তিন নতুন মুখের গল্প

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ওয়ানডে দলে ডাক পেয়েছেন তিন নতুন ক্রিকেটার হাসান মাহমুদ, শরিফুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান। চলুন দেখে নেওয়া যাক তাঁদের তিনজনের কাছ থেকে কী দেখার প্রত্যাশা করতে পারেন সমর্থকেরা—

মেহেদী হাসান

২০১৮ বিপিএলের কথা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের অনুশীলন প্রায় শেষে। মূল বোলাররা সবাই পা তুলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। স্থানীয় নেট বোলাররাও ক্লান্ত। দলের মূল ব্যাটসম্যানদের বোলিং করে ক্লান্ত প্রায় প্রত্যেকেই। তাঁদের বিপক্ষেই ব্যাটিং করছিলেন মেহেদী হাসান।

লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং করেন। বিপিএলের দেশি-বিদেশিদের ভিড়ে ম্যাচ কিংবা অনুশীলনে, কোথাও ঠিকমতো ব্যাটিং পান না। অনুশীলনে সুযোগ পেলেও দলের মূল বোলারদের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের সুযোগ হয় না। ক্লান্ত স্থানীয় নেট বোলাররাই ভরসা। এক একটি বল বোলারদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন আর বলছিলেন, ‘একটু যদি রান করতে পারতাম তাহলে ভালো হতো।’

সেই মেহেদী পরের বিপিএলে ১২ ম্যাচে ছক্কা মারেন ১৭টি, বাংলাদেশিদের মধ্যে যা ছিল টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ। তিন ফিফটিতে করেন ২৫৩ রান করেন। পুরো টুর্নামেন্টে তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ১৩৬। কিছু ইনিংসে স্ট্রাইক রেট ছিল ১৫০–এর বেশি। বিশেষ করে স্পিনারদের বিপক্ষে মেহেদী ছিলেন বিধ্বংসী। এক বছর আগে যেই মেহেদী ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাচ্ছিলেন না, সেই মেহেদী পরের বিপিএলে ওপেনিংয়ে নামছিলেন ঢাকা প্লাটুনের হয়ে!

দারুণ পারফরম্যান্স দিয়েই দলে এসেছেন মেহেদী।
ছবি: প্রথম আলো

বিপিএল ফর্ম দিয়ে টি-টোয়েন্টি দলের সঙ্গে জাতীয় দলেও জায়গা করে নেন ২৬ বছর বয়সী মেহেদী। বিপিএলে তিনি যা করেছিলেন জাতীয় দলের তাঁকে সেই দায়িত্ব দিয়ে টপ অর্ডারে খেলানো হয়। কিন্তু পাকিস্তানি পেসারদের গতির বিপক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন না মেহেদী। স্পিনে বুক ফুলিয়ে চার-ছক্কা মারার দক্ষতা অর্জন করেছেন কিন্তু গতির বিপক্ষে প্রশ্ন ছিল সামর্থ্যে যা মেহেদীর নিজেরও জানা ছিল।

তিনি ঠিক তাই করেছেন, যা যেকোনো ভালো ক্রিকেটার করেন। তিনি ফিরে গেলেন ড্রইং বোর্ডে। বের করেন নিজের খুঁত। কঠোর পরিশ্রম করে আবার ফিরে আসেন নতুন চেহারায়। করোনার লম্বা বিরতির পর বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্ট কাপে সেই মেহেদী পেসারদের বিপক্ষেও ছক্কা মারছিলেন অনায়াসে।

বোলিংয়ের উন্নতিটা আরও স্পষ্ট। দুই বছর আগেও মেহেদী ছিলেন সাধারণ অফ স্পিনার। উইকেটের সাহায্য থাকলে দিন ভালো যাবে। না থাকলে ভিন্ন গল্প। স্টক ডেলিভারি অফ স্পিনের সঙ্গে অন্য সব বাংলাদেশি অফ স্পিনারের মতো আর্ম বল—বৈচিত্র্য বলতে এইটুকুই। গত বিপিএলে বোলিংয়ে যোগ করেন নতুন বৈচিত্র্য। আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবীর মতো নতুন বলটা কীভাবে যেন ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের থেকে বের করে নিয়ে যান মেহেদী। বলটা করেন বেশ জোরের ওপর। যেকোনো নতুন ব্যাটসম্যানের জন্য বলটি বুঝে ওঠা মুশকিল।

