ডাচ্ রাজত্বের শুরু ও ব্রায়ান ক্লফের চমক

১৯৭৮–৭৯ ইউরোপিয়ান কাপজয়ী নটিংহ্যাম ফরেস্ট। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৮–৭৯ ইউরোপিয়ান কাপজয়ী নটিংহ্যাম ফরেস্ট। ছবি: সংগৃহীত
>

ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে বড় ট্রফি চ্যাম্পিয়নস লিগ। তবে বড় ট্রফি বলে যে সব সময় বড় ক্লাবগুলোই এটা জিতেছে, তা কিন্তু নয়। বেশ কয়েকবার ‘পুঁচকে’ অনেক ক্লাবই সবাইকে চমকে দিয়ে হয়ে গেছে ইউরোপসেরা।

করোনা বিরতি শেষে কয়েক দিন পরেই আবার মাঠে গড়াবে চ্যাম্পিয়নস লিগ নকআউট পর্বের বাকি খেলাগুলো। বায়ার্ন মিউনিখ, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার সিটি, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ কিংবা পিএসজির মতো বড় ক্লাব তো বটেই, ইউরোপসেরা হওয়ার লড়াইয়ে এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত টিকে আছে আতালান্তা, নাপোলি, অলিম্পিক লিওঁ ও লাইপজিগের মতো সাদা চোখে হিসেবের বাইরে থাকা ক্লাবগুলোও।

তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাস বলছে, এখানে কোনো ক্লাবকেই হিসেবের বাইরে রাখার উপায় নেই, বিশেষ করে নকআউট পর্বে তো নয়ই। বিভিন্ন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে যাওয়া কিছু ক্লাবের গল্প নিয়ে এই ধারাবাহিক। আজ প্রথম পর্ব—

১৯৬৯-১৯৭০ ইউরোপিয়ান কাপ

চ্যাম্পিয়ন: ফেইনুর্ড
‘লিসবন লায়নসে’র এই জয়টায় গর্ব করার মতো কিছু ছিল না।

দুই লেগের ম্যাচ শেষ ৩-৩ স্কোরলাইনে। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ৩-০ গোলে পাওয়া জয়ের সুবিধা ততক্ষণে সম্পূর্ণভাবে খুইয়েছে ‘হট ফেবারিট’ সেল্টিক, লিসবনের সেরা ক্লাব বেনফিকার কাছে দ্বিতীয় লেগে ৩-০ গোলে হেরেছে। অতিরিক্ত সময়েও কোনো দল গোল করতে পারল না।

‘আমার সঙ্গে ড্রেসিংরুমে এসো।’

ডাচ রেফারি লরেন্স ফন রাভেন্সের আদেশ দুই অধিনায়ক বিলি ম্যাকনিল (সেল্টিক) ও মারিও কোলুনার (বেনফিকা) কানে ঠিকমতো ঢোকার কথা নয়। অবশ্য দুই লেগ মিলিয়ে ১৮০ ও অতিরিক্ত আরও ৩০ মিনিট খেলার পরেও দুই দলকে যখন আলাদা করা যায় না, বিজয়ী নির্ধারণ করার জন্য যখন শেষমেশ ভাগ্যের আশ্রয় নেওয়া লাগে, ওই সময়ে কারও কথা কানে ভালোভাবে না ঢোকাই স্বাভাবিক।

ক্লান্ত ঘোরলাগা দুই অধিনায়ক ঢুকলেন ড্রেসিংরুমে, রেফারির পিছু পিছু। সঙ্গে আছেন দুই দলের দুই কোচ। সেল্টিকের জক স্টাইন ও বেনফিকার অটো গ্লোরিয়া মার্টিনস।

এখানেই বিজয়ী নির্ধারণ করা হবে, কয়েন টসের মাধ্যমে!

ভুল পড়েননি। সেবার উয়েফা নিয়ম করেছিল, দুই লেগসহ অতিরিক্ত সময়েও যদি দুই দলকে আলাদা করা না যায়, তখন সাহায্য নিতে হবে ভাগ্যের। আর সে ‘সাহায্য’ করবে একটা ধাতব মুদ্রা।

ম্যাকনিল ‘হেড’ ডাকলেন। রেফারির হাত খোলার পর দেখা গেল, হেড-ই এসেছে। ম্যাকনিল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন কি ফেলবেন না, এমন অবস্থায় রেফারি ‘সমন’ জারি করলেন, প্রথমবার শুধুই ‘টস প্র্যাকটিস’ করা হয়েছিল! আসল টস হবে দ্বিতীয়বার। একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল বেনফিকা অধিনায়ক কোলুনার মুখ। সে আলো নিভতে বেশীক্ষণ লাগল না। দ্বিতীয়বারও ম্যাকনিল ‘হেড’ই ডেকেছিলেন, পড়েছিলও হেড।

১৯৬৭ সালের ইউরোপসেরা সেল্টিক এভাবেই লিসবনের দল বেনফিকাকে টপকে গিয়েছিল পরের রাউন্ডে।

তিন বছর আগে সর্বজয়ী ইন্টার মিলানকে লিসবনের মাটিতে হারিয়ে নিজেদের ডাকনাম ‘লিসবন লায়নস’কে ইতিহাসের পাতায় লিখেছিলেন সেল্টিকের খেলোয়াড়েরা। সেই লিসবনের সবচেয়ে বড় ক্লাবকে হারিয়ে যেখানে নামটার সার্থকতা আরেকবার প্রমাণ করার সুযোগ এল, সেল্টিক জিতল আক্ষরিক অর্থেই ভাগ্যের পক্ষপাতিত্বে। এ জয়ে গর্ব করার মতো কিছু থাকেই বা কি করে!

সে ম্যাচের পর বেনফিকার খেলোয়াড়দের অভিশাপ সেল্টিকের গায়ে লেগেছিল কি না, কে জানে! নাহলে বেনফিকা-লিডসের মতো পরাক্রমশালী দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা কোন দল কী কখনও ওভাবে হারে?

ফেইনুর্ড যে সেবার ইউরোপসেরা হবে, কেউ কস্মিনকালেও ভাবেনি। সেল্টিকের রাইটব্যাক ডেভিড হে’র মতে, ফেইনুর্ড শিরোপা জিতবে, এ নিয়ে বাজির দর ছিল ১-৪৪। অর্থাৎ ফেইনুর্ড শিরোপা জিতবে-এর পক্ষে এক টাকা বাজি ধরলে শিরোপা জেতার পর আপনি পাবেন তার চেয়ে ৪৪ গুণ বেশি। সেল্টিকের তারকারা ফেইনুর্ডকে সেভাবে পাত্তাই দেননি। ভেবেছিলেন, লিডসের মতো প্রতিপক্ষকে সেমিতে হারানো গেলে ফেইনুর্ড আবার কোন ছার! ফাইনাল খেলা সেল্টিকের মিডফিল্ডার বার্টি অল্ড সেটাই স্বীকার করেছিলেন পরে।

কিন্তু নব্বই মিনিটের খেলায় নিজেদের নিয়ে সেল্টিক তারকাদের ভাবনার মোড় পুরোটাই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ফেইনুর্ডের খেলোয়াড়েরা। ম্যাচের ৩০ মিনিটে টমাস গ্রেমেলের গোলে সেল্টিক এগিয়ে গেলেও মাত্র দেড় মিনিট পর অধিনায়ক রাইনাস ইজরায়েলের কল্যাণে সমতায় ফেলে ডাচ ক্লাবটা। ম্যাচের শুরুতেই চোটে পড়েছিলেন সেল্টিকের সেন্টারব্যাক জিম ব্রোগান, তাছাড়া ফেইনুর্ড সে ম্যাচে এমনিতেও ছড়ি ঘোরাচ্ছিল সেল্টিকের ওপর। কোনরকমে নব্বই মিনিট কাটাতে পারলেও অতিরিক্ত সময়ে আর রক্ষা হয়নি স্কটিশ চ্যাম্পিয়নদের। সুইডিশ স্ট্রাইকার ওভ কিন্দভালের শেষ মূহুর্তের গোলে স্বপ্নভঙ্গ হয় সেল্টিকের। আর ফুটবল বিশ্বে ডাচ রাজত্বের সূচনা করে দিয়ে যায় ফেইনুর্ড। যে রাজত্বের ব্যাটন কিছুদিন পরেই নিয়ে নেয় ইয়োহান ক্রুইফের আয়াক্স।

১৯৬৯-৭০ ইউরোপিয়ান কাপজয়ী ফেইনুর্ড। ছবি: সংগৃহীত
১৯৬৯-৭০ ইউরোপিয়ান কাপজয়ী ফেইনুর্ড। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৮-৭৯ ইউরোপিয়ান কাপ

চ্যাম্পিয়ন: নটিংহাম ফরেস্ট
প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ চলছে নবাগত নটিংহ্যাম ফরেস্ট আর চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের মধ্যে। নটিংহামের মাঠেই খেলা। নবাগত হিসেবে বেশ দুর্দান্ত খেলছে দলটা। এর মধ্যেই একটা গোল দিয়ে বসল ব্রায়ান ক্লফের দল।

গোল খেয়েও খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না চ্যাম্পিয়নদের। গোলদাতা গ্যারি বার্টলসকে লিভারপুলের সেন্টারব্যাক ফিল থম্পসন তো বলেই বসলেন, ‘এক গোল নিয়ে অ্যানফিল্ডে খেলতে যাবে? যথেষ্ট হবে না।’ ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, নিজেদের মাঠে পরের লেগে ঠিকই ঘাটতি পুষিয়ে পরের রাউন্ডে উঠে যাবে লিভারপুল। ম্যাচ শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে সবাইকে চমকে দিয়ে আরেকটি গোল করে বসল নটিংহাম।

‘এবার যথেষ্ট হবে তো?’ উৎফুল্ল বার্টলসকে জবাব দেওয়ার কিছু পাননি থম্পসন!

নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার কাজটা অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিল নটিংহাম। দ্বিতীয় বিভাগ থেকে উঠে এসেই হানা দিয়েছিল লিভারপুলের লিগ-রাজত্বে। ব্রায়ান ক্লফ আর পিটার টেলরের যুগলবন্দীতে সোনা ফলছিল সব জায়গায়—তা ইংল্যান্ড হোক বা ইউরোপ। তাই বলে লিগের পাশাপাশি আসলেই যে তারা ইউরোপিয়ান কাপ জিতে নেবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি। সেমিফাইনালে জার্মানির এফসি কোলনের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে ৩-৩ গোলে ড্র করে নৈরাশ্যবাদীদের কথা বলার আরেকটু সুযোগ করে দেয় ক্লফের দল।

‘আমার মনে হয় কেউ আমাদের এখনই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার মতো নির্বোধ হবে না’—ক্যামেরার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে ইস্পাতকঠিন কণ্ঠস্বরে বলা ক্লফের কথাগুলোতে কী যেন ছিল!

সে কথার জোরেই হোক আর যে কারণেই হোক না কেন, দ্বিতীয় লেগে কোলনের মাঠে গিয়ে ১-০ গোলে জিতে আসে নটিংহ্যাম। ফাইনালে যাদের পেয়েছিল, তাদের গল্পও অনেকটা ক্লফদের মতোই ছিল। তবে সুইডিশ ক্লাব মালমোকে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের রূপকথার সফল সমাপ্তি টানার সুযোগ পায় সেই নটিংহামই। জিতে নেয় ইউরোপিয়ান কাপ। পরের বছর আবারও ইউরোপসেরা হয়েছিল তারা, তবে স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয়বারেরটায় অত চমক কাজ করেনি। তখন আসলেই সবাই বুঝে গিয়েছিল, নটিংহামও পরাশক্তিদের কাতারে।