ছেলেদের যা আফসোস, মেয়েদের তা-ই শক্তি

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মেয়েদের প্রথম জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান দুই লেগ স্পিনার রুমানা ও ফাহিমারছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশকে লেগ স্পিনাররাও জেতান!

ছেলেদের ক্রিকেট দলে এমন কিছু দেখার স্বপ্ন বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক দিনের। কিন্তু অপূর্ণ থাকার মেয়াদ অনেক বেশি হয়ে গেলে তো স্বপ্নও আফসোসই হয়ে যায়। লেগ স্পিন এখন ছেলেদের ক্রিকেটে বড় আফসোসের নাম। এত বছরেও একটা লেগ স্পিনার পেল না বাংলাদেশের ছেলেদের দল—আফসোসটা অবিশ্বাস হয়েও ঝরে।

ধরন বদলে মেয়েদের ক্রিকেটে দেখুন, ছেলেদের আফসোসই মেয়েদের শক্তি! হ্যামিল্টনে আজ পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের ইতিহাস গড়ার গল্প যখন লেখা হবে, বারবার উঠে আসবে দুটি নাম—দুই লেগ স্পিনার রুমানা আহমেদ আর ফাহিমা খাতুন।

স্কোরবোর্ড বলবে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের যে ৯ উইকেট ফেলেছে, তার ৫টি এ দুজনের। কিন্তু শুধু এটুকু পরিসংখ্যানের কী সাধ্য রুমানা-ফাহিমার হাতে ম্যাচের ঘুরে যাওয়ার গল্প বলে?

ফাহিমা খাতুন হঠাৎ সুযোগ পেয়েই আলো ছড়িয়েছেন
ছবি: এএফপি

২৩৫ রানের লক্ষ্যে ৪২ তম ওভারেই ২ উইকেটে ১৮৩ রান তুলে ফেলা পাকিস্তান যখন নিশ্চিত জয়ের দিকে এগোচ্ছে, ফাহিমা-রুমানার ১৩ বলেই তো ম্যাচটা ঘুরে গেল। ৫ রানের মধ্যে ৫ উইকেট পড়ল পাকিস্তানের, সম্ভাবনার নিক্তি পাকিস্তানের দিক থেকে হেলে গেল বাংলাদেশের দিকে।

ওই ৫ উইকেটের ৪টিই ফাহিমা-রুমানার। ফাহিমারই ৩ টি, ম্যাচের সেরা হিসেবে তাঁকে বেছে নিতে তাই আর দুবার ভাবতে হয়নি আয়োজকদের। আর ওই ১৩ বলে এক উইকেট নেওয়া রুমানার হাতেই তো পাকিস্তানকে প্রথম ধাক্কাটা দিতে পেরেছিল বাংলাদেশ। দারুণ শুরু পেয়ে যাওয়া পাকিস্তানের ৯১ রানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙেছেন রুমানা, পাকিস্তানের উদ্বোধনী ব্যাটার নাহিদাকে বোল্ড করে।

রুমানা বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটে বড় নামই। ৪৫ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে ১৮ ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়কত্বও করেছেন ৩০ বছর বয়সী লেগ স্পিনার। ৪৮ ওয়ানডে উইকেটের শেষ দুটিতে আজ বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ রাঙানোয় বড় ভূমিকাও তাঁর। কিন্তু ফাহিমা? তাঁর গল্প তো আরও চমকে দেবে।

নিদা খাতুনের উইকেটের উদ্‌যাপন ফাহিমা-রুমানার
ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক ৯ বছর আগে, কিন্তু এত বছরে টি-টোয়েন্টি ৬০টি খেলে ফেললেও ফাহিমা আজকের আগে ওয়ানডে খেলেছেন মাত্র ১৮ টি, তাতে উইকেট মাত্র ৮ টি! বিশ্বকাপেও আগের দুই ম্যাচে সুযোগ পাননি। হঠাৎ আজ তাঁকে কী ভেবে সুযোগ দেওয়া? অধিনায়ক নিগার সুলতানার কাছে জানা গেল সেটি, ‘এই মাঠে আগের দুই ম্যাচ দেখেছি, সেখানে স্পিনাররাই আধিপত্য বিস্তার করেছে। তাই আমরা ভেবেছি ও যদি নিজের সেরাটা দিতে পারে তাহলে ওকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারব।’

ফাহিমা সেরাটা দেওয়াতেই বাংলাদেশের ইতিহাস! ৪২ তম ওভারের আগে নিজের প্রথম পাঁচ ওভারে ২১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন, ষষ্ঠ ওভারের (৪২ তম ওভার) প্রথম পাঁচ বলে দিলেন ৪ রান। ততক্ষণে পাকিস্তান ১৮৩ /২। ওভারের শেষ বল থেকে ফাহিমার জাদু দেখানোর শুরু, পাকিস্তানের পতনেরও।

ওমাইমাকে ফেরালেন ফাহিমা, তার পরের ওভারে রুমানা ফেরালেন নিদা দারকে। ৪৪ তম ওভারে ফাহিমার আরও বড় ধাক্কা, পরপর দুই বলে দুই উইকেট। এমন ধাক্কায় বেসামাল পাকিস্তান ওভারের শেষ বলে উইকেট হারাল রানআউটেও। চোখের পলকে পাকিস্তানের স্কোর ১৮৮ /৭! গায়ে চিমটি কেটে বিশ্বাস করতে হয়!

৯১ রান তুলে ফেলা পাকিস্তানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙেছেন রুমানা
ছবি: এএফপি

শেষ পর্যন্ত সিদরা আমিনের প্রথম ওয়ানডে শতক ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ ৯ রানে ম্যাচও জিতে গেল। জয়ের নায়িকা? পুরো দলই কৃতিত্ব পাবে। ব্যাট হাতে ফারজানার ৭১ কিংবা শারমিন-নিগারের দুটি চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস, ফিল্ডিংয়ে তিনটি রানআউট বাংলাদেশের মেয়েদের ‘দল’ হয়ে জেতার গল্পই বলে। তবু ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া ১৩ বলে পাদপ্রদীপের আলোটা দুই লেগ স্পিনারের ওপরই থাকে।

বাংলাদেশের ছেলেদের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার স্বপ্ন দেখা কোনো ক্রিকেটারকেও হয়তো মেয়েদের এই ম্যাচ নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে। সেই যে শতাব্দীর প্রথম দশকে ‘ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি লেগ স্পিনটাও জানা’ এক অলক কাপালি এসেছিলেন, এরপর থেকেই ছেলেদের দলে একজন লেগ স্পিনারের অপেক্ষা চলছে। মাঝে জুবায়ের-তানভীরের পর লেগ স্পিনার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার চলতি সংস্করণে আমিনুল ইসলামকে নিয়েও তেমন উচ্চবাচ্য নেই।

বছরের পর বছর নির্ভরতা জোগানো রুমানা বা হঠাৎ ঝলক দেখানো ফাহিমার মতো একজনের অপেক্ষা ছেলেদের দলের যে কবে ফুরোবে!