এবার টেস্টেও বড় কিছুর আশা তামিমদের

ডারবান ও পোর্ট এলিজাবেথে এই প্রথম টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ দল। নতুন ভেন্যুতে নতুন স্বপ্ন থাকছে লাল বলের ক্রিকেটেও।

টেস্টেও ভালো করার আশা বাংলাদেশ দলেরছবি: সংগৃহীত

২০০৩ বিশ্বকাপের সেই স্মৃতি অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা ক্ষত হয়ে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় সেবার বিশ্বকাপটা দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছিল বাংলাদেশ দলের। সেই দুঃস্বপ্নের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় ডারবানের কিংসমিডে কানাডার ১৮০ রানও তাড়া করতে না পেরে ৬০ রানে ম্যাচ হেরে যাওয়া।

বাংলাদেশের কাছে জয়টা তখন খুব সহজলভ্য ছিল না। যেকোনো দলের বিপক্ষে যেকোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচেই জেতাটা তাই অনেক বড় ব্যাপার ছিল। বিশ্বকাপে কানাডার কাছে হেরে যাওয়াতে আর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপটা বাজে কাটাতে তাই মনে হয়েছিল, সেখানেই বুঝি থেমে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট! তবে গত ১৯ বছরে সেই ক্ষতের ওপর পড়েছে অনেক সুখস্মৃতির প্রলেপও।

ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর এবার টেস্টেও ভালো কিছু করে দেখাতে চায় দল
ফাইল ছবি: এএফপি

ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে ডারবানে ওই একটি ম্যাচই খেলেছে বাংলাদেশ দল। বর্তমানে দলের কারওই অবশ্য ১৯ বছর আগের সেই দলে থাকার কথা নয়। খালেদ মাসুদের নেতৃত্বে ২০০৩ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে খেলেছেন, এমন একজনই শুধু আছেন এবারের দলের সঙ্গে—নির্বাচক হাবিবুল বাশার।

বাংলাদেশের এই দলের জন্য ডারবান তাই একদমই নতুন এক শহর। ২০০৩ বিশ্বকাপ বাদ দিলে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে এর আগে তিনবার দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছে বাংলাদেশ দল। ২০০৭ সালে এসেছে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতেও। কিন্তু ভারত মহাসাগরপারের এই শহরে টেস্ট খেলা পড়েছে এবারই প্রথম। নতুন শহরে কাল বাংলাদেশ দল এসে পৌঁছেছে নতুন আশা নিয়ে।

সে আশার বিস্তারিত পরে বলা যাবে। তার আগে ডারবান শহরটাকে একটু জেনে নেওয়া যাক। কিং শাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শহর পর্যন্ত আসতে আশপাশের পুরোটাই সবুজের সমারোহ। কিছু পথ সমুদ্রের তীর ঘেঁষে পার হয়ে তবেই পৌঁছাতে হবে মূল শহরে।

শেষ ওয়ানডেতে দাপট দেখিয়ে জিতেছে বাংলাদেশ
ফাইল ছবি: এএফপি

কেপটাউনের পর দক্ষিণ আফ্রিকার যে শহরগুলোর সৌন্দর্য পর্যটকদের বেশি টানে, কাওয়াজুলু নাটাল প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর ডারবান তার অন্যতম, যার আগের নাম ছিল পোর্ট নাটাল। একসময়ের ব্রিটিশ কলোনি ডারবানে এখন অবশ্য ভারতীয় ছোঁয়াই বেশি। বিশ্বে ভারতের বাইরের শহরগুলোর মধ্যে ডারবানেই নাকি সবচেয়ে বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের বসবাস। এক হিসাবে দেখা গেছে, শহরটির এক–চতুর্থাংশ মানুষ এশিয়ার, যার বেশির ভাগই ভারতীয়। আজ থেকে ১৫০ বছর আগে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এখানকার চিনিকলগুলোতে কাজ করতে আসা শুরু করেন ভারতীয়রা। সেই থেকেই ডারবান যেন এক টুকরা ভারত!

বাংলাদেশ দলের আফসোস ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় এতবার এসেও কখনো দেশটির মূল ভেন্যুগুলোতে টেস্ট খেলা হয়নি। মূল ভেন্যু বলতে কেপটাউন, ডারবান এবং পোর্ট এলিজাবেথ, যেটির নাম পাল্টে এখন হয়েছে ‘গেবেহা’। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার আঞ্চলিক ভাষা থেকে এসেছে নামটা। দেশটির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পোর্ট এলিজাবেথকে নতুন নামে চেনানো।

এবার বাংলাদেশ দলের ‘আশা’র কথায় আসা যাক। একটা তো বলেই দেওয়া হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার মূল ভেন্যুগুলোতে টেস্ট খেলার আশা এবার পূরণ হতে চলেছে তামিম–মুশফিকদের। সিরিজের দুটি টেস্ট হবে ডারবান আর পোর্ট এলিজাবেথে। দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নতুন নামের পোর্ট এলিজাবেথে যাওয়ার আগে ৩১ মার্চ ডারবানে শুরু হবে প্রথম টেস্ট। কেপটাউনে অবশ্য এবারও টেস্ট নেই। তবে এই সফরে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে সুন্দর শহরটার ছোঁয়াও পেয়েছে বাংলাদেশ দল!

অনুশীলনে বাংলাদেশ দল
ফাইল ছবি

ওয়ানডে সিরিজের সময়টায় শুধু টেস্ট দলে থাকা ক্রিকেটারদের অনুশীলন ক্যাম্প হয়েছে কেপটাউনে গ্যারি কারস্টেনের একাডেমিতে। ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্স ছিলেন ক্যাম্পের দায়িত্বে। দুই সপ্তাহের এই ক্যাম্প নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। কাল প্রথম আলোকে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা সেখানে সেন্টার উইকেটে তিনটি অনুশীলন সেশন করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে নতুন বলে খেলার অভ্যাসটা রপ্ত করতে এটা ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য দারুণ সুযোগ। সবার জন্যই ক্যাম্পটা খুব ফলপ্রসূ হয়েছে।’

আইপিএল খেলতে চলে যাওয়া মোস্তাফিজুর রহমান আর টেস্ট দলে না থাকা মাহমুদউল্লাহ, আফিফ হোসেন ও নাসুম আহমেদকে দেশে পাঠিয়ে কাল সেঞ্চুরিয়ন থেকে যেমন ওয়ানডে দলের বাকি ক্রিকেটাররা ডারবানে পৌঁছেছেন; কেপটাউন থেকে এদিনই এই শহরে চলে এসেছেন টেস্ট দলের অন্য ক্রিকেটাররাও। আজকের দিনটা সবারই কাটছে বিশ্রামে, আগামীকাল ডারবানে শুরু হবে টেস্টের প্রস্তুতি।

ডারবানে সেঞ্চুরিয়ন–কেপটাউন থেকে আসা ক্রিকেটারদের পুনর্মিলনে আনন্দের রেণু ছড়াচ্ছে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের সাফল্য। লাল বলের ক্রিকেটেও যে এবার সেটিই প্রেরণা হবে বাংলাদেশের, তা বোঝা গেছে পরশু সিরিজ জয়ের রাতে টিম হোটেলের আবহে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়ের আনন্দের মধ্যেই বারবার উচ্চারিত হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় এবার টেস্টও জিতবে বাংলাদেশ।

সিরিজ জেতা বাংলাদেশ বাংলাদেশ দল
ফাইল ছবি

এমন আত্মবিশ্বাসের একটি কারণ তো অবশ্যই ওয়ানডে সিরিজ থেকে পাওয়া টনিক, অন্য কারণ আইপিএলের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দলের মূল খেলোয়াড়দের ছয়জন নেই বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল অবশ্য এর কোনো কিছুকেই টেস্ট জয়ের গ্যারান্টি হিসেবে নিচ্ছেন না। ডারবানে আসার আগে তামিম বলছিলেন, ‘আমরা যেভাবে খেলেছি (ওয়ানডে সিরিজে), টেস্টেও আমাদের সুযোগ আছে। তবে এটা পাঁচ দিনের খেলা, একেবারেই ভিন্ন এক সংস্করণ।’

দলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর আত্মবিশ্বাসটা যদি ক্রিকেটাররা মনে ধারণ করতে পারেন, তাহলে অবশ্য ডারবান–পোর্ট এলিজাবেথেও ভিন্ন কিছু হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। পরশু সিরিজ জয়ের পর ড্রেসিংরুমে ডমিঙ্গো নাকি সবার উদ্দেশে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পরও যদি ক্রিকেটারদের মধ্যে এই বিশ্বাস না আসে যে তাঁরা বিশ্বকাপ জিততে পারবেন, তাহলে আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাসটা আসবে না।

বিশ্বকাপ জয় অনেক বড় স্বপ্ন। সেউ স্বপ্ন বুকে বেঁধে নিতে পারলে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট জয়টাও কঠিন হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে আইপিএলের থাবায় এই দক্ষিণ আফ্রিকা যখন দুর্বল, ওয়ানডে সিরিজ জিতে উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ।