অস্ট্রেলিয়া জেতে, কারণ তারা বিশ্বাস করে...

ম্যাচ জয়ের পর অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাসছবি: এএফপি

‘যদি দলের ৯ জন খেলোয়াড়ও বিশ্বাস করেন যে আমাদের পক্ষে জেতা সম্ভব, তবু কিছুই হবে না। দলের ১১ জন খেলোয়াড়কেই বিশ্বাস করতে হবে আমাদের জেতা সম্ভব, তবেই সব সম্ভব।’

কথাগুলো সাকিব আল হাসানের। বলেছিলেন সেই ২০১১ বিশ্বকাপের আগে আগে। লাইনগুলো হঠাৎ করেই আলোচনায় এল জনপ্রিয় স্যাটায়ারধর্মী ওয়েবসাইট ‘ইয়ার্কি’র সৌজন্যে। আলোচনায় না এলেও ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হতো না, কথাগুলোর সত্যতা বুঝতে চাইলে ২৫ মার্চে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে চোখ রাখলেই চলত!

মগজে পুরোপুরি গেঁথে নিতে প্রেক্ষাপটটাও একটু করে জানা থাকা উচিত অবশ্য। ম্যাচের তখনো ১২০ ওভার মতো বাকি, অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট হারিয়েছে মাত্র তিনটি। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক প্যাট কামিন্সকে টিভি-ক্যামেরার লেন্স খুঁজে নিচ্ছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরেই, তবে ৩৫১ রানের লিডটা আরও একটু বাড়াবেন বলেই অনুমান বেশির ভাগের। কিন্তু কামিন্স দুই অপরাজিত ব্যাটারকে ডেকে পাঠালেন ওই রানেই। তখন থেকেই ফিসফাস, জয়ের নেশায় অস্ট্রেলিয়া না সিরিজই হেরে বসে পরে। ফিসফাসের কারণ, সিরিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা তেমনই অশনিসংকেত দিচ্ছিল।

সিরিজ জয়ের ট্রফি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া দলের উচ্ছ্বাস
ছবি: এএফপি

গোটা সিরিজটাই খেলা হয়েছে ব্যাটিং-স্বর্গে, প্রথম টেস্টের ভেন্যু রাওয়ালপিন্ডির ভাগ্যে জুটেছিল ডিমেরিট পয়েন্টও। লাহোরের পিচের চরিত্র বদলের আশায় অস্ট্রেলিয়া থেকে কিউরেটর আনিয়েছিল পিসিবি, কিন্তু ওই আনা পর্যন্তই। এই উইকেটেও বাউন্স মেলেনি একদমই, দেখা যায়নি ভাঙনের কোনো লক্ষণ, ম্যাচের চতুর্থ দিনেও ওভারপ্রতি প্রায় ৪ করে রান তুলেছে অস্ট্রেলিয়া। ফক্স ক্রিকেটের স্টুডিওতে বসে পিচ নিয়ে হতাশা লুকিয়ে রাখতে পারেননি মার্ক ওয়াহও, ‘এটা কোনো উইকেট হলো, ছ্যাহ! কোনো বল কোমরের ওপরে উঠছে না...’

সেই উইকেটে ওভারপ্রতি তিনের কম রান টার্গেট দেওয়া তো বিরাট ফাটকাই। সংশয়বাদীর সংখ্যা আরও বাড়ল চতুর্থ দিন খেলা শেষ হতে হতে। ওই দিন শেষ বিকেলে যে ২৭ ওভার ব্যাট করল পাকিস্তান, তাতে বিনা উইকেটে তুলে ফেলেছিল ৭৩ রান, অর্থাৎ শেষ দিনে জয়ের জন্য ২৭৮ রানের বেশি লাগছে না তাদের।

প্রাসঙ্গিকভাবে, জানিয়ে রাখা ভালো, রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেস্টে শেষ দিনে উঠেছিল ২৬২ রান (ড্র নিশ্চিত জেনে খেলা শেষ হয়েছিল নির্ধারিত সময়েরও এক ঘণ্টা আগেই), করাচিতে সংখ্যাটা ২৫১। আগের দুই টেস্ট মিলিয়েও উইকেট খোয়া গিয়েছিল মাত্র আটটি। এসব পরিসংখ্যান আর তথ্য-উপাত্ত মাথায় রাখলে ওই লোকদের মোটেই দোষ দেওয়া যায় না, যাঁরা পাকিস্তানের জয়টাকেই দেখছিলেন এই সিরিজের সবচেয়ে সম্ভাব্য ফল।

পাকিস্তানের আরও একটি উইকেটের পতন। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপন
ছবি: এএফপি

দেখবেন নাই–বা কেন? পঞ্চম দিনের উইকেটে মূল ট্রাম্পকার্ড কে? স্পিনার তো! তা এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার দুই স্পিনার নাথান লায়ন আর মিচেল সোয়েপসনের পারফরম্যান্স কী? সোয়েপসনের অভিষেক হলো এই সিরিজ দিয়েই। বোলিংয়ের গ্রিপ, রানআপ থেকে শুরু করে বল ছোড়ার ভঙি, পুরোটাই যেন শেন ওয়ার্নের কার্বন কপি। অভিষেকটাও অনুসরণ করল ওয়ার্নকেই, ৩ ইনিংস মিলিয়ে ৯০ ওভারের বেশি হাত ঘুরিয়ে উইকেট পেলেন ২টি, ঘনঘন হাফ ট্র্যাকার আর ফুল-টসে পাকিস্তানের রান তোলার গতিও বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন বোলিংয়ে এসে।

তাঁর করে যাওয়া ক্ষতিটা পুষিয়ে দেওয়ার কথা ছিল লায়নের, কিন্তু লায়ন নিজেই নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন বেশ কদিন ধরে। ২০২১ সালের গোড়া থেকে হিসাব করলে, এ ম্যাচের আগপর্যন্ত চতুর্থ ইনিংসে বল করেছেন যে সাত ম্যাচে, সেখানে সংগ্রহ সাকল্যে ১২ উইকেট। সবচেয়ে ভালো বোলিং বিশ্লেষণটা এ সিরিজের আগের ম্যাচেই, তবে পাকিস্তানের চার ব্যাটারকে ফেরাতে করাচিতে তাঁকে বল করতে হয়েছিল ৫৫ ওভার! এ টেস্টেও যদি ৫৫ ওভার করতে হতো লায়নকে, মানে দাঁড়াত একটাই, অস্ট্রেলিয়ার তিলকে নিশ্চিত সিরিজ পরাজয়।

লাহোর টেস্ট জয়ের সঙ্গে সিরিজও জেতা হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার
ছবি: এএফপি

আর টেস্ট ক্রিকেট তো কেবল সিরিজ জয়-পরাজয়ের সীমা-পরিসীমায় আটকে নেই তিন বছর ধরেই। প্রতিটি ম্যাচই লেখা হচ্ছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আমলনামায়, একটা ড্র আর হারের মধ্যে ব্যবধানই হতে পারে ফাইনাল খেলা আর না খেলার মধ্যে তফাত। পরের মাঠে তিন টেস্টের সিরিজ ড্র করে গেলেও পাওয়া যাবে একটা টেস্ট জয়ের সমান পয়েন্ট, তার ওপর আবার চতুর্দিকে এত নেতিবাচকতার ছড়াছড়ি, এর মাঝে দাঁড়িয়ে কামিন্স ওই ইনিংস ঘোষণার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেলেন কী করে?

উত্তরটা বোধ হয় লেখার প্রথমে বলা সাকিবের সেই বাণীতেই লুকিয়ে। অস্ট্রেলীয়রা তো বিশ্বাস করে, হেরে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্তও তাঁরা ম্যাচটা জিততে পারেন। ওই বিশ্বাসের জোরেই বোধ হয় লায়ন তাঁর ছন্দটা খুঁজে পান এই দিনে। এক প্রান্ত থেকে নিরবচ্ছিন্ন বল করে গিয়ে আউট করেন পাঁচজনকে, ২০২০ সালের জানুয়ারির পর প্রথমবার। বোলারদের জন্য যা একটু রিভার্স সুইংই মিলছিল এ সিরিজে, সেটাকে সম্বল করেই কামিন্স এ শেষ দিনেও আগুন ঝরান বল হাতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ করেন নিজের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাও, দিনের খেলার ঘণ্টাখানেক বাকি থাকতেই অস্ট্রেলিয়া লাহোর টেস্টটা জিতে যায় ১১৫ রানে।

২৪ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াও তাই সিরিজ জেতে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে...