ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে অনুশীলন করে ফরিদপুরের ঝাড়ুদার

সময়ের ব্যবধান আট বছরের। জীবনের বাস্তবতায় ব্যবধান দুই মেরুর। ২০১২ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একাডেমিতে যাওয়া রিপন আজ পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ছবি: সংগৃহীত/ প্রথম আলো
সময়ের ব্যবধান আট বছরের। জীবনের বাস্তবতায় ব্যবধান দুই মেরুর। ২০১২ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একাডেমিতে যাওয়া রিপন আজ পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ছবি: সংগৃহীত/ প্রথম আলো
>ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে অনুশীলন করার সুযোগ রিপন কুমার দাসকে দেখিয়েছিল বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ডানা ভেঙে পড়েছে বাস্তবতার জমিনে।

সকালের সূর্যটা কেবল আলো ছড়াতে শুরু করেছে। ফরিদপুর সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের ব্যস্ত হয়ে উঠতে তখনো অনেকটা সময় বাকি। তখনই ঢাকার ফুটবলের পরিচিত এক ক্লাবের জার্সি গায়ে দেখা গেল একজন পরিচ্ছনতাকর্মীকে। মাথা নিচু করে ভবন চত্বর ঝাড়ু দিয়ে যাচ্ছেন। তরুণের সুঠাম শরীরী গঠন বলে দিচ্ছিল তাঁর অন্য গল্পও থাকতে পারে।

হ্যাঁ, এই তরুণ শুধুই একজন ঝাড়ুদার নন, তিনি একজন ফুটবলারও। ফরিদপুর জেলা দলের খেলোয়াড়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন টি অ্যান্ড টি ক্লাবের হয়ে। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুতে যে সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন, তাতে ২৩ বছর বয়সী ফুটবলার রিপন যেতে পারতেন আরও অনেক দূর। ২০১২ সালে মুঠোফোন কোম্পানি এয়ারটেলের (বর্তমানে রবি আজিয়াটা লিমিটেড) প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে নির্বাচিত হয়ে যে ১২ জন ফুটবলার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন ফরিদপুরের এই মিডফিল্ডার।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ওয়েইন রুনি, রিও ফার্নিনান্দ, রবিন ফন পার্সির মতো তারকাদের দেখে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পাখা মেলেছিল রিপনের। কয়েক বছর না যেতেই সে স্বপ্ন ডানা ভেঙে পড়ে বাস্তবতার জমিনে। ফুটবলটা এখনো খেলেন ঠিকই, তবে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের পরিবর্তে তাঁর জীবনে এখন একটাই লক্ষ্য—মাস্টাররোলে ঢুকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরিটা যদি পাকা করা যায়!

কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে রিপনকে ছুটতে হয় সড়ক ও জনপথ অফিসে। তিন–চার ঘণ্টা ধরে অফিসের বিভিন্ন কক্ষ পরিষ্কার করেন। পরিষ্কার করতে হয় শৌচাগারগুলোও। রিপনের মা, বাবাও ফরিদপুর সড়ক ও জনপথ অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ২০১৬ সাল থেকে বছরে প্রায় সাত মাস রিপনও এই কাজই করে যাচ্ছেন। মা–বাবার অবসরের পর নিজের একটি চাকরি হবে, সেই আশায়। রিপনের কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস, 'এখন ঝাড়ু দেওয়া, টয়লেট পরিষ্কার করাই আমার কাজ। করোনার সময়ে খেলা নেই বলে মার্চ মাস থেকে প্রতিদিন কাজে আসি।'

কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যাঁর চোখে এঁকে দিয়েছিল বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন, তিনি কী করে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হয়েই জীবন কাটিয়ে দেবেন! রিপন যেন বাস্তবতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করেছেন, 'দেশে ফেরার পর সব আগের মতো হয়ে যায়। সারা দেশ থেকে বেছে নেওয়া ১২ জন ফুটবলারের মধ্যে সুযোগ পেয়েছিলাম। অথচ দেশে ফেরার পর আমি কখনো জাতীয় পর্যায়ের কোনো বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাইনি। আর নিয়মিত খেলা না হলে কোথায় খেলব! পরিবারের আর্থিক সমস্যা আছে। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই কাজ বেছে নিয়েছি।'

ম্যানচেস্টার থেকে আসার পর ২০১৪ সালে আবাহনী অনূর্ধ্ব–১৬ দলের হয়ে খেলেছিলেন রিপন। এরপর তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগ হয়ে ২০১৯ সালে খেলেন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে। কিন্তু পাননি প্রত্যাশা অনুযায়ী পারিশ্রমিক। তার চেয়েও বড় হতাশা, প্রতিভা বিকাশের জন্য যে রকম ভালো কোচের অধীনে তাঁর খেলা দরকার ছিল, পাননি সে রকম কাউকে।

রিপনের মধ্যে যে সম্ভাবনা ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সারা দেশের ৬০ হাজার ছেলের মধ্যে থেকে বাছাই করে ওই ১২ জনকে ইংল্যান্ডের টিকিট তো আর এমনি এমনি দেননি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তিন স্কাউট কেভিন কনেল, মাইকেল বেনেট ও মাইকেল ম্যাকক্লিন। রিপনের প্রসঙ্গ তুলতেই হতাশা ঝরল বাফুফের বেতনভুক্ত কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানীর কণ্ঠে, 'ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে অনুশীলন করার সুযোগ পাওয়া একজন ফুটবলার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করে, শুনতেও কষ্ট লাগে। রিপনের মধ্যে অনেক বড় খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই রকম প্রতিভার হারিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য হতাশার।'

প্রতিভা খুঁজে আনার কঠিন কাজটি করে দিয়েছিল এয়ারটেল। কিন্তু প্রতিভা বিকশিত হতে পারত যাঁদের হাত ধরে, তাঁরা কি তাঁদের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করেছেন? করলে তো আর রিপনকে আজ মাস্টাররোলের চাকরির আশায় থাকতে হয় না।
রিপনের গল্পটা দেখুন...