ব্রাজিলের খেলায় মিলছে না সন্তুষ্টি

উল্লাসে মেতেছেন বটে। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাও কাটেনি ব্রাজিল সমর্থকদের। ছবি: রয়টার্স
উল্লাসে মেতেছেন বটে। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাও কাটেনি ব্রাজিল সমর্থকদের। ছবি: রয়টার্স

যেন দম বন্ধই হয়ে আসছিল ব্রাজিল সমর্থকদের। বুকের ওপরে যেন চেপে বসেছিল ভারী একটা পাথর। টাইব্রেকারে গঞ্জালো হারার শেষ শটটা গোলপোস্টে লাগা মাত্রই সবাই ফেললেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। মেতে উঠলেন উল্লাসে। কেউ বাজি ফোটালেন, কেউ বা মাতলেন গান-বাজনায়। কিন্তু উত্সব শেষ হতে না-হতেই সবার মনে পড়তে লাগল পরবর্তী ম্যাচগুলোর কথা। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচেই যদি এভাবে ঘেমে-নেয়ে একশা হতে হয়, তাহলে পূরণ হবে তো হেক্সা জয়ের স্বপ্ন? ভোলা যাবে তো ১৯৫০ সালের সেই দুঃসহ স্মৃতি?
বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে গোলশূন্য ড্রয়ের পরই অনেকে সংশয়ী হতে শুরু করেছেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ-ভবিষ্যত্ নিয়ে। আশায় বুক বেঁধেছেন ঠিকই। কিন্তু সবকিছুই যেন মনমতো হচ্ছে না। যেমনটা হচ্ছে না অ্যারিটন ফন্টেনেলের।
হয়তো ভাবছেন, ‘এই ভদ্রলোকটি আবার কে? জীবনে তো নামটাই শুনিনি!’ নাম না শোনাটাই স্বাভাবিক। তবে ৮৬ বছর বয়সী এই ব্রাজিল সমর্থকের কথা পাত্তা না দিলে ভুল হবে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলকে তিনি হয়তো পেলে-রোমারিওদের চেয়েও অনেক বেশি ভালো চেনেন-বোঝেন।
দেখা শুরু করেছেন ১৯৩৮ সাল থেকে। ১৯৫০ সাল থেকে সংগ্রহ করছেন বিশ্বকাপের দলিলপত্র, সংবাদপত্রের কাটিং ও স্মারকগ্রন্থ। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল নিয়ে আটটি বইও লিখেছেন এই ফুটবলপ্রেমী বৃদ্ধ। ব্রাজিলের ফুটবল অঙ্গনের প্রতিটি অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। সেলেসাওদের উত্থান-পতন সবই ঘটেছে তাঁর চোখের সামনে। সেই ফন্টেনেলে চিলির বিপক্ষে শেষ ষোলোর লড়াইটি দেখার পর বলেছেন, ‘আমি সেলেসাওদের নিয়ে চিন্তিত। বিশেষত ডানপ্রান্তটি নিয়ে। কারণ দানি আলভেজ খুব একটা ভালো করছে না। একজন সমর্থক হিসেবে, আমি বিশ্বাস করি যে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত, তাদের পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে, সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আমি তাদের দশের মধ্যে পাঁচ দেব।’

ডানপ্রান্ত ছাড়াও ব্রাজিলের মাঝমাঠের কথা চিন্তা করে কপালে ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে ফন্টেনেলের, ‘ব্রাজিল এখনো মাঝমাঠটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি। আক্রমণেও যাচ্ছে খুব কম খেলোয়াড়। নেইমারের ওপর নির্ভরশীলতাও বেশি হয়ে গেছে। ফ্রেড বা হাল্করা এখানে-সেখানে নিজের মতো খেলে যাচ্ছে।’

এ তো গেল ফুটবলবোদ্ধার বিশ্লেষণী মতামত। সাধারণ ফুটবলভক্তরাও খুশি হতে পারেননি ব্রাজিলের পারফরম্যান্সে। সাও পাওলোর এক শিক্ষক সার্জিও পাওলো বলেছেন, ‘আমি হতাশ। ব্রাজিলের কাছে আমি আরও বেশি কিছু আশা করছিলাম।’

অপেক্ষাকৃত তরুণ সমর্থকেরা অবশ্য ব্রাজিলের এই ঘামঝরানো জয় দেখেই নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। ২৩ বছর বয়সী দানিয়েল দস সান্তোস বলেছেন, ‘দ্বিতীয়ার্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে ব্রাজিল জিতবে।’

নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতে ১৯৫০ সালের সেই মারাকানা বিপর্যয়ের স্মৃতি মাটিচাপা দেওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা তো আছেই। তবে শুধু এটুকুই না, নেইমার-অস্কারদের ফুটবলীয় দক্ষতার ওপর এখন দেশের ভবিষ্যত্ রাজনীতিও অনেকখানি জড়িয়ে গেছে।

ব্রাজিলে বিশ্বকাপ শুরুই হয়েছে প্রবল বিক্ষোভ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। স্বাস্থ্য-চিকিত্সা-পরিবহনব্যবস্থা—সবকিছু অগ্রাহ্য করে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্রাজিল সরকার এই বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনে ঢেলেছে, সেটা কিছুতেই মানতে পারছেন না দেশটির সাধারণ মানুষ। কিন্তু হাজার হলেও দেশটা ফুটবল তীর্থ ব্রাজিল তো! বিশ্বকাপের উন্মাদনা আপাতত সব বিক্ষোভ-বিদ্রোহকেই দমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ব্রাজিল যদি শেষ পর্যন্ত শিরোপাটা জিততে না পারে, আগেভাগেই বাদ পড়ে যায়, তাহলে সবকিছুই আবার আগের মতোই শুরু হবে।

এটা নিছক অনুমান না। ফেলিপে স্কলারি আর তাঁর শিষ্যদের এই কথাগুলোই মনে করিয়ে দিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী দস সান্তোস, ‘তারা জিতলেই ভালো; তা না হলে সবারই আবার মনে পড়ে যাবে যে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে স্টেডিয়ামগুলো বানানো হয়েছে। আর মানুষ আবারও বিক্ষোভ শুরু করবে।’

এ তো শুধু ব্রাজিলের জন্যই না, পুরো বিশ্বকাপের জন্যই হুমকি। নেইমাররা এখন কী করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।— রয়টার্স, এএফপি