এটাই কি টেস্ট ব্যাটিং

রানআউট হওয়ার পর মুমিনুলের এভাবে পড়ে থাকার সঙ্গে আজ বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মিলটা প্রতীকী। উইকেট থিতু হয়ে কেউ লড়তে পারেননিছবি: শামসুল হক

তাইজুল ইসলামের বাঁহাতি স্পিন মেশানো বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে পড়েই বাঁক খেয়ে বেরিয়ে গেল। তরুণ ব্যাটসম্যান মাহমুদুল হাসান বলটি ছেড়ে দিতে পারতেন। সেটি না করে পা বাড়িয়ে মাহমুদুল খেললেন বিশাল এক ড্রাইভ।

কিন্তু তাইজুলের বাঁকে পরাস্ত হয়ে বলে ব্যাটই ছোঁয়াতে পারলেন না মাহমুদুল। নেটের ওপাশ থেকে মাহমুদুলকে দেখছিলেন টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ। কয়েক পা এগিয়ে এসে মাহমুদুলকে তিনি বললেন, ‘এটা টেস্ট ক্রিকেট। সেভাবে খেলো।’

পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম টেস্ট মাঠে গড়ানোর দুই দিনের আগের ঘটনাটি এটি। মাহমুদুল সেদিনই জাতীয় দলের নেটে প্রথম ব্যাট করতে নামেন।

তারুণ্য, রোমাঞ্চ—হয়তো এসব কারণেই তেড়েফুঁড়ে খেলতে গিয়েছিলেন মাহমুদুল। চট্টগ্রামের সেই নেট অনুশীলনের সঙ্গে মিরপুরে মাহমুদুলের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসের গল্পটার অনেক মিল।

Shamsul Haque Tanku

টানা তিন দিন বৃষ্টি–বাধা আর পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের পর আজ দুপুরে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ দল। শাহিন শাহ আফ্রিদির এক ওভারের পেস বোলিংয়ের পর আলোস্বল্পতার কারণে দুই প্রান্ত থেকে স্পিনার দিয়ে বল করাতে বাধ্য হন পাকিস্তান দলের অধিনায়ক বাবর আজম।

যে কারণে টেস্ট ক্রিকেটে মাহমুদুল নিজের প্রথম ওভারে বোলার হিসেবে পেয়ে যান তাইজুলের মতোই বাঁহাতি স্পিনার নোমান আলীকে।

সেদিনের নেট সেশনের চেয়েও দশ গুণ বেশি রোমাঞ্চ, স্নায়ুর চাপ ছিল মাহমুদুলের চোখেমুখে। একবার ক্রিজ ছেড়ে খেলছেন, একবার ক্রিজে একদম জমে গিয়ে—এভাবে নোমানের ছয়টি বল সামলে পরের ওভারে অফ স্পিনার সাজিদ খানকে ক্রিজ ছেড়ে খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ তোলেন মাহমুদুল।

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংসে কোনো রান না করেই ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয় এই তরুণ ব্যাটসম্যানকে। প্রথম টেস্টের রোমাঞ্চে হয়তো মাহমুদুল ভুলেই যান টিম ডিরেক্টর মাহমুদের সেই কথাটি, ‘এটা টেস্ট ক্রিকেট। সেভাবে খেলো।’

বাজে শট খেলে আউট হন নাজমুল
ছবি: শামসুল হক

শুধু কি প্রথম টেস্ট খেলতে নামা মাহমুদুলই ভুলে গিয়েছেন? সাদমান ইসলাম, নাজমুল হোসেন, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ—সবাই যেন কথাটা ভুলে গেলেন। ওপরের সারির সাত ব্যাটসম্যানের সবাই খেললেন ওয়ানডে, কখনো আবার টি-টোয়েন্টি মেজাজে।

মাহমুদুলের সঙ্গী ওপেনার সাদমান যেমন সাজিদেরই অফ স্পিনে কাট করতে গিয়ে ক্যাচ তোলেন। ওই সময়টা সাজিদের বাড়তি বাউন্স মেশানো বলে শটটা না খেললেও হতো।

তরুণ দুই ওপেনারের চেয়ে বড় ভুল করেছেন অধিনায়ক মুমিনুল হক। চা পান বিরতির ঠিক আগেই তিনি সাজিদের বল কাভারে ঠেলে দৌড় দেন ঝুঁকিপূর্ণ সিঙ্গেলের জন্য।

কাভারে পাকিস্তানি পেসার হাসান আলী সরাসরি থ্রোতে ভাঙেন মুমিনুলের স্টাম্প। ইনিংসের তখন মাত্র ১০.১ ওভার চলে, ততক্ষণেই বাংলাদেশ পরিণত হয় ২২ রানে ৩ উইকেটে! ম্যাচের আবহ থমথমে। প্রেস বক্সে সাংবাদিকদের মুখের চাহুনিতে তখন একটাই প্রশ্ন, ‘এটা কি হলো? এটা কি আসলেই টেস্ট ক্রিকেট?’

মুশফিকুর রহিমও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি
ছবি: শামসুল হক

প্রশ্নটা দিনের খেলা শেষেও বহাল থাকল। কারণ, চা পান বিরতির পর বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ টেস্ট ক্রিকেটার মুশফিক সেই সাজিদের অফ স্পিনেই অযথা স্লগ সুইপ খেলতে গিয়ে শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ তোলেন। ফিল্ডার ফাওয়াদ আলমের চোখ তো ছানাবড়া!

ইনিংসের মাত্র ১৩তম ওভার চলছে, এমন সময় মুশফিকের এমন শট প্রতিপক্ষ দলের ক্রিকেটারের চোখেমুখেও অবিশ্বাস এনে দিয়েছিল।

তিন ওভার পর প্রায় একই কাজটা করেন লিটন। সেই সাজিদকেই ক্রিজ ছেড়ে ফিরতি ক্যাচ দেন চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরি করা এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান।

একবার জীবন পাওয়া নাজমুলও আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের পথে হেঁটে আউট হন সাজিদের বলে। বাকিদের আউটয়ের ধরনের তুলনায় মিরাজের আউট অনেকটা আত্মাহুতি দেওয়ার মতো। সাজিদের ফুল লেংথের বলটি তিনি সুইপ করে ছক্কা মারার চেষ্টা করে বোল্ড হন। অন্য প্রান্তে থাকা সাকিব মিরাজের আউট দেখে রাগে নিজের ব্যাটে ঘুষি মেরে হতাশা প্রকাশ করেন।

বাজে শট খেলতে গিয়ে আউট হন মুশফিকও
ছবি: শামসুল হক

বাংলাদেশের পাগলাটে ব্যাটিং অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে আলোস্বল্পতায় খেলা বন্ধ হলে। ৭৬ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারানো বাংলাদেশ এখন ফলোঅন এড়ানোর লড়াই করছে। দিন শেষে দলের ড্রেসিংরুমের সামনে ফাস্ট বোলার ইবাদত হোসেনকে ব্যাটিং অনুশীলন করতে দেখা যাচ্ছিল।

ফলোঅন এড়াতে হলে যে সাকিবের সঙ্গে তাঁকেও ক্রিজে টিকে থাকবে হবে! ঘণ্টাখানেকের বর্ণনাতীত এই ব্যাটিংয়ের ফলটাই যে পেল বাংলাদেশ দল।