একটি পতাকা ওড়ানোর আবেগময় গল্প

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ফাইল ছবি
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ফাইল ছবি

ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে, চারবার করে জিতেছে জার্মানি ও ইতালি, বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, স্পেন, ফ্রান্স ও ইতালি। কিন্তু একটি দিক দিয়ে বাংলাদেশ এই দলগুলোর অর্জনকেও ছাপিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ফুটবলাররা যে মাঠে ফুটবল নিয়ে নেমেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য!

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেন ছিল আলাদা একটা ব্রিগেডই। অস্ত্র নয়, ফুটবলকেই তাঁরা বানিয়েছিলেন দেশ মাতৃকার মুক্তির অস্ত্র। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছিলেন তাঁরা, অথচ বাংলাদেশ তখনো ‘দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতিই পায়নি।
১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই। এ দেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল এক দিন। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীতের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ফুটবলাররা সেদিন পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ই রচনা করেছিলেন। যে দলটি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নামের আলাদা একটি পরিচয় নিয়ে মহিমান্বিত হয়ে আছে ইতিহাসে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠিত হয়েছিল সে সময়ে দেশসেরা সব তারকা ফুটবলারকে নিয়েই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোটা সময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে এই দল গঠন করেছিল তহবিল। যে তহবিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেখেছিল বড় ভূমিকা। সবচেয়ে বড় কথা, এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে, কিন্তু এমন আবেগময় ঘটনা আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেই ফুটবল ‘বীর’দের নেতৃত্বে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। সহ অধিনায়ক ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা। নওশের, কায়কোবাদ, নূরনবী, আশরাফ, এনায়েত, লালু, আইনুল, কাজী সালাউদ্দিনসহ ৩১ জন ফুটবলার। দলটির ম্যানেজার ছিলেন তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্না। অন্যতম সংগঠক ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ আলী ইমাম।
২৪ জুলাই, ১৯৭১। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ। প্রতিপক্ষ স্থানীয় নদীয় একাদশ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শীর্ষ ফুটবলারদের নিয়ে গড়া দল তাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন জনমত গঠনের জন্য ম্যাচ খেলবে—এমন ঘোষণায় সেদিন দুপুর থেকেই স্টেডিয়াম ছিল লোকে লোকারণ্য। বিকেল পাঁচটায় ম্যাচ শুরু হওয়া কথা। কিন্তু বেশ বড় ধরনের একটা সমস্যা খেলাটিকে ফেলে দেয় অনিশ্চয়তার মধ্যে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা জানালেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়েই মাঠে খেলতে নামবেন। ভারত তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে ম্যাচটির আয়োজক নদীয়া জেলা প্রশাসন পড়ে গেল দ্বিধায়। এভাবে তখন পর্যন্ত স্বীকৃতি না-পাওয়া একটি দেশ অন্য আরেকটি দেশে জাতীয় পতাকা ওড়ালে সেটির আইনগত ঝামেলা তো আছেই।
জেলা প্রশাসক দীপক কান্তি ঘোষ যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করা। এ দিকে ম্যাচ শুরুর তাগাদা দিচ্ছে গ্যালারির হাজারো জনতা, অন্য দিকে পতাকা ওড়ানোর দাবিতে অনড় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। রাষ্ট্রীয় আচার লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে দাঁড়িয়ে জেলা প্রশাসকও। তবে দীপক নিজে বাঙালি। আর তখন বাঙালি জাতিই ছিল আবেগের তুঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা দলের খেলোয়াড়দের আবেগের কাছেই পরাজিত হলেন জেলা প্রশাসক, পরাজিত হলেন নিজের আন্তরিক আবেগের কাছেও। অনুমতি দিলেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তোলার। সেই সঙ্গে জাতীয় সংগীত বাজানোর। ভারতের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘আমার সোনার বাংলা’ আবেগে কাঁপিয়ে দিল গোটা কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামকেই। হানাদারকে আক্রমণে বিধ্বস্ত রক্তাক্ত সবুজ দেশের কথা ভেবে ফুটবলারদের চোখে জল।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেই দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু আজ ৪৫ বছর পরেও যেন আবেগমথিত। বললেন, ‘সেই অনুভূতির ব্যাপারটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। পতাকার দিকে তাকিয়ে আমি তখন কাঁদছি, আমার সতীর্থেরা কাঁদছেন। আমার আর কিছু মনে নেই। ঝাপসা চোখে কেবল দেখছি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা স্টেডিয়ামে গগনবিদারী আওয়াজ—জয় বাংলা!’