উশুময় সংসার জিয়া–শিখা দম্পতির

উশুর দম্পতি জিয়াউল হক ও শিখা খাতুনছবি: প্রথম আলো

‘সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে আসা’র স্বপ্নটা ছোটবেলা থেকেই দেখতেন শিখা খাতুন। কে জানত, রংপুরের মেয়ে শিখার সারা বেলা কাটবে সাগরের পারে!

আগে আন্তস্কুলে নিয়মিত ফুটবল, কাবাডি, ভলিবল খেলতেন শিখা। উশু শুরু করেন বাংলাদেশ আনসারে যোগ দেওয়ার পর। মার্শাল আর্টভিত্তিক খেলা উশু মূলত একপ্রকার চায়নিজ কুংফু। শিখা শুধু এই খেলাটাকেই ভালোবাসেননি, একসময় ভালোবেসে ফেলেন এই খেলার একজন মানুষকেও। যে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় বিয়েতে। ২০১৩ সালে কক্সবাজারের উশু খেলোয়াড় জিয়াউল হককে বিয়ে করার পর থেকে শিখা খাতুনের ঠিকানাও কক্সবাজার।

জিয়াউল হক ও শিখা খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

২৩ জানুয়ারি মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে শেষ হওয়া ১৭তম জাতীয় উশু চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতেছেন স্বামী–স্ত্রী দুজনই। প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব-৫২ কেজি ওজন শ্রেণির সানদা ইভেন্টে সোনা জিতেছেন শিখা। আর ছেলেদের তাউলুর একক ইভেন্টে রুপা জিয়া।

আনসারের সিনিয়র ভাই হিসেবে আমাকে উশু খেলাটা প্রথমে শেখায় জিয়া। আমি জানতাম, সে খেলাপাগল মানুষ। আমাকে কখনো খেলাধুলা করতে বাধা দেবে না। এ জন্যই তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিই।
শিখা খাতুন, উশু খেলোয়াড়

জিয়ার হাতেই উশুতে হাতেখড়ি শিখার। কক্সবাজার জেলা উশু অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিয়া সাগরপারে গড়ে তুলেছেন একাডেমি। সেই একাডেমিতে বর্তমানে ৫০ জন উশুকা নিয়মিত অনুশীলন করেন। এবারের জাতীয় প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আনসারের তিনজন ও কক্সবাজারের নয়জন খেলোয়াড় অংশ নিয়েছেন, যাঁরা সবাই জিয়ার একাডেমির। তাঁদের মধ্যে দুজন সোনা জিতেছেন, একজন রুপা ও দুজন ব্রোঞ্জ।

উশুময় সংসার এই দম্পতির। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে পাঁচ বছরের ছেলে তালহা ইবনে জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন এই দম্পতি। বিয়ের পরও খেলতে পারবেন ভেবেই জিয়ার সঙ্গে জীবনের জুটি গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিখা। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে যা বলছিলেন বাংলাদেশ আনসারের খেলোয়াড়, ‘আনসারের সিনিয়র ভাই হিসেবে আমাকে উশু খেলাটা প্রথমে শেখায় জিয়া। আমি জানতাম, সে খেলাপাগল মানুষ। আমাকে কখনো খেলাধুলা করতে বাধা দেবে না। এ জন্যই তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিই।’

দেশের দুই প্রান্তের দুটি জেলা রংপুর ও কক্সবাজার। ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে রয়েছে পার্থক্য। অথচ এই দুই জেলার দুই পরিবারের মাঝে উশু হয়ে দাঁড়িয়েছে ভালোবাসার সেতুবন্ধ। এ বিয়েতে শিখার বাবা প্রথমে রাজি ছিলেন না। জিয়া হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘প্রথমে ওদের পরিবার থেকে রাজি ছিল না। তাদের কথা, মেয়েটা হয়তো সাগরের জলে ভেসে যাবে।’ বিয়ের পর প্রথম দিকে কক্সবাজারের ভাষা বুঝতে কষ্ট হতো শিখার। তবে এখন অনেক কিছু শিখেছেন, ‘শুরুতে ওদের ভাষা বুঝতাম না। আমার ননদ একটু একটু করে শিখিয়েছেন। এখন মোটামুটি বুঝি, কে কী বলছে।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে, একসময় শুঁটকির গন্ধে বিরক্তি লাগত শিখার। অথচ খাবারের মেনুতে এখন পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে থাকে শুঁটকি। 

দুজনই চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেন আনসারে। কিন্তু এই আয়ে সংসার চলে না। বাড়তি আয়ের জন্য জিয়াকে ব্যবসা করতে হয়। ওজন কমাতে গত দুই মাস একটুও ভাত খাননি শিখা। এ জন্য শিখার জন্য বিকল্প পুষ্টিকর খাবারের খরচ জোগাতে হয়েছে জিয়াকে।

জিয়ার কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা শিখার। যা প্রকাশ করার সময় একটু আবেগই ছুঁয়ে যায় তাঁকে, ‘ও আমাকে খেলাধুলার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করে। আমি অনুশীলনে থাকলে ছেলেকে সামলায়। আমার যেটা করার দায়িত্ব, সেটা করে জিয়া। কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে আত্মবিশ্বাস জোগায়। এ কারণেই এতটুকু আসতে পেরেছি। না হলে অনেক আগেই থেমে যেতাম।’ 

দুজনই চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেন আনসারে। কিন্তু এই আয়ে সংসার চলে না। বাড়তি আয়ের জন্য জিয়াকে ব্যবসা করতে হয়। ওজন কমাতে গত দুই মাস একটুও ভাত খাননি শিখা। এ জন্য শিখার জন্য বিকল্প পুষ্টিকর খাবারের খরচ জোগাতে হয়েছে জিয়াকে, ‘উশু খেলতে ভালো ফিটনেস দরকার, এ জন্য অনেক খাবার লাগে। এ জন্য অনেক বাড়তি খরচ হয়। তারপরও সব সময় যা প্রয়োজন, তা করতে পারি না।’

উশুতে অনেক অর্জন জিয়া ও শিখার
ছবি: প্রথম আলো

উশুতে শিখার আরও বড় কিছু অর্জনের সম্ভাবনা দেখেন তিনি, ‘ওর শেখার খুব আগ্রহ। অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রমও করে। শিখার যা পারফরম্যান্স, তাতে ও ভারত, নেপালের খেলোয়াড়দেরও হারিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।’

২০১৯ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ এসএ গেমসে উশুতে ৩টি রুপা ও ১১টি ব্রোঞ্জ জিতেছিল বাংলাদেশ। আগামী এসএ গেমসে উশুতে সোনার পদক জিততে চান এই দম্পতি। সেই স্বপ্নের কথা বলছিলেন জিয়া, ‘ফেডারেশন আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করে। দুলাল স্যারের (উশু ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন) তত্ত্বাবধানে নিয়মিত অনুশীলন করছি আমরা। এখন একটাই স্বপ্ন, দুজনই পদক মঞ্চে উঠব। মাথার ওপরে উড়বে বাংলাদেশের পতাকা। বাজবে জাতীয় সংগীত।’