ের বিপক্ষে, ওইরকম কিছু ভাবাটা সাধারণের উর্দ্ধে।

ব্রাজিলিয়ান ছন্দের ফুটবলের কথা উঠলে '৭০ বিশ্বকাপে জাগালোর দলটি তাই অনেকের কাছেই শেষ কথা। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ৪-২ গোলে হেরেছিল পেরু। সে ম্যাচে খেলা পেরুর ইতিহাসে অন্যতম সেরা তিওফিলো কুবিলাস বুঝিয়েছিলেন ব্রাজিলের সেই দলটার মোজেজা, 'ওদের দলে ১০ নম্বর জার্সি ছিল চারটি। চার গোল দিলে ওরা আটটা দিত।'
পেলে সেরা তারকা হলেও জাগালোর একাদশে কেউ কারও চেয়ে কম ছিলেন না। ক্লদোয়ালদো, জেয়ারজিনহো, রিভেলিনো, টোস্টাও, কার্লোস আলবার্তোরা নিজ নিজ জায়গায় ছিলেন অন্যতম সেরা। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে জিততে পেলের গোলের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়নি।

ফাইনালে ব্রাজিলের সামনে ছিল ইতালি। স্যান্দ্রো মাজ্জোল্লা, বনিসেগা রিভেরাদের শক্তির মূল জায়গা ছিল ইন্টার মিলান ঢংয়ের 'কাতানোচ্চিও' রক্ষণভাগ। আর এর কেন্দ্র মানে 'হৃদয়' ছিলেন জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি। ব্রাজিল তা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছিল।
সেদিন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ মিটার উচ্চতায় আজটেকা স্টেডিয়ামে পেলেরা যে খেলা উপহার দিয়েছিলেন তার বয়ান দিয়ে গেছেন বিশ্লেষক থেকে ঐতিহাসিকরা। প্রথমবারের মতো রঙীন পর্দায় হলুদ জার্সিতে অমন আক্রমণাত্বক ফুটবলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সবার। সংবাদসংস্থা এএফপির ভাষায়, ব্রাজিল যেন ফুটবল আবিষ্কার করছিল!

ফাইনালে ব্রাজিল জেতার পর উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু পেলে। ছবি: টুইটার
ফাইনালে ব্রাজিল জেতার পর উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু পেলে। ছবি: টুইটার

ফাইনালে ব্রাজিলের চার গোলের মধ্যে শেষটা দলীয় সমন্বয়ের সেরা নিদর্শন। গোলদাতা কার্লোস আলবার্তো বেঁচে থাকতে বিবিসিকে বলে গেছেন, 'গোলটা কত সুন্দর ছিল তা এখন বুঝি। সবাই এখনো গোলটা নিয়ে কথা বলে। কেউ পেলের গোলটা নিয়ে বলে না। দ্বিতীয় গোলটাও না। চতুর্থ গোলটা সবার মনে আছে। আমার মতে এটা বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সেরা গোল।'
কার্লোস আলবার্তো মারা গেছেন ২০১৬ সালে ৭২ বছর বয়সে।' ৭০ বিশ্বকাপের এই ব্রাজিল অধিনায়ক ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারদের একজন। পেলের সঙ্গে খেলেছেন সান্তোস ও নিউইয়র্ক কসমসে। জাগালোর সেই দলের দূর্বলতা বলতে ছিলেন শুধু ফেলিক্স। গোলরক্ষক। সেটিও বাকিদের তুলনায় কাগজ-কলমে। খেলা ছাড়ার পর গাড়ি ও রেফ্রিজারেটর বিপণনকর্মী ছিলেন ফেলিক্স। অতিরিক্ত ধূমপানের মাশুল গুণে ২০১২ সালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান ফেলিক্স।

বদমেজাজের জন্য পরিচিত সেন্টারব্যাক 'হারকিউলিস' ব্রিতো এখনো জীবিত। আরেক সেন্টাব্যাক উইলসন পিয়াজ্জা এখন পেট্রোল ব্যবসায় জড়িত। লেফটব্যাক এভেরালদো গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যান মাত্র ৩০ বছর বয়সে, ১৯৭৪ সালে। তাঁর ক্লাব গ্রেমিও এখনো মনে রেখেছে এভেরালদোকে। ক্লাবের ব্যাজে তিন তারকার মধ্যে সোনালি তারকাটি এভেরালদোর স্মরণে। গ্রেমিও থেকে '৭০ বিশ্বকাপ ব্রাজিল দলে একমাত্র সদস্য।

জেয়ারজিনহো এখন কোচ।'ফেনোমেনন' রোনালদোকে আবিষ্কার করেছিলেন বেশ আগে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে মূল পর্বে সব ম্যাচে গোল করা দুজন ফুটবলারের একজন তিনি। ৭৫ বছর বয়সী জেয়ারজিনহো একবার রিও ডি জেনিরোর মেয়র পদে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। ফি না দেওয়ায় আবেদনপত্র বাতিল হয়।

১৯৭০ বিশ্বকাপ ব্রাজিল দল। ছবি: টুইটার
১৯৭০ বিশ্বকাপ ব্রাজিল দল। ছবি: টুইটার

ক্লদোয়ালদো ২০১০ সালে পূর্ব তিমুর দলের কোচ ছিলেন। জড়িত ছিলেন ব্যবসার সঙ্গে। ফাইনালে শেষ গোলটির অভিযাত্রা শুরু তাঁর পা থেকেই। ইতালির চার ডিফেন্ডারকে ড্রিবলিংয়ে বিবশ করেছিলেন তিনি। পেলের পর '৭০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় 'গোল্ডেন লেফট'খ্যাত গারসন এখনো জীবিত। বলা হয়, '৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের 'মস্তিস্ক' ছিলেন এই গারসন।
ডিয়েগো ম্যারাডোনার 'আদর্শ' রিভেলিনো এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। 'ফ্লিপ ফ্লপ' ড্রিবলিং জনপ্রিয় করা রিভেলিনো ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে কুশলী খেলোয়াড়দের একজন। আর টোস্টাও? অনেকে বলেন, অনেকে বলেন ছেলেটার চোখে অকালে সমস্যা না হলে পেলের সমান জনপ্রিয়তা পেত। স্কুল ফুটবলে এক ম্যাচে একাই ৪৭ গোল করা টোস্টাও অনুশীলনে চোখের ‍দূর্ঘটনায় পড়ে ফুটবল ছেড়ে দেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে!

পেলের কথা তো সবার জানাই।

'৭০ বিশ্বকাপজয়ী সেই দলটির সবাই এখন আর একসঙ্গে নেই। কেউ এপাড়ে কেউ ওপাড়ে। তবু আজ অন্তত সবাই মনে মনে মিলে যাবে একসূত্রে। আকাশে সাময়িক লটকে থাকা ওই কল্পিত 'আগুনে আংটি' হয়তো টুপ করে কারও হাতে এসে পড়বে না। কিন্তু মনে মনে শুধু তাঁরা কেন, ফুটবলপ্রেমীরা মাত্রই বিশ্বাস করবেন, আজ ওটা যদি কেউ পাওয়ার যোগ্য হয় তবে সেটা শুধুই '৭০ ব্রাজিল।

৫০ বছর আগে অ্যাজটেকার সেই ফাইনাল যে গড়িয়েছিল আজ এই দিনে!