আমিরদের সেই 'স্পট ফিক্সিং' নিয়ে আফ্রিদির বইয়ে বিস্ফোরক সব তথ্য!

টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে সতীর্থদের ওপর আস্থা উঠে যাওয়ায় টেস্ট ক্রিকেট ছেড়েছিলেন আফ্রিদি। ছবি: এএফপি
টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে সতীর্থদের ওপর আস্থা উঠে যাওয়ায় টেস্ট ক্রিকেট ছেড়েছিলেন আফ্রিদি। ছবি: এএফপি
>

২০১০ লর্ডস টেস্টে মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ ও সালমান বাটের স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি এখনো ক্রিকেটপ্রেমীদের আলোচনা ও বিতর্কের খোরাক। শহীদ আফ্রিদি তাঁর আত্মজীবনী ‘গেম চেঞ্জার’-এ কলঙ্কজনক সেই ঘটনার পটভূমি নিয়ে বিস্ফোরক তথ্যই জানিয়েছেন

আত্মজীবনী ‘গেম চেঞ্জার’-এ একের পর এক চমক উপহার দিয়ে চলছেন শহীদ আফ্রিদি। সেখানে নিজের আসল বয়স জানানোর সঙ্গে ওয়াকার ইউনুস ও গৌতম গম্ভীরের কড়া সমালোচনাও করেছেন পাকিস্তানের সাবেক এ অধিনায়ক। এবার জানা গেল, ২০১০ লর্ডস টেস্টে কলঙ্কজনক সেই স্পট ফিক্সিং নিয়েও আফ্রিদি চমকপ্রদ তথ্য জানিয়েছেন আত্মজীবনীতে। সেবার শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে ইংল্যান্ড সফরে যান আফ্রিদি। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের পর এই সংস্করণে ছেড়ে দেন নেতৃত্ব। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সালমান বাট। চতুর্থ টেস্টে কলঙ্কজনক সেই ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো আফ্রিদির জবানিতে, তাঁর আত্মজীবনী থেকে—

দুনীতি-চক্রের আসল প্রমাণ আমার হাতে এসেছিল। স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়া খেলোয়াড়দের বিপক্ষে ছিল ফোনের খুদেবার্তাগুলো। এই প্রমাণ আমি টিম ম্যানেজমেন্টকে দেখাই। পরের ঘটনা খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিল না। তাতে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের ওপর আস্থা বাড়েনি।

তখন এক সফরে শ্রীলঙ্কায় ছিলাম। সেখানে মাজহার মাজিদের—সালমান বাটের ‘এজেন্ট ও ম্যানেজার’ পরে তার শাস্তিও হয়েছিল—একটি খুদেবার্তা আমার হাতে আসে, প্রতিলিপি হিসেবে। এটি হাতে পাওয়া ছিল একেবারেই কাকতালীয় ব্যাপার এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল এক শিশু, মেরামতকারী (মিস্ত্রি) ও সৈকত।

শ্রীলঙ্কা সফরের আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালীন ক্রিকেট দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মাজিদের পরিবার। শ্রীলঙ্কার এক সৈকতে মাজিদের বাচ্চা ছেলেটি তাঁর বাবার ফোন পানিতে ফেলে দেয়। এতে ফোনটি আর সচল থাকেনি। মাজিদ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সময় ফোনটি নিয়ে যায় এবং একটি দোকানে তা ঠিক করতে দেয়। দোকানে ফোনটি বেশ কিছুদিন ছিল। কাকতাল হলো, সেই দোকানের মালিক আমার এক বন্ধুর বন্ধু (বিষয়টি একটু বেশি কাকতালীয় মনে হলেও ইংল্যান্ডে পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী একে-অপরের বেশ ঘনিষ্ঠ)।

খুদেবার্তাগুলো পুনরুদ্ধার করতে বলা হয়েছিল দোকানের মালিককে। এতে ফোন মেরামতের সময় পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের প্রতি মাজিদের পাঠানো বার্তাগুলো তাঁর নজরে আসে। যদিও এ কাজটি করা তাঁর উচিত হয়নি। যাই হোক, সে বার্তাগুলো সেই বন্ধু সহ আরও কয়েকজনের (যাদের নাম আমি বলব না) কাছে ফাঁস করে দেয়। আর এভাবে আমিও জেনে যাই। তখন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, পাকিস্তান ক্রিকেট দল ঘিরে অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে। এই খুদেবার্তা ফাঁস হওয়াতেই সতর্ক হয়ে যায় ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর প্রতিবেদক দল। বিষয়টি কাকতাল ছাড়া আর কিছুই না ; শ্রীলঙ্কায় নষ্ট হওয়া ফোন লন্ডনে এক পাকিস্তানি মেরামতকারী দেখে চোখ-মুখ বন্ধ রাখতে পারেনি। তবে আমি এতটুকু অবাক হইনি। সৃষ্টিকর্তা বরাবরই ভীষণ অপ্রত্যাশিত পথে সুবিচার করে থাকেন।

খুদেবার্তাগুলো পাওয়ার পর কোচ ওয়াকার ইউনুসকে দেখাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে এ বিষয়টি উচ্চমহলকে জানায়নি। ওয়াকার ও আমি দুজনেই ভেবেছিলাম, এসব এমন কোনো বিষয় নয়। দেখে যত ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে আসলে ততটা না। মাজিদ ও খেলোয়াড়দের মধ্যে স্রেফ চালাকিপূর্ণ কথাবার্তা বলেই ভেবেছিলাম। কিন্তু খুদেবার্তাগুলো অনেক বড় কিছুর অংশ ছিল, যা পরে গোটা বিশ্ব জানতে পারে।

ওই বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালীন আবদুর রাজ্জাক আমাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, সালমান, আমির ও আসিফ ‘ভালো কিছু করছে না’। আমি তাঁর কথা স্রেফ উড়িয়ে দেই। এসব তাঁর (রাজ্জাক) কল্পনা বলে মনে মনে ভেবেছি, তাঁদের সন্দেহজনক আচরণ আসলে তারুণ্য ও অনভিজ্ঞতার প্রতিফলন। লন্ডন থেকে যে খুদেবার্তাগুলো পেয়েছিলাম সে সমন্ধে রাজ্জাককে আমি কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম, রাজ্জাকের মতো খেলোয়াড় যে ড্রেসিং রুমের রাজনীতি থেকে নিজেকে সব সময় দূরে রাখে তাঁরও তো একই মত—সালমান এবং কয়েকজনের মধ্যে কোনো গড়বড় আছে।

২০১০ সালে ইংল্যান্ডে সেই কলঙ্কজনক সফরের আগে মাজহার এবং তার সঙ্গীদের আবারও দলের আশপাশে দেখি। তখন মনে হয়েছিল আর চুপ করে থাকা যায় না। সিদ্ধান্ত নেই বিষয়টি অফিশিয়ালি টিম ম্যানেজার ইয়ার সাঈদকে জানাব। মাজহারকে দলের কাছ থেকে দূরে থাকার এবং কোনো খেলোয়াড় যেন ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও তার সঙ্গে যোগাযোগ না করে, এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাই। নিজের মান-সম্মান নিয়েও ভীত ছিলাম—যেহেতু তখন আমি টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক—কোনো বিতর্ক দলের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলতে পারে এই ভয়টা ছিল।

সাঈদ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। খুদেবার্তাগুলো কাগজে প্রিন্ট করেও তাঁকে দেখিয়েছি। কিন্তু তাঁর কোনো বিকার ছিল না, বরং অদ্ভুতুড়ে জবাব দিল, ‘এ নিয়ে আমরা কী করতে পারি? তেমন কিছুই না, তেমন কিছুই না।’ দলের সিনিয়র অফিশিয়ালের কাছ থেকে এমন কথা শুনব, তা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তেমন কিছুই না? দল, দেশ ও লাখো ভক্তদের নিয়ে আমরা এসব কীভাবে করতে পারি! সে (সাঈদ) যা বলেছিল, তা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইনি।

হতাশ হয়েছিলাম। খুব বেশি প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু প্রিন্টগুলো নিজের কাছে রেখেছি। এমনকি, সাঈদ আমার কাছে সেগুলোর কোনো প্রতিলিপিও চায়নি। পরের দিন নর্দাম্পটনে প্রস্তুতি ম্যাচের সময় মাজহার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও ড্রেসিং রুমের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছিল। ইয়ার সাঈদকে গিয়ে তাই আবারও বলি, এসব লোকজনের দলের আশপাশে থাকা উচিত নয়। কারণ ওদের সমন্ধে ভালো কোনো কথা শুনিনি।

এর মধ্যে মাজহার ও খেলোয়াড়দের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া খুদেবার্তা আরও অনেকের কাছেই ছড়িয়ে পড়ল। পাকিস্তানি সম্প্রদায় জানত কিছু একটা ঘটেছে। সম্ভবত ঠিক এ সময়েই ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্টিং অপারেশন চালায়। আরেকজনের খুদেবার্তা নিয়ে আমি পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্টকে জোর দিয়ে সেভাবে কিছু বলিনি। তবে সালমান, আমির ও আসিফের বিপক্ষে ভেতরে-ভেতরে তদন্ত চালানো যায় এমন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্ট বারবার তা নাকচ করে দিয়েছি। তাঁদের যুক্তি, এ নিয়ে তেমন কিছুই করার নেই। সত্যি বলতে, আমি মনে করি টিম ম্যানেজমেন্ট বিষয়টি পাত্তাই দেয়নি। এটা যেন কারও কোনো সমস্যা না! ম্যানেজমেন্ট সম্ভবত এর পরিণতি নিয়ে ভীত ছিল। কিংবা এসব খেলোয়াড়ের পেছনে বিনিয়োগ করে তাঁরা ভবিষ্যৎ অধিনায়ক হিসেবে ভেবেছে। কিংবা নিজেদের দেশ ও খেলাটির প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। আমি ঠিক বলতে পারব না।

ইংল্যান্ডে আসার পর খেলোয়াড়দের বলেছি মাজহার এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কাছ থেকে দূরে থাকতে। কোচ ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কোনো কিছুই পাল্টায়নি। লর্ডসে প্রথম টেস্টে ভেবেছি, পাকিস্তান ক্রিকেটের কী সমস্যা? সবাই এমন করছে কেন? ঠিক তখনই নিজের মতো করে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেই। ম্যাচ চলাকালীন চতুর্থ দিনে সালমানকে বললাম, এখন থেকে তুমি দায়িত্ব নিতে পারো।

হ্যাঁ, আমার ওভাবে দল ছাড়া উচিত হয়নি। বাড়ি না ফিরে দ্বিতীয় টেস্ট খেলা উচিত ছিল। হ্যাঁ, আমি সমস্যায় ছিলাম কিন্তু দায়িত্বটা আমার কাঁধেই ছিল তাই হয়তো আরও অনেক কিছু করা উচিত ছিল। কিন্তু টেস্ট থেকে অবসর নিলাম, সম্ভবত অকালেই। গোটা সেট-আপের (দল ও ম্যানেজমেন্ট) ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। সবার ওপরে তো বটেই নিজের ওপরেও ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলাম। এ কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পুরো টেস্ট সিরিজ না খেলে বাড়ি ফিরে পরিবারের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেই।

হ্যাঁ, এসব দেখে আমি হাল ছেড়েছি। থেমে গেছি।