কুতিনহো-বার্সেলোনার গল্পটার এমন পরিণতি!

কাল নিজের দ্বিতীয় গোল করছেন কুতিনহো। ছবি: এএফপি
কাল নিজের দ্বিতীয় গোল করছেন কুতিনহো। ছবি: এএফপি
রাখতে চায়নি বার্সেলোনা। বরং ধারে বায়ার্ন মিউনিখে চলে গিয়েছিলেন। সেই বায়ার্নের হয়েই কাল ৭৫ মিনিটে নামলেন কুতিনহো।

ইংরেজিতে ‘আইরনি’ লিখলেই চলে। কিন্তু বাংলায় শুধু ‘পরিহাস’ লিখলেই চলে না, গুরুত্ব বোঝাতে ‘নির্মম’ শব্দটাও যুক্ত না করলে একটু অস্বস্তি থেকে যায়। এখন ‘আইরনি’ বলুন বা পরিহাস, কাল শব্দটা ভালোভাবেই বাতাসে উড়ল।

কোয়ার্টার ফাইনালের ভাগ্য ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে। বার্সেলোনা-বায়ার্ন মিউনিখ ম্যাচের ৭৫ মিনিটে তবু সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন। বার্সেলোনার ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় ফিলিপে কুতিনহো মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; ম্যাচের গল্প যদি বদলায় এবার।

বার্সেলোনা সমর্থকদের মুখে তখনো রাজ্যের অন্ধকার। ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় নামছেন বটে, তবে সেটা যে প্রতিপক্ষের হয়ে! বার্সেলোনার হয়ে আলো কাড়া হচ্ছিল না, তাই তাঁকে ক্লাবে ফেলে রাখতে চায়নি বার্সেলোনা। বরং ধারে বায়ার্ন মিউনিখে চলে গিয়েছিলেন। সেই বায়ার্নের হয়েই কাল ৭৫ মিনিটে নামলেন কুতিনহো।

মাত্র ১৫ মিনিট সময় পেলেন। ওটুকু সময়ে যা করলেন, তাতেই এ ম্যাচটা মুলারের পাশাপাশি কুতিনহোরও হয়ে গেল। প্রথমে রবার্ট লেভানডফস্কির এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রতি ম্যাচের গোল করার রেকর্ডটা অক্ষুণ্ন রাখলেন। পরে করলেন আরও দুই গোল। কুতিনহোর এনে দেওয়া এ তিন গোল যদি বায়ার্নের না হয়ে বার্সেলোনার জার্সিতে হতো, তাহলেই চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বকালের সেরা ম্যাচের দেখা মিলে যেত কাল। ৫-২ অবস্থায় নেমেছিলেন, কুতিনহোর অবদানে পাওয়া তিন গোল বায়ার্নের বদলে বার্সার খাতায় গেলেই তো স্কোরলাইনটা হরর মুভির ৮-২ না হয়ে জমজমাট অ্যাকশন ফিল্মের ৫-৫ হয়ে যায়!

কিন্তু ক্লাবের ইতিহাসে যার জন্য সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে বার্সেলোনা, তাঁকে যে এ মৌসুমে প্রয়োজন মনে হয়নি তাদের।

বার্সেলোনার বিপক্ষে গোল করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন কুতিনহো। ছবি: এএফপি
বার্সেলোনার বিপক্ষে গোল করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন কুতিনহো। ছবি: এএফপি

কুতিনহোর এভাবে মূল্য কমার পেছনে অবদান আঁতোয়ান গ্রিজমানের। ভিত্তি মূল্য হিসেবে কুতিনহোর সমান ১২০ মিলিয়ন ইউরোতেই তাঁকে এনেছে বার্সেলোনা। শর্ত সাপেক্ষে কুতিনহোর জন্য আরও বেশি ব্যয় হওয়াতেই বার্সেলোনার ইতিহাসের দ্বিতীয় দামি খেলোয়াড় বনেছেন গ্রিজমান। তবু ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ডকে পেয়ে কুতিনহোকে আর ভালো লাগছিল না কাতালানদের। পিএসজির সঙ্গে নেইমারের জন্য অদলবদলের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়াতে বায়ার্নের কাছে ধারে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে তারা। ভাগ্যের পরিহাসে সেই গ্রিজমানও কাল মূল একাদশে জায়গা পাননি। ওদিকে ধারে খেলতে যাওয়া কুতিনহোও নাব্রি, মুলারকে টপকে মূল একাদশে ঠিক নিয়মিত হতে পারেননি বায়ার্নে। ম্যাচের শেষভাগে ওই চমকটুকু বার্সেলোনার আঘাতে নুনের ছিটা মাত্র।

২০১৮ সালের শুরুর দিকে এমন ভাগ্যের কথা কল্পনাও করতে পারেননি কুতিনহো। কদিন আগেই নেইমারকে পিএসজির কাছে হারিয়েছে বার্সেলোনা। এক ব্রাজিলিয়ানের অভাব আরেক ব্রাজিলিয়ান দিয়ে পূরণ করতে পাগল হয়ে উঠল বার্সেলোনা। লিভারপুলের শত আপত্তির পরও প্রস্তাব পাঠাতে লাগল, ওদিকে দলবদলে ক্লাবকে বাধ্য করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালালেন কুতিনহো। চোট ও নানা অজুহাতে ক্লাবের অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকতে শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে ত্যক্তবিরক্ত লিভারপুল সম্ভাব্য চড়া মূল্য আদায় করে ছেড়ে দিল কুতিনহোকে। সব মিলিয়ে অঙ্কটা ১৩৫ মিলিয়ন ইউরো ছুঁয়েছে। গুঞ্জন সত্যি হলে, স্বপ্নের ক্লাবে যেতে এর ১০ / ১৫ মিলিয়ন ইউরো নিজেই দিয়েছেন কুতিনহো।

‘এটা একটা স্বপ্ন, জাদুর জায়গা আমার জন্য।’ জাদুর ক্লাবের স্পর্শ পাওয়ার পরই যেন তাঁর পায়ের জাদু উবে গেল। বার্সেলোনায় এসে কখনো লিভারপুলের সে ছন্দ খুঁজে পাননি। ইংল্যান্ডে থাকতে যাকে মনে হয়েছিল, ‘বার্সেলোনার ধাঁচে গড়া!’ সেই কুতিনহো স্পেনে এসে হারিয়ে ফেললেন নিজেকে। কোচ ভালভার্দে তাঁকে নেইমার বানাতে চেষ্টা করলেন, কাজ হলো না। আবার ইনিয়েস্তার পজিশনেও ডানা মিলল না কুতিনহোর। জ্বলুনি বাড়িয়ে তাঁকে হারিয়েই সাবেক ক্লাব লিভারপুল জিতে নিল চ্যাম্পিয়নস লিগ, নিজে দুটো লা লিগা জিতলেও তাতে কুতিনহোর অবদান ছিল—এমন দাবি তুলতে পারবেন না তিনি নিজেই। ফলে কুতিনহোকে ধারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন ওঠেনি।

এই জার্সি পরে কুতিনহোর আবার মাঠে নামার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। ফাইল ছবি
এই জার্সি পরে কুতিনহোর আবার মাঠে নামার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। ফাইল ছবি

ওসমান ডেমবেলে, কুতিনহো-পর্ব শেষ করে গ্রিজমানে ভরসা রাখল বার্সেলোনা। নেইমারের শূন্যস্থান পূরণে ব্যর্থ হয়ে জার্মানি যেতে হলো কুতিনহোকে। বায়ার্ন মিউনিখের হাতে ক্লাবের সবচেয়ে ভয়ংকর এক হারের ষোলোকলাটাও সেই কুতিনহোর মাধ্যমেই পূরণ হলো। ম্যাচ শেষে যদিও বেশ কূটনৈতিক মন্তব্য করেছেন কুতিনহো, বলেছেন 'বিশ্বের সেরা দুই ক্লাবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচ ছিল। আনন্দিত হয়েই মাঠ ছাড়ছি।'

আসলেই কি আনন্দিত হয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছেন কুতিনহো? দুটি গোল করেই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করেছেন। এ দুই গোলের আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছেন, ধার শেষেও বার্সেলোনায় ফেরা হবে না তাঁর। স্বপ্নের ক্লাবের হয়ে ক্যারিয়ার মাত্র ৭৬ ম্যাচ আর দেড় মৌসুমেই থেমে যাচ্ছে। যে ভালোবাসার টানে এসেছিলেন, সে টান কি সত্যি কাল তাঁকে আনন্দ নিয়ে মাঠ ছাড়তে দিয়েছে?