গত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে মেহেদী দেখান আরেক জাদু। চাইলে এখন তিনি পেসারদের মতো ইয়র্কারও দিতে পারেন! এই বলটির কারণে মেহেদী স্পিনার হয়েও এখন নিয়মিত বল করেন টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ডেথ ওভারে। এই মুহূর্তে সাদা বলের ক্রিকেটে ডেথ ওভারে স্পিন করার সামর্থ্য আছে, এমন বোলার খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হবে। ইয়র্কার ও নিয়ন্ত্রণের কারণে মেহেদী এখন যেকোনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিন অবস্থার বোলার। শুরুতে, মাঝে ও শেষে সমান কার্যকরী বোলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। কে জানে, টি-টেন লিগের দল বাংলা টাইগার্স হয়তো মেহেদীর এই গুণ দেখেই তাঁকে দলে নিয়েছে।

এবার জাতীয় দলের হয়ে একই দক্ষতা দেখানোর পালা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দলে ডাক পেয়েছেন তিনি। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন গত দুই বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে মেহেদীর পারফরম্যান্সে মুগ্ধ। এবার আন্তর্জাতিক কেমন করেন, সেটা দেখতে চান।

বিপিএলে ভালো খেলেছেন হাসান।
ছবি: প্রথম আলো

হাসান মাহমুদ

তরুণ পেসার হাসান মাহমুদও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ওয়ানডে দলে প্রত্যাশিতভাবে ডাক পেয়েছেন। ২১ বছর বয়সী এই পেসার ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে বল করেন। গতির সঙ্গে দুই দিকের সুইং হাসানকে বাকি তরুণ পেসারদের থেকে আলাদা করেছে। দারুণ স্লোয়ার ডেলিভারি আগেই ছিল। গত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি থেকে ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার ডেলিভারি যোগ করেন নিজের অস্ত্রাগারে। এর বাইরে পরিস্থিতি বুঝে বোলিং হাসানের বড় গুণ।

সঙ্গে আছে ধারাবাহিকতা। প্রায় প্রতিটি প্রস্তুতি ম্যাচেই তিনি ভালো করছেন। প্রতিটি নেট সেশনে হাসানকে আলাদা করা খুবই সহজ। কারণ, জাতীয় দলের অভিজ্ঞদের যে সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলেন এই হাসানই। এসবই ছিল প্রত্যাশিত। চোট না থাকলে হয়তো ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা হাসান আরও আগেই আসতেন জাতীয় দলের ডেরায়। চোটের কারণে নিউজিল্যান্ডে যুব বিশ্বকাপের পর প্রায় দেড় বছর মাঠের বাইরে থাকেন হাসান।

তবে মাঠে ফেরার পর আর বেশি সময় নেননি তিনি। ইমার্জিং এশিয়া কাপ, এসএ গেমসের দারুণ পারফরম্যান্সের পর আসে বিপিএল। সেখানেও ভালো করায় সুযোগ আসে জাতীয় দলের খেলার। দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি অভিষেকও হয় হাসানের। জাতীয় দলের নেটে হাসানকে দেখে পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন হাসানকে বাংলাদেশ পেস বোলিংয়ের ভবিষ্যৎ ঘোষণা। সেই ভবিষ্যৎ এখন সুযোগ পেয়েছেন ওয়ানডে দলে।

শরিফুলের ওপর অনেক প্রত্যাশা।
ছবি: প্রথম আলো

শরিফুল ইসলাম

হাসানের সঙ্গে আরেক তরুণ পেসার শরিফুল ইসলামও প্রথমবারের মতো ওয়ানডে দলে ডাক পেয়েছেন। গত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে শরিফুল ছিলেন বাংলাদেশ দলের মূল বোলার। গতি ও আগ্রাসন শরিফুলের মূল শক্তি। উচ্চতার কারণে বাউন্সও পান। সঙ্গে বাঁহাতি হওয়ায় সহজাত অ্যাঙ্গেল শরিফুলকে আলাদা করে।

যুব বিশ্বকাপে খেলার আগে থেকেই শরিফুল ছিলেন বিসিবির রাডারে। বাংলাদেশ ‘এ’ দলে খেলেছেন। বিসিবি একাদশ, ইমার্জিং দল ও বিপিএলে খেলেছেন।

শুরুতে রানআপ ও অ্যাকশনে সমস্যা ছিল শরিফুলের। সোজা রেখায় দৌড়ে বোলিং করতে সমস্যