নেইমার-রোনালদোর ময়দানে মেসির জন্য হারানো বিজ্ঞপ্তি

হতাশ মেসি, গত কয়েক মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে পরিচিত দৃশ্য। ছবি: এএফপি
হতাশ মেসি, গত কয়েক মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে পরিচিত দৃশ্য। ছবি: এএফপি

আর কখনো কি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হবে লিওনেল মেসির?

তাঁর অর্জনের খাতায় ইউরোপের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট চারবার জয়ের কথা লেখা থাকবে। কতশত কিংবদন্তি তো একবারও জিততে পারেননি। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো ইন্টার মিলান, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলানের মতো ক্লাবে খেলেও কখনো এ শিরোপার স্বাদ পাননি। কিংবদন্তি গোলকিপার জিয়ানলুইজি বুফনের একটা চ্যাম্পিয়নস লিগের অপেক্ষা এত বছরেও ফুরায়নি। চ্যাম্পিয়নস লিগ যুগে মেসির চারটির চেয়ে ব্যক্তিগতভাবে বেশি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার রেকর্ড শুধু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর—৫টি। কিন্তু মেসির চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগের গল্পও কত পুরোনোই না মনে হয় এখন!
চ্যাম্পিয়নস লিগ, মেসি, বার্সেলোনা...শব্দগুলো একসঙ্গে দেখলে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আরও কিছু শব্দ সামনে নিয়ে আসবে—লজ্জা, আত্মসমর্পণ, বিদায়। দলের অসহায় হারের পর কোমরে হাত দিয়ে মাটিতে তাকিয়ে আছেন, কিংবা শূন্য দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে আছেন—মেসির এমন ছবি গত পাঁচ বছরে যে নিয়মিত হয়ে গেছে! জুভেন্টাস, রোমা, লিভারপুলের পর অপমানের সর্বশেষ কিস্তি মেসির কপালে জুটল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানোর রোনালদো দেশে, রোনালদোরই শহরে। লিসবনের স্তাদিও দা লুজে বায়ার্নের কাছে ৮-২ গোলে হেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে আরেকবার মেসিকে বিদায় নিতে হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে। চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সার সবচেয়ে বাজে হার তো বটেই, সবচেয়ে বাজে হার মেসির ক্যারিয়ারেরও।
বায়ার্নের অষ্টম গোলের পর একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছে। স্কোরলাইন বায়ার্ন ৮: ২, আর মেসি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে শূন্যে। যে ছবিটা আরেকবার প্রশ্ন হয়ে সামনে দাঁড়ায়—তাঁরই এক সময়ের সতীর্থ ও বন্ধু নেইমার, তাঁরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদোর সঙ্গে মেসি এই একটা পাল্লায় কি কখনো সমতায় আসতে পারবেন? দলের চাপের মুহুর্তে মেসির ভেঙে পড়ার ছবি যে নিয়মিত!
আট গোল খাওয়ার পর একটা দলের ফরোয়ার্ডের চেয়ে ডিফেন্ডারদের, কোচের সমালোচনাই বেশি হওয়া উচিত। তা হচ্ছেও। কিন্তু যে মেসির ওপর বার্সেলোনা অন্ধের মতো ভরসা করে পথ চলছে ইদানীং, যে মেসি ছাড়া বার্সা আর ইউরোপের মাঝারি সারির দলের খেলায় তেমন পার্থক্য আর চোখে পড়ে না তেমন, সেই মেসি কেন দল চাপে থাকলে উবে যান? রোনালদো-নেইমার যেখানে আপন আলোয় জ্বলে ওঠেন, মেসি কেন নিভে যান ধুপ করে?
বেশি দূর যেতে হবে না। এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনালে জুভেন্টাস, পিএসজির পর বার্সেলোনার ম্যাচ তিনটির কথা মনে করে দেখুন। পিএসজি সেমিফাইনালে গেলেও জুভেন্টাস আর বার্সা বাদ পড়েছে। কিন্তু সে তো দলীয় পারফরম্যান্সের হিসাব। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে রোনালদো-নেইমারের সঙ্গে মেসির তুলনা করলে? বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড হয়তো তুলনায়ই আসবেন না!
অলিম্পিক লিওঁর সঙ্গে দুই লেগ মিলিয়ে ২-২ গোলে ড্র করলেও 'অ্যাওয়ে গোল' বা প্রতিপক্ষের মাঠে বেশি গোলের নিয়মে বাদ পড়েছে রোনালদোর জুভেন্টাস। করোনাবিরতির আগে মার্চে লিওঁর মাঠে প্রথম লেগে ১-০ গোলে হেরে আসা জুভেন্টাস গত ৭ আগস্ট নিজেদের মাঠে প্রথমে গোল খেয়ে আবার পিছিয়ে পড়ে। সেখান থেকে দলকে উদ্ধার করে সেমিফাইনালে হয়তো নিয়ে যেতে পারেননি, কিন্তু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চেষ্টার কমতি ছিল না। জুভেন্টাস সেদিন ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা ২-১ গোলে জিতেছে, তাতে দুটি গোলই রোনালদোর, দ্বিতীয়টি বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের দারুণ শটে।
নেইমার তো শেষ মুহূর্তের ঝলকে চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজির সুন্দরতম রাতটিরই গল্প লিখে দিয়েছেন। এই মৌসুমে ইতালিতে-ইউরোপে দুর্দান্ত গতিময় আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে নজরে আসা আতালান্তার বিপক্ষে প্রথমে পিছিয়ে পড়ে নেইমারের পিএসজি। তারওপর নিষেধাজ্ঞায় সেদিন অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াকে পায়নি ফরাসি ক্লাবটি, চোট কাটিয়ে ওঠা এমবাপ্পে বেঞ্চ থেকে নেমেছেন ৬০ মিনিট পর। ম্যাচে দু-তিনটি সহজ সুযোগ অবিশ্বাস্যভাবে মিস করলেও ম্যাচজুড়ে আলো ছড়িয়েছেন নেইমার। পিএসজির প্রতিটি আক্রমণ প্রাণ পেয়েছে তাঁর ছোঁয়ায়। ড্রিবলিংয়ে-নাটমেগে মুগ্ধ করেছেন। তাঁর ফুটবলে পিএসজিকে নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয় ও ২০১১ সালে কাতারি মালিকানায় আসার পর প্রথম সেমিফাইনালে তোলার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা ছিল স্পষ্ট।
শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞারই জয় হয়েছে। ৮৯ মিনিটে নেইমারের পাসে মারকিনিওসের গোলে পিএসজি ফেরে সমতায়, তিন মিনিট পর চুপো-মোতিংয়ের গোলে পিএসজির জয়। সে গোলটিতে শেষ পাস এমবাপ্পের, কিন্তু বক্সের ওপর থেকে যে দারুণ রক্ষণচেরা থ্রু-তে এমবাপ্পেকে 'ফ্রি' করে দিয়েছেন নেইমারই। সে তুলনায় মেসি কী করেছেন?

ছবিটা দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করবে মেসিকে। ছবি: টুইটার
ছবিটা দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করবে মেসিকে। ছবি: টুইটার

নাপোলির বিপক্ষে শেষ ষোলোতে তাঁর দারুণ গোলে-পারফরম্যান্সেই উদ্ধার পেয়েছে বার্সা। সেদিন মেসিকে দেখে মনে হয়েছিল, তাঁর চোখে 'সুন্দর শিরোপা' চ্যাম্পিয়নস লিগ আবার ক্যাম্প ন্যু-তে নিয়ে যেতে আরেকবার প্রতিজ্ঞায় আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের চোয়ালটা বাঁধা। কিন্তু বায়ার্নের সামনে কাল আবার সেই পুরোনো চিত্রনাট্য। বার্সা জঘন্য, আর মেসির জন্য দিতে হয়েছে হারানো বিজ্ঞপ্তি।
এটা ঠিক শক্তিতে-কৌলিন্যে-ধারে-ভারে-ফর্মে বায়ার্নের সঙ্গে আতালান্তা বা লিওঁর তুলনাই চলে না। বার্সার বক্সের সামনেই ৭-৮ জনকে নিয়ে চোখধাঁধানো প্রেসিংয়ে বার্সার রক্ষণ থেকেই বল যেন বেরোতে দিচ্ছিল না বায়ার্ন। আট গোল খাওয়াই বলে দেয় রক্ষণ-মাঝমাঠ বলতে কিছু ছিল না বার্সার। কিন্তু রক্ষণ-মাঝমাঠ পেরোতে না পারায় আক্রমণও দানা বাঁধেনি। পুরো ম্যাচে বায়ার্ন যেখানে গোল করেছে ৮টি, বার্সার শটই মাত্র ৭টি! সেই ব্যর্থতা তো অনেকটা মেসির ওপরই বর্তায়।
প্রথমার্ধে তা-ও ভালোই খেলেছেন মেসি। কয়েকবার দারুণ ক্রস ফেলেছিলেন বক্সে। একবার তো তাঁর ক্রস পোস্টে লেগে ফিরে আসে। বায়ার্ন চতুর্থ গোলটি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বার্সার আক্রমণও প্রাণ পাচ্ছিল তাঁর পায়ে। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষভাগ আর দ্বিতীয়ার্ধের পুরোটায় বায়ার্নের সামনে বার্সার রক্ষণ-মাঝমাঠ ছিল অসহায়, মেসিও ছিলেন অচেনা। অথচ যে সময়টাতে তাঁর দিকেই বেশি তাকিয়ে ছিল বার্সা।
গত মৌসুমে লিভারপুলের মাঠে বার্সার লজ্জার হারে খুব একটা খারাপ খেলেননি, কিন্তু তার আগের মৌসুমে রোমার মাঠেও অচেনাই ছিলেন মেসি। তার আগের দুই বছরে জুভেন্টাস বা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠেও সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। যে সমালোচনাটা এতদিন আর্জেন্টিনার জার্সিতে শুনতে হয়েছে, ক্যারিয়ারের শেষদিকে বার্সেলোনাতেও তা-ই শুনতে হচ্ছে মেসিকে। যদিও আর্জেন্টিনার সঙ্গে বার্সেলোনার এখন একটা ব্যাপারে বেশ মিল—আক্রমণে অনেক তারকা থাকলেও দলের মাঝমাঠ ও রক্ষণ ভঙ্গুর, দলে ভারসাম্য বলতেও কিছু নেই। মেসির একার পক্ষে হয়তো তা ঢেকে দেওয়া সম্ভব নয়, যা আরেকবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় শুরুর সেই প্রশ্নে।পাঁচ বছর ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে হতাশা নিয়ে ফেরা মেসির আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হবে?

বার্সেলোনার এই দল সাজিয়ে আবার ইউরোপশ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ফিরতে হয়তো দুই-এক মৌসুম লেগে যাবে। সেটিও হবে যদি ভালো কোনো কোচ আসেন, দলও নাম না দেখে প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে খেলোয়াড় কেনেন।
কিন্তু মেসির যে বয়স ৩৩ ছাড়িয়ে ৩৪-এর দিকে ছুটছে। মাঠে তাঁর প্রভাবও দিনে দিনে কমছে। অন্তত সাম্প্রতিক চ্যাম্পিয়নস লিগ ব্যর্থতাগুলো তা-ই বলে।