কেউ শোনে না বলবয়দের দুঃখগাথা

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর ফাঁকে বলবয়েরা। ছবি: সংগৃহীত।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর ফাঁকে বলবয়েরা। ছবি: সংগৃহীত।

টিনের ছোটো ডালির ওপর সাজানো পান, জর্দার কৌটা, সিগারেটের প্যাকেট। গামছা দিয়ে ডালিটা শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে কিশোর রমজান আলী। গায়ে বসুন্ধরা কিংসের পুরোনো জার্সি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও আশপাশের এলাকায় নিয়মিত পান-সিগারেট ফেরি করে বেড়াচ্ছে ঢাকার ফুটবলের এই বলবয়।

গত পাঁচ মাস বন্ধ ঘরোয়া ফুটবল। করোনার মহামারিতে বন্ধ হয়ে গেছে বলবয়দের সামান্য উপার্জন। বাধ্য হয়েই জীবিকার তাগিদে কেউ ফেরি করছে পান-সিগারেট। কেউ মুরগীর দোকানের সহকারী, কেউ অফিস পাড়ায় সরবরাহ করছে টিফিন বাক্স। অনেকে বাসায় বসে দিন গুনছে খেলা শুরুর।

প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ, বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, এএফসি কাপের ম্যাচ-–সব মিলিয়ে করোনার আগ পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কেটেছে বলবয়দের। ১৪ জন কিশোর বলবয় মাঠের বাইরে সারাক্ষণ ছুটোছুটি করতো। বল কুড়িয়ে তুলে দিত ফুটবলারদের হাতে।

প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচপ্রতি একজন বলবয় ফুটবল ফেডারেশনের কাছ থেকে পায় মাত্র ১০০ টাকা করে। আর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে প্রত্যেক বলবয় ম্যাচপ্রতি পেয়ে থাকে ২৫০ টাকা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ম্যাচ থাকত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। মাস শেষে তাই বাবা-মায়ের হাতে যৎকিঞ্চিত টাকা তুলে দিতে পারতো এই বলবয়েরা। কিন্ত দেশে করোনা শুরু হতেই মানবেতর দিন কাটাচ্ছে বলবয়েরা।

এদেরই একজন আরামবাগের রাকিব হোসেন। বাবা আরেকটা বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। মাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় খুব কষ্টে দিন কাটছে রাকিবের। মায়ের সঙ্গে ইদানিং মতিঝিলের বিভিন্ন অফিসে টিফিন বাক্স সরবরাহের কাজ করছে সে। কিন্তু এত অল্প আয়ে সংসার কিভাবে চলবে তা ভেবেই চিন্তিত রাকিব, ‘বাবা আমাদের খোঁজখবর নেয় না। আমি বলবয়ের কাজ করে মায়ের হাতে টাকা তুলে দিতাম। কিন্তু এখন সেটাও করতে পারছি না। খুব খারাপ লাগে।’ রাকিবের সহোদর আরিফ হোসেনও বলবয়। খেলা বন্ধ হওয়ার পর কয়েক মাস বেকার হয়ে অলস সময় কাটিয়েছে বাসায়। কিন্তু গত মাস থেকে আরামবাগের একটি মুরগীর দোকানে ফুটফরমাশের কাজ নিয়েছে আরিফ।

বলবয়ের পাশাপাশি পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে খেলে রিয়াদ হাওলাদার। এর আগে তৃতীয় বিভাগে খেলেছে সূর্যতরুণ সংঘে। ২০১৩ সালে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট মক কাপেও খেলেছে। স্বপ্ন ছিল বড় ফুটবলার হওয়ার। কিন্তু খেলা বন্ধ হওয়ায় হতাশা ঘিরে ধরেছে রিয়াদকে। বর্তমানে ফকিরেরপুলে একটি ছাপাখানায় অফিস সহকারীর কাজ করছে সে। রিয়াদের বাবা বাস কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা। কিন্তু করোনার কারণে সেই কাজ বন্ধ। মা গৃহকর্মী। ছাপাখানা থেকে পাওয়া সামান্য পারিশ্রমিক মায়ের হাতে তুলে দিচ্ছে রিয়াদ। কিন্তু এই উপার্জনও যথেষ্ট নয় রিয়াদের, ‘জানি না কবে খেলা শুরু হবে। কবে আবার মাঠে গিয়ে কাজ করতে পারব। করোনায় দুঃস্থ অনেক ফুটবলার সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু আমরা কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাইনি।’

বলবয় মামুন হোসেন মোল্লা ও শেখ সাদিক করোনার সময় কোনো কাজ জোটাতে পারেনি। সাদিকের বাবা আলমগীর হোসেনের ঔষধের প্যাকেট তৈরির ব্যবসা বন্ধ। ছেলেকে নানীর কাছে টাঙ্গাইল পাঠিয়ে দিয়েছেন আলমগীর। সেগুনবাগিচার দুই বলবয় সোহেল রানা ও জুবায়ের হোসেন করোনা শুরু হতেই ফুটবল অনুশীলন করতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলে। সেই চোট সারেনি, উল্টো খেলা বন্ধ হয়ে উপার্জনও নেই তাদের। সব মিলিয়ে হতাশ সোহেল, ‘এই বিপদে চারদিকে অন্ধকার দেখছি।’

ঈদের আগে বলবয়দের সামান্য উপহার দিয়েছে সাইফ স্পোর্টিং ফ্যান ক্লাব। প্রত্যেক বলবয়কে সংগঠনটি দেয় এক হাজার টাকা। পাশাপাশি চিনি, তেল, দুধ ও পোলাওয়ের চাউলের প্যাকেট পেয়েছে বলবয়েরা। কিন্তু এই সামান্য টাকায় কি আর সংসার চলে?

বলবয় আবদুর রহমান আক্ষেপ করে বলছিল, ‘আগে বাফুফে থেকে প্রতি ম্যাচে ২০০ টাকা করে পেতাম। দিনে দুটো ম্যাচ হলে ৪০০ টাকা রোজগার হতো। এখন সেটা কমে ১০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর ওপর খেলা বন্ধ। বলবয়দের বিপদে কেউ খোঁজ নেয় না। অথচ সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে বিভিন্ন ফেডারেশন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চাইছি।’

মাঠে দর্শকদের চোখ আটকে থাকে গোলপোস্ট আর বলের দিকে। স্ট্রাইকারদের ফিনিশিং, প্লে–মেকারদের অ্যাসিস্ট আর ডিফেন্ডারদের ট্যাকলিংয়ের সম্মোহনের মাঝে আড়ালেই থেকে যায় বলবয়েরা। করোনার এই কঠিন সময়ে সবারই যখন জীবন-জীবিকা নিয়ে টানাটানি, এ বেলায়ও অজানা থেকে যাচ্ছে বলবয়দের দুঃখের গল্পগুলো।