এক ম্যাচে এত ম্যান অব দ্য ম্যাচ!

স্মরণীয় জয়ের পর বাংলাদেশ দলের উদ্‌যাপনছবি: এএফপি

হাসিটা অনেক জোরে শোনা গেল। হা হা হা! যিনি হাসছেন, তিনি অবশ্য জোরে হাসারই লোক। মাখায়া এনটিনি। কিন্তু একটু আগেই নিজেদের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ হেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা দল। সেই হারের পর কিনা দলটার সাবেক এক ক্রিকেটার অমন ‘হা হা হা’ করে হাসছেন!

মাখায়া এনটিনির আসলে হাসতে কোনো কারণ লাগে না। তিনি সবকিছুতেই হাসেন এবং অন্যদের হাসান। কাল সেঞ্চুরিয়নের প্রেসবক্স ও তার আশপাশে যতক্ষণ ছিলেন, পরিবেশটা মোটামুটি জমিয়েই রেখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সাবেক ফাস্ট বোলার। এই প্রতিবেদককে দেখেই তাঁর ওই প্রকাণ্ড হাসি, ‘তোমরা তো জিতে গেলে! অভিনন্দন। হা হা হা।’

সুপার স্পোর্টস পার্কে বাংলাদেশের কালকের জয়টা নানা কারণেই ঐতিহাসিকের মর্যাদা পেতে পারে। একে তো দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যেকোনো সংস্করণের ক্রিকেটেই প্রথম জয়, আর এই ম্যাচ দিয়ে এখন সব আন্তর্জাতিক দলের বিপক্ষেই জয়ের স্বাদ পাওয়া হয়ে গেছে বাংলাদেশের। কাল জয়টাও এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সর্বোচ্চ (৩১৪) রান করে।

তামিমের ম্যাচসেরা মিরাজ। উইকেট নেওয়ার পর
ছবি: এএফপি

তাতে বাড়তি অলংকার ছুটি-বিতর্ক কাটিয়ে ফেরা সাকিব আল হাসানের ঝলমলে ৭৭ রানের ইনিংস, লিটন দাস ও ইয়াসির আলীর দারুণ দুটি ফিফটি, দুই পেসার শরীফুল ইসলাম ও তাসকিন আহমেদের আগুন–ঝরানো বোলিং এবং অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজের ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া ঘূর্ণি।

এক ম্যাচে যখন এত পারফরমার, তখন ম্যান অব দ্য ম্যাচ বেছে নেওয়াটাই মুশকিল হয়ে যায়। কাল ম্যাচ শেষে পুরস্কারটা সাকিবের হাতে উঠলেও অধিনায়ক তামিম ইকবাল বলেছেন, এ ম্যাচে তাঁর ম্যান অব দ্য ম্যাচ মিরাজও।

এই প্রতিবেদকের দিকে ‘সেলিব্রেট ইয়োর উইন’ বলে একটা বিফ বার্গার বাড়িয়ে দেওয়া এনটিনির চোখে অবশ্য ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছেন দুই পেসার শরীফুল আর তাসকিনই, ‘তোমাদের পেসাররা দুর্দান্ত বোলিং করেছে; বিশেষ করে লম্বা দুটি ছেলে। সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।’

তাসকিন আহমেদও দারুণ বল করেন
ছবি: এএফপি

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মিরাজকেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ বলে আসা অধিনায়ক তামিম ইকবাল পরে জয়ের কৃতিত্বটাকে আরও খণ্ডিত করে বলেছেন, ‘এটা সবার অবদানে পরিপূর্ণ এক ম্যাচ। শুরুতে আমাদের ভালো একটা ওপেনিং জুটি হয়েছে, সাকিবের অসাধারণ ইনিংস, ইয়াসিরের ইনিংসটা তো ছিল অবিশ্বাস্য, রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) ভাইয়ের ২৫ রানও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মিরাজের দুটো ছয় ওই সময় দরকার ছিল, আর ফিল্ডিংও ভালো হয়েছে।’

বোলারদের প্রসঙ্গে আলাদা করেই বলতে হলো অধিনায়ককে, ‘যখনই আমরা শুরুতে উইকেট পেয়ে যাই, তখনই বুঝতে পারছিলাম আমরা ভালোভাবে ম্যাচে আছি। এই মাঠটা এমন, ৩০০ রানও তাড়া করে ফেলা যায়। কিন্তু আমাদের ফাস্ট বোলাররা যেভাবে বোলিং করল, মিরাজ যেভাবে ফিরে এল—সবকিছু এক কথায় অসাধারণ।’

এ রকম পরিস্থিতিতে সাকিবের ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি ‘ছিনতাই’ হয়ে যাওয়ার কপট শঙ্কা তো জাগেই! সমাধান দিলেন টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ। ম্যাচ শেষে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বলছিলেন, ‘যেভাবে আমরা খেলেছি, এক কথায় অনন্য। যেভাবে পরিকল্পনা করেছি, সেভাবেই ব্যাটিং-বোলিং করেছি। আমি সবাইকে কৃতিত্ব দেব। হয়তো সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি, আজকের (গতকালের) ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ অনেকেই।’

সাকিবকে খুব ভালো সঙ্গ দেন ইয়াসির আলী
ছবি: এএফপি

ব্যাটিংয়ে সাকিব তো আলাদা প্রশংসাপত্র পাবেনই, তবু তাঁর পারফরম্যান্সকে এক পাশে রেখে মাহমুদ আরও কিছু অবদানের ছোটখাটো একটা তালিকা দিলেন। শুরুতে খারাপ বোলিং করেও মিরাজের ফিরে আসা, গতিময় বোলিংয়ে তাসকিন-শরীফুলের উইকেট তুলে নেওয়া, তামিম-লিটনের ৯৫ রানের ওপেনিং জুটি, ইয়াসিরের ব্যাটিং, দুর্দান্ত কিছু ক্যাচ—৩৮ রানের ঐতিহাসিক জয়ের পেছনে তিনি সবকিছুরই অবদান দেখেন। মাহমুদের প্রশংসাবাক্য ছুঁয়ে গেছে শেষ দিকে খেলা মাহমুদউল্লাহ-মিরাজ-আফিফদের ছোট অথচ কার্যকর ইনিংসগুলোকেও।

কাল ব্যাটিংয়ে প্রথম ২০ ওভারে উইকেট না হারানোটাই মূল পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের। বল একটু পুরোনো হয়ে এলে রান করাটা সহজ হয়ে উঠবে—অপেক্ষা ছিল সেটির। শুরুটা একটু ধীরলয়ে হলেও তিন নম্বরে সাকিব এসে যেমন ঠিকই পুষিয়ে দিয়েছেন ঘাটতিটা।

নির্বাচক ও জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের জয়ের বর্ণনায়ও ঘুরেফিরে এসবই এল, ‘যেকোনো সিরিজের প্রথম ম্যাচটা খুব কঠিন হয়। আমরা জানতাম দক্ষিণ আফ্রিকায় আমাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী খুব নিখুঁত ক্রিকেট খেলেছি।’

ম্যাচসেরা ইনিংস খেলেন সাকিব। ম্যাচসেরার পুরস্কার তাঁর হাতেই উঠেছে
ছবি: এএফপি

প্রথম ওয়ানডেতে হাবিবুলের চোখে বিশেষভাবে পড়েছে আরও দুটি ব্যাপার। তার একটি একই ম্যাচে তিন পেসারেরই ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করা। হাবিবুল বলছিলেন, ‘যে রকম উইকেট ছিল, মাঠের একটা পাশ ছোট...তিন শ রানও অনেক সময় নিরাপদ নয় এখানে। কিন্তু নতুন বলে বোলাররা খুব ভালো বোলিং করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশি সন্তুষ্ট এই কারণে যে আমাদের তিন পেসারই ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটা খুব কমই দেখেছি।’

হাবিবুলের দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ—কেউই ম্যাচের কোনো অবস্থাতে হাল ছাড়েননি। ‘মিরাজ শুরুটা খারাপ করলেও ভালোভাবে ফিরে এসেছে। লড়াইয়ের মানসিকতা দেখিয়েছে,’ বলেছেন হাবিবুল।

এমন ঐতিহাসিক জয়ে অবদান রাখতে পেরে পেসার তাসকিন আহমেদের আনন্দটা বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ, ‘এই অনভূতি অন্যরকম… আলহামদুলিল্লাহ। ভবিষ্যতে দলকে জেতাতে আরো অবদান রাখতে চাই।’

আরেক পেসার শরীফুলের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকায় সাফল্য নতুন কিছু নয়। ২০২০ সালে যুব বিশ্বকাপটাই তো জিতে নিয়েছিলেন এখান থেকে! তামিম, মাহমুদ, হাবিবুলরা জয়ের কৃতিত্ব যতটা সম্ভব ভাগাভাগি করে দেওয়ার পরও একটা নাম বাদ পড়ে গিয়েছিল। শরীফুলের মুখে শোনা গেল সে নামও, ‘উইকেট না পেলেও মোস্তাফিজ ভাই আমার চেয়ে ভালো বোলিং করেছেন। একটা সময় আমার যখন পায়ে হালকা ব্যথা হচ্ছিল, উনিই তখন মিলারকে বোলিং করেছেন এবং খুব ভালো করেছেন।’

কালকের ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হতে পারতেন, সে তালিকায় কি তবে আরেকটা নাম উঠল!