বিপিএল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও

বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ
বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ

বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন উৎকণ্ঠাভরে আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) প্রতিবেদনের অপেক্ষায়। কী থাকবে ওই প্রতিবেদনে? ২০১৩ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) কি আসলেই ম্যাচ পাতানোর ঘটনা ঘটেছে? ভারতে আইপিএলের ম্যাচে শ্রীশান্ত ও আরও দুই ক্রিকেটারকে দিল্লি পুলিশ হাতেনাতে ধরে ফেলার পর প্রশ্নটা শুধু ম্যাচ পাতানোতে সীমাবদ্ধ নেই। যোগ হয়েছে আরেকটি প্রশ্ন—বিপিএলেও কি কোনো ক্রিকেটার জড়িত ছিলেন স্পট ফিক্সিংয়ে? তদন্ত প্রতিবেদন কবে পাওয়া যাবে, এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। যদিও বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান গত মঙ্গলবার বলেছেন, তিন দিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে সেটি পেয়ে যাওয়ার কথা। আরেকটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, জুনের মাঝামাঝির আগে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।শেষ পর্যন্ত যখনই তা পাওয়া যাক, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সেটি টালমাটাল করে দিতে বাধ্য। কারণ, আকসুর তদন্তে বিপিএল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।বিপিএলে ফিক্সিংয়ের তদন্ত করতে আকসুর তিন সদস্য গত দুই মাসে একাধিকবার বাংলাদেশে এসে সন্দেহভাজন অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছেন। আইসিসির এক আইনজীবীকে সঙ্গে করে সর্বশেষ আসেন ১৯ মে। ঢাকা ছাড়েন ২৪ মে। তিনবারের সফরে আকসুর তদন্তকারীরা অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। যাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের খেলোয়াড় মোহাম্মদ আশরাফুল, মোশাররফ হোসেন (রুবেল) ও মাহবুবুল আলম (রবিন) এবং চিটাগং কিংসের কোচ খালেদ মাহমুদ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী এবং বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আফজালুর রহমান সিনহা ও সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিকের জবানবন্দিও নেওয়া হয়। আইসিসির অনুরোধে র‌্যাবও এখানে সংশ্লিষ্ট ছিল। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন, ‘আইসিসির অনুরোধে এ ঘটনা তদন্তে র‌্যাব সহায়তা দিয়েছে।’২৪ মে ঢাকা ছাড়ার আগে টানা তিন দিন মোহাম্মদ আশরাফুলকে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের যে ম্যাচগুলো সন্দেহের তালিকায়, সেই তিনটি ম্যাচেই অধিনায়ক ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। এর মধ্যে পরের দুটি ম্যাচে নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা শ্রীলঙ্কা সফরে তাঁকে পাওয়ার আশায় বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ীই খেলেননি। গত ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে চিটাগং কিংসের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ আগে রহস্যজনকভাবে মাশরাফিকে ‘আনফিট’ ঘোষণা করে আশরাফুলকে নেতৃত্ব দেওয়া হয়। সেই ম্যাচটিতে অ-টি-টোয়েন্টিসুলভ ব্যাটিং করে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস হেরে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে এটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত ম্যাচ রিপোর্টেও গ্ল্যাডিয়েটরসের পরাজয়ের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। পরের দিন আরও খোঁজখবর নিয়ে ছাপা হয়েছিল আরেকটি প্রতিবেদন। যেটির শিরোনাম ছিল, ‘চিত্রনাট্যের ম্যাচ বলেই মাশরাফি বাদ!’মূলত এই ম্যাচটিই ছিল আকসুর আতশি কাচের নিচে। কিন্তু সেটি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে। নির্ভরযোগ্য বেশ কিছু সূত্র থেকে প্রথম আলো জানতে পেরেছে, ওই ম্যাচটি যে পাতানো ছিল, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে আকসু। মোহাম্মদ আশরাফুল নিজেই সেটি স্বীকার করে এসেছেন বলে এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে আকসু আশরাফুলকে কোনো মন্তব্য করতে নিষেধ করে যাওয়ায় তিনি সেই খবর সত্য না মিথ্যা, এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। তবে ক্রিকেটাঙ্গনে এ নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে।তবে নানা সূত্র থেকে খবর পেয়ে গত কয়েক দিন প্রথম আলোর অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আকসুর কাছে মোহাম্মদ আশরাফুল শুধু বিপিএলে ম্যাচ পাতানোতে জড়িত থাকার কথা স্বীকারই করেননি, সেটি যে তাঁর একার ‘কম্মো’ নয়, সেটিও সবিস্তারে জানিয়ে দিয়েছেন। সবকিছু যে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক সেলিম চৌধুরী ও তাঁর ছেলে শিহাব চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ীই হয়েছে, এটা তো জানিয়েছেনই; তাঁর কথায় বেরিয়ে এসেছে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত আরও বেশ কজন খেলোয়াড়ের নামও। শুধু বাংলাদেশেরই নন, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের একাধিক শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়ও আছেন এর মধ্যে। নাম এসেছে অন্য দলের কয়েকজন বিদেশি খেলোয়াড়েরও। গতকাল সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এই অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। গত শুক্রবার প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘ক্রিকেটে আমরা শিশু, মাত্র দুই বছর হলো এসেছি। এখনো ক্রিকেটের “সি”ও শিখিনি, এত বড় কাজ কীভাবে করব!’ তাঁর এই প্রতিক্রিয়া পরদিন প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে।সেলিম চৌধুরী যা-ই বলুন না কেন, আশরাফুলের জবানবন্দিতে ফিক্সিংয়ের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ক্রিকেটে ফিক্সিং অনেক দিনই শুধু ম্যাচ হারা-জেতায় সীমাবদ্ধ নেই। বুকিদের আগ্রহের বড় একটা জায়গা এখন স্পট ফিক্সিং। সালমান বাট-মোহাম্মদ আসিফ-মোহাম্মদ আমিরের ঘটনা যেটির সঙ্গে ক্রিকেট অনুসারীদের ভালোমতোই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ দিয়েছে আইপিএলে শ্রীশান্তদের কাণ্ড। বিপিএলেও স্পট ফিক্সিংয়ের বেশ কটি ঘটনা আশরাফুল আকসুকে জানিয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

কেঁচো খুঁড়তে যে ‘সাপ’ বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে, তা এসব নয়। সেই ‘সাপ’ এমনই বিষধর যে, বিপিএল কেলেঙ্কারিকে এর তুলনায় ‘শিশুতোষ’ বলে মনে হবে সবার কাছে। এই লাইনটা পড়ার আগে বড়সড় একটা ধাক্কা খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নেওয়া ভালো—আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ফিক্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। যেটিতে তাঁর সংশ্লিষ্টতার ইতিহাস জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় বড় কিছু নামও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। যাঁদের দুজন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক, অন্যজনও বাংলাদেশের ক্রিকেটের মানদণ্ডে কিংবদন্তিতুল্য। প্রথম দুজনের নাম খালেদ মাহমুদ ও খালেদ মাসুদ। অন্যজন মোহাম্মদ রফিক।

বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন বড় একটা ভূমিকম্পের সামনেই দাঁড়িয়ে।