আসল গল্পটা বললেন লিপু

গাজী আশরাফ হোসেন
গাজী আশরাফ হোসেন

পাকিস্তানের বিপক্ষে সব পাওয়ার এই সিরিজ খুব করেই সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ২৯ বছর আগে। ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই যে দুরু দুরু বুকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরুটা করেছিল বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে অনুষ্ঠিত সেই এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সামনে ছিল ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তারকাখচিত পাকিস্তান। ইমরানের পাশাপাশি জাভেদ মিয়াঁদাদ, মহসীন খান, আবদুল কাদির, মুদাসসর নজর, ওয়াসিম আকরাম, রমিজ রাজাদের পাকিস্তানের সামনে অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ কিন্তু একেবারে খারাপ করেনি। নির্ধারিত ৪৫ ওভারে ৯৪ রানে থামলেও পাকিস্তানের ৩টি উইকেট ফেলে দিয়ে সবার বাহবাই কুড়িয়েছিল সেদিনের ব্যাঘ্র-শাবকেরা।
আজ ২৯ বছর পর এই পাকিস্তানকেই টানা হারের লজ্জা দিয়েছে সেদিনের সেই শক্তিমত্তাহীন, অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেই ম্যাচটি নিয়ে বয়ে যাচ্ছে আলোচনার ঝড়। বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার গল্পও যথেষ্ট চাউর। বাংলাদেশকে হালকাভাবে নিয়ে সে ম্যাচের টস ইমরান খান বাউন্ডারির বাইরেই সেরে ফেলেছিলেন—এমন আলোচনাও সবার মুখে মুখে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব প্রচারণাকে যথেষ্ট অতিরঞ্জিত বলেই মন্তব্য করেছেন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। সেদিন ইমরান খানের সঙ্গে টস করতে নামা লিপু জানিয়েছেন, ‘টসের গল্পটা মোটামুটি সত্যি। ইমরান খান আমাকে বাউন্ডারির বাইরেই টস করতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে এতে তাঁর বাংলাদেশকে ছোট করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা, সেটা বলতে পারব না। তবে এটা ঠিক, ইমরানের সেই প্রস্তাবে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম।’
লিপু অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা গল্পটির বেশির ভাগ অংশই নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ব্যাট হাতে সেদিন খুব বাজে খেলেছিলাম। উইকেটে ছিলাম কয়েক মিনিট। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো ব্যাপার পাকিস্তানিদের মধ্যে দেখিনি। তবে জাভেদ মিয়াঁদাদ কিছু স্লেজিং করেছিল। জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা তাঁর ইনিংসে আবদুল কাদিরের কয়েকটি বল ডিফেন্স করার পর মিয়াঁদাদ নাকি বলেছিলেন, “এমনিতেই কাদিরের বলে আউট হবা, ওমনিতেও হবা টুকটাক না করে শট খেলেই আউট হও। ” বাদশা ভাই পরে মিয়াঁদাদের এই উক্তির কথা আমাকে বলেছিলেন।’
২৯ বছর আগের সেই স্মৃতি লিপু কোনো দিনই ভুলতে পারেন না। তিনি বলেন, আমরা ছিলাম একেবারেই অনভিজ্ঞ দল। ঢাকার ক্রিকেটে তখন খুব জোরে বল করার ফাস্ট বোলার ছিল না। আমরা বেশির ভাগই চেস্ট গার্ড ছাড়া খেলতাম। মনে আছে কলম্বো পৌঁছেই ইমরান খান, ওয়াসিম আকরামদের কথা চিন্তা করে আমরা চেস্ট গার্ড কিনেছিলাম। তবে সেই ম্যাচে অবিস্মরণীয় স্মৃতি বাদশা ভাইয়ের সাহস। ইমরান খানের সামনে তিনি হেলমেট ছাড়া ব্যাটিং করেছিলেন। পাকিস্তানি কয়েকজন খেলোয়াড় বাদশা ভাইকে হেলমেট পড়ার কথা বললেও তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। অসম্ভব সাহসী ক্রিকেটার ছিলেন আমাদের বাদশা ভাই।’
পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মিশনের সেই স্মৃতি চির জাগরুক বলেই ‘বাংলাওয়াশে’ লিপুর আনন্দটা একটু অন্যরকম। সিরিজ জয়ের মুহূর্তটি ব্যবসায়িক কারণে মাঠে বসে উপভোগ করতে পারেননি বলেও আফসোস তাঁর, ‘ব্যবসায়িক কারণে আমি চীনে ছিলাম ওই মুহূর্তটিতে। ওখানে বসে ছটফট করেছি। ওয়েবসাইটে চোখ রেখে যখন দেখেছি বাংলাদেশ জিতেই যাচ্ছে, তখন ২৯ বছর আগের কথা ভেবেই আবেগী হয়েছি। চোখের কোণে জল জমেছে। গর্বে বুকটা ফুলে গেছে। একদিন আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু করেছিলাম। তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাশরাফিরা সেই শুরুকে একটা পর্যায়ে নিয়ে এলো। এই আনন্দ, এই গর্ব তুলনাহীন।’
ক্রিকেটের স্বর্ণ সময় যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে। তবে লিপু একটু সাবধানতা অবলম্বনেরই পক্ষে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা জিতছি ঠিকই। কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ধারাবাহিক হতে হবে। জেতাটা অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। খেলোয়াড়েরা নতুন দিনের শুরুটা মাঠে করে দিয়ে এসেছে। এখন সংগঠকদের পালা। বিভিন্ন নতুন নতুন আইডিয়া আর সুন্দর ব্যবস্থাপনা দিয়ে সংগঠকদেরই এখন ক্রিকেটটা এগিয়ে নিতে হবে। দেশকে পরিণত করতে হবে বিশ্বের অন্যতম বড় ক্রিকেট শক্তি হিসেবে।’
খুলনা টেস্টের পর রমিজ রাজার মন্তব্যে কিছুটা বিরক্তিই ঝরেছে গাজী আশরাফ হোসেনের কণ্ঠে। কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট পরিশীলিত। তিনি বলেছেন, ‘রমিজ রাজা খুব বড় ধারাভাষ্যকার। ক্রিকেটার হিসেবেও তিনি নামকরা। নিজেদের প্রেক্ষাপটে যেকোনো মন্তব্য তিনি করতেই পারেন। কিন্তু ভালো খেলার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই তাঁর কৃতিত্ব দেওয়া উচিত ছিল। তাঁর তো জানা উচিত যে এই বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ এক নয়। নতুন দিনের বাংলাদেশ অনেক বেশি আগ্রাসী ক্রিকেট খেলে। পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার অধিকার বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাই অর্জন করেছে নিজেদের সাফল্য দিয়ে। এই অধিকার অন্য কেউ সাকিবদের দেয়নি।’