বিশ্ব মোড়লদের জবাব দেওয়ার একটা জয়

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পা রাখল বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে। ছবি: প্রথম আলো
ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পা রাখল বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে। ছবি: প্রথম আলো

‘ ২০০০ সালে টেস্ট খেলার সময় যেমন ছিল, বাংলাদেশ দল তার চেয়ে ভালো করছে না। বরং খারাপই করছে আমার মনে হয়’-গত বছর মার্চে এমন মন্তব্য করেছিলেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন। বাংলাদেশ ক্রিকেট সম্পর্কে ইংলিশদের নাকউঁচু ভাবটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বক্রোক্তিতে বাংলাদেশকে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন অনেক ইংলিশ ক্রিকেটার। একসময় বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন জিওফ বয়কট, মাইক আথারটনের মতো সাবেক ইংলিশ তারকারা।
শুধু ইংলিশরাই নয়, অস্ট্রেলীয়রাও খোঁচা মারতে ছাড়েনি বাংলাদেশকে। ‘অস্ট্রেলিয়া টেস্টে বাংলাদেশকে দুই দিনের মধ্যে হারাবে’-২০০৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন অবজ্ঞাসূচক উক্তি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রয়াত ক্রিকেটার ডেভিড হুকস। আজ সকালেও স্টার স্পোর্টসের বিশ্লেষণী আলোচনায় খোঁচা দিলেন টম মুডি। শ্রীলঙ্কার সাবেক এই অস্ট্রেলীয় কোচকে প্রশ্ন করা হলো, কোয়ার্টার ফাইনালে কাকে চাইবে ভারত? বেশ ‘মুড’ দেখিয়ে মুডি বললেন, ‘ভারত বাংলাদেশকেই চাইবে। কারণ, ইংল্যান্ড ভারতীয়দের জন্য কঠিন প্রতিপক্ষই হবে। ’ এরপর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘আসলে বাংলাদেশ এখনো শ্রীলঙ্কা হয়ে উঠতে পারেনি। ’
নানা সময়ে প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের অনেক বিশ্লেষকও বাঁকা মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে। বাংলাদেশকে নিয়ে সমালোচনা করা তো পাকিস্তানি ধারাভাষ্যকর রমিজ রাজার কাছে ‘অভ্যাসে’ পরিণত হয়েছে! কেবল বিশ্লেষক? বিশ্বমোড়লদের আমন্ত্রণের তালিকাতেও অনেক পেছনে। আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না, এমন অজুহাতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে বাংলাদেশকে সিরিজ খেলতে ডাকা হয় না দিনের পর দিন। আইসিসির ভাবনাতেও কি বাংলাদেশ গুরুত্ব পায়? আগামী বিশ্বকাপে ‘ছোট’দের ছেঁটে ফেলার পরিকল্পনাতে কি বাংলাদেশও থাকে না?
বারবার বিশ্ব মোড়লদের এমনই অবজ্ঞার শিকার বাংলাদেশ। আজ অ্যাডিলেডে সব অবজ্ঞার দুর্দান্ত জবাব দিল মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। ক্রিকেটের আবিষ্কর্তা ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের নকআউট পর্বে জায়গা করে নিল। হুট করেই নয়, শেষ আটে জায়গা পেতে অসাধারণ পারফরম্যান্সই করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ক্যানবেরায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানের জয়ের পর এমসিজিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারলেও সেটা মোটেও অসহায় আত্মসমর্পণ ছিল না। এরপর নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৯ রানের পাহাড়-লক্ষ্য বাংলাদেশ পেরোল অনায়াসে। আর আজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে...সে তো ইতিহাস!
গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়েকে ধবলধোলাইয়ের সুখস্মৃতি নিয়ে বিশ্বকাপ-মিশন শুরু করেছিল মাশরাফির দল। প্রস্তুতি ম্যাচ হারলেও মাশরাফি নিজেদের চেনালেন মূল মঞ্চেই। শ্রীলঙ্কা বাদে প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। বরাবরই স্পিনে শক্তিশালী বাংলাদেশের জন্য অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ ছিল অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু স্পিনে নয়, পেসারদের নিয়ে সে পরীক্ষায় আপাতত সফল মাশরাফির দল।
শুধু বিশ্বকাপ কেন? সর্বশেষ দশ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান দেখুন, জিতেছে আটটিতেই, হার মাত্র একটিতে। অথচ অন্য অনেক দলের পরিসংখ্যান এত ভালো নয়। ইংল্যান্ড সর্বশেষ নয় ওয়ানডের হেরেছে সাতটিতে। কেবল ইংল্যান্ড নয়, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ নয় ওয়ানডের রেকর্ডও ভালো নয়। পাকিস্তান হেরেছে ছয়টিতে আর শ্রীলঙ্কা পাঁচটিতে। ভারত সমান সংখ্যক ম্যাচে হেরেছে তিনটিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমান সংখ্যক ম্যাচে হেরেছে ছয়টিতে। জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যান তো আর বলবে না, প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ছিল নাকি দুর্বল। তবে দুই অক্ষরের ওই ‘জয়’ শব্দটাই আমূল পরিবর্তন এনে দেয় একটা দলকে। যেমনটা এ বিশ্বকাপে দিয়েছে ভারতকে আর সর্বশেষ বাংলাদেশকে।
আজ মুডি যে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টানলেন, তিনি কি জানেন না লঙ্কানদের ক্রিকেট অবকাঠামো বহু আগ থেকেই তৈরি ছিল। অর্জুনা রানাতুঙ্গা থেকে আজকের সাঙ্গাকারারা সেটিকে কেবল এগিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে মাত্র গত দুই দশকে এ ভিতটা তৈরি করে নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। অনভিজ্ঞতা আর ক্রিকেটীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে মধ্যেও ক্রিকেট যত দূর এগিয়েছে সেটি কি খুব খারাপ বলা যায়?
আজ ম্যাচ শেষে রমিজ-মুডিদের দীর্ঘক্ষণ বাংলাদেশ নিয়ে প্রশংসায় সপ্তমুখ থাকতে হলো। মাশরাফিদের জয়টা বোধ হয় এখানেও!