কিংবদন্তি ব্র্যাডম্যানের খোঁজে...

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (১৯০৮–২০০১)ছবি: টুইটার

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় খেলা ক্রিকেট। আর দেশটির সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। ডাকনাম ‘ডন’। আজ তাঁর জন্মদিন। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এসে দুটি বিষয় আগ্রহ নিয়ে জানা ও দেখার চেষ্টা করেছি। এক. ক্যাঙারু, দুই. ক্রিকেট।

উলানগ্যাবায় অস্ট্রেলিয়ার দুর্গ হিসেবে পরিচিত দ্য গ্যাবা স্টেডিয়াম দেখেছি, যেখানে ভাস্কর্য আছে আরেক অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি অ্যালান বর্ডারের (এবি নামে পরিচিত)। তবে ব্রিসবেন শহরে আমি ক্যাঙারুর দেখা পাইনি। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম ক্যাঙারু দেখি ব্রিজবেন থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের ক্যারোলে পার্ক এলাকায়। ক্যারোলে পার্ক ঘন বনাঞ্চল। এখানে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। উঁচুনিচু ঘন গাছপালার এ এলাকায় আছে অন্তত ১০টি গলফ কোর্স। এই গলফ কোর্সেই দেখা পাই ক্যাঙারুর।

দল ধরে, নিশ্চিন্তে চলছিল ক্যাঙারুর দল। ক্যাঙারুর দর্শন পাওয়ার পর অনুসন্ধিৎসু চোখ খুঁজে ফিরছিল ডন ব্র্যাডম্যানকে। ভাবছিলাম হয়তো কোনো রাস্তার মোড়ে হঠাৎ দেখা মিলবে ব্র্যাডম্যানের। চোখে পড়বে কোনো আবক্ষ ভাস্কর্য। না, তা হয়নি।

তবে ব্র্যাডম্যানের দেখা ঠিকই পেয়েছি। সেটা কুইন্সল্যান্ড আর্ট গ্যালারিতে। ব্রিসবেনের একটি বিখ্যাত জায়গা হলো কালচারাল সেন্টার। এই সেন্টারের কুইন্সল্যান্ড আর্ট গ্যালারিতে দেখা পাই ডন ব্র্যাডম্যানের। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আদিবাসীদের প্রভাব ব্যাপক।

এই দেশের ইতিহাসে আদিবাসীদের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কুইন্সল্যান্ড আর্ট সেন্টারের প্রথম তলায় রয়েছে আদিবাসীদের নিয়ে চিত্রকর্ম। এখানেই স্থান পেয়েছে শিল্পী রন হারলির তৈলচিত্র ‘ব্র্যাডম্যান বোল্ড গিলবার্ট ১৯৮৯’, যেখানে দেখা যায় ডন ব্র্যাডম্যান একটি বল ড্রাইভ করছেন। আর অপর পাশে যিশুর মতো ক্রুশবিদ্ধ একজন আদিবাসী। ব্র্যাডম্যানের খেলা বলটি রক্তের রঙের রেখায় চলে গেছে ওই আদিবাসীর ডান হাতের কাছে। যত দূর জানা যায়, এই আদিবাসীর নাম এডি গিলবার্ট।

আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ ও ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান
ছবি: লেখক

কুইন্সল্যান্ডের এই আদিবাসী ক্রিকেটার ১৯৩১ সালের নভেম্বর মাসে একটি ম্যাচে বল করেছিলেন ডন ব্র্যাডম্যানকে। এডি গিলবার্ট ছিলেন শারীরিকভাবে খুবই শক্তিশালী। খুব জোরে বল করতে পারতেন। ওই ম্যাচে তিনি ব্র্যাডম্যানকে ৫টি বল করেছিলেন। পরে ব্র্যাডম্যান তাঁর আত্মজীবনী ‘ব্র্যাডম্যান বোল্ড গিলবার্ট ১৯৮৯’–তে স্বীকার করেছেন, এডি গিলবার্ট সত্যিই খুব জোরে বল করেছিলেন। তাঁর বোলিংকে বজ্রপাতের সঙ্গে তুলনা করেন। বলেছিলেন, গিলবার্টই ছিলেন তাঁর দেখা সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো গিলবার্টের আর ক্রিকেট খেলা হয়নি। ডন ব্র্যাডম্যানের দল নিউ সাউথ ওয়েলস তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ অ্যাকশনের অভিযোগ তোলে। এমনকি গিলবার্টের হাতে তাঁর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্মারক হিসেবে যে সাদা ট্যাটু ছিল, তা–ও অবৈধ বলে দাবি করা হয়। আর এতেই অত্যন্ত করুণভাবে শেষ হয়ে যায় একজন প্রতিভাবান আদিবাসীর ক্রিকেট ক্যারিয়ার, যা রন হারলি ‘ব্র্যাডম্যান বোল্ড গিলবার্ট ১৯৮৯’ তৈলচিত্রে তুলে ধরেছেন।

কুইন্সল্যান্ড আর্ট গ্যালারিতে ‘ব্র্যাডম্যান বোল্ড গিলবার্ট ১৯৮৯’ ছবিটি দেখার পর ব্র্যাডম্যান সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আগ্রহ মেটাতে চলে যাই ব্রিসবেনের স্টেট লাইব্রেরিতে। সেখানে খোঁজ করি ১৯৫০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ব্র্যাডম্যানের আত্মজীবনী ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ বইটির। অবাক করা বিষয়, প্রায় ৭২ বছরের পুরোনো বইটি হাতে পেয়ে যাই মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। স্টেট লাইব্রেরির সুরম্য ভবনটির টেবিলে পিনপতন নীরবতার মধ্যে পাতা ওল্টাতে থাকি ব্র্যাডম্যানের আত্মজীবনীর।

শিল্পী রন হারলির তৈলচিত্র ‘ব্র্যাডম্যান বোল্ড গিলবার্ট ১৯৮৯’
ছবি: লেখক

৩১৬ পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে এক বর্ণাঢ্য জীবনের জীবন্ত বর্ণনা। ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেট জীবনের শুরুর ঘটনা, বডিলাইন বোলিং, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের ক্রিকেটার, ইংল্যান্ডে বিভিন্ন সিরিজ, অধিনায়কের দায়িত্ব, এমনকি খেলা পরিচালনাকারী আম্পায়ারদের সম্পর্কেও বিস্তারিত লিখেছেন কিংবদন্তি। পুরো আলোচনার মধ্যে কয়েকটি বিষয় বিস্ময় জাগায়, যার অন্যতম ছিল কীভাবে তৈরি হলেন একজন ডন ব্র্যাডম্যান। কীভাবে তিনি ব্যাটিংয়ের অবিশ্বাস্য সামর্থ্য অর্জন করলেন, এ বিষয়ের একটি বর্ণনা তিনি দিয়েছেন ‘ইন দ্য বিগিনিং’ চ্যাপ্টারে।

ডন ব্র্যাডম্যানের বর্ণনা অনুযায়ী, তিন বছর বয়সে তাঁদের পরিবার সিডনি থেকে ৮০ মাইল দূরের একটি শহর বাউরালে চলে আসে। এই শহরের বাউরাল ইন্টারন্যাশনাল হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক খেলাধুলা–অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাতেন। তবে স্কুলে কোনো কোচ ছিল না। স্কুলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সুযোগ থাকলেও সপ্তাহান্তে ব্র্যাডম্যানের কোনো কাজ থাকত না। কারণ, ওই দুই দিনের ছুটিতে কাউকে পাওয়া যেত না। তাঁর স্কুলের বন্ধুরা থাকত অনেক দূরে। তাই সময় কাটাতে তিনি একটি উপায় বের করেন।

ব্র্যাডম্যানদের বাড়ির সামনে ইটের তৈরি ৮০০ গ্যালনের একটি পানির ট্যাংক ছিল। এই ট্যাংকের নিচে ছিল ৭ ফুটের একটা কংক্রিটের পাটাতন। এই পাটাতন বা রাস্তার ওপর চলত তাঁর ক্রিকেট খেলা। যেখানে বল হিসেবে তিনি ব্যবহার করতেন গলফ বল, আর ব্যাট হিসেবে থাকত ক্রিকেট স্ট্যাম্প। প্রথমে বলটিকে একটি ড্রপ দিয়ে তাতে আঘাত করতেন তারপর বলটি পানির ট্যাংকের গায়ে লেগে আরও দ্রুতগতিতে ফিরে আসত, তখন তাতে আবার আঘাত করতেন স্ট্যাম্প দিয়ে। এভাবেই ডন ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেটে হাতেখড়ি। স্কুলজীবনে ব্র্যাডম্যান প্রথম ম্যাচ খেলেছিলেন স্থানীয় মিটটাগংগ স্কুলের বিরুদ্ধে। ওই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন। পরের ম্যাচেও ভালো স্কোর ছিল। দুই ম্যাচেই অপরাজিত ছিলেন ব্র্যাডম্যান।

এর পরের গল্প সবার জানা। তবে বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার পথে শুরুর যাত্রাটা খুব একটা শুভ ছিল না। ব্র্যাডম্যানের টেস্ট অভিষেক হয় ১৯২৮ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্রিসবেন টেস্টে। যে ম্যাচে ৬ ও ৭ নম্বরে ব্যাট করেন। দুই ইনিংসে রান ১৮ ও ১। দল পরাজিত হয় রেকর্ড ৬৭৫ রানে। যদিও পরের ম্যাচেই ঘুরে দাঁড়ান। মেলবোর্ন টেস্টে করেন ৭৯ ও ১১২। এরপর রানের বন্যা বইয়েছেন। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি! মাত্র ৫২ টেস্টের ক্যারিয়ারে করেছেন ৬৯৯৬ রান। গড় ৯৯.৯৪।

ডন ব্র্যাডম্যান ১৯২৮ সালে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ১৯৪৮ সালে। শেষ টেস্ট খেলেন তাঁর প্রিয় ওভাল মাঠে। ইংল্যান্ডের এই মাঠে তিনি অনেক রান করেছেন। অনেকেই এই মাঠকে ‘ব্র্যাডম্যানের ওভাল’ বলে থাকেন। ওভালের শেষ ম্যাচে একটি ইনিংস খেলার সুযোগ পান ব্র্যাডম্যান। কারণ, প্রথম ইনিংসে মাত্র ৫২ রানে অলআউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।

তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২ বল খেলেন। স্পিনার এরিক হলিসের গুগলিতে শূন্য রানে সরাসরি বোল্ড হন। ইতি ঘটে তাঁর হীরক উজ্জ্বল ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। অথচ এই ইনিংসে মাত্র ৪ রান করতে পারলেই টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটিং গড় হতো ১০০। ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ বইয়ে ওভালে শেষ ইনিংসের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন ব্র্যাডম্যান, যেখানে ম্যাচ শেষে দর্শকদের অভিবাদন নিয়ে বলতে কার্পণ্য করেননি অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি।

৪৪টি ছোট অধ্যায়ে বিভক্ত এ বই প্রত্যেক ক্রীড়া অনুরাগী ও ক্রীড়াসাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে মনে হয়েছে। এ বইয়ের প্রতিটি পাতায় রয়েছে একজন ক্রিকেট কিংবদন্তির জীবনের অসামান্য গল্প। ব্রিসবেনের স্টেট লাইব্রেরির তিনতলার কক্ষে বসে সে গল্পের স্বাদ আস্বাদন করেছিলাম। এই মহিমান্বিত মহাজীবনের গল্পের স্বাদ নেওয়ার আমন্ত্রণ সবাইকে।

(লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিসবেনে অবস্থানরত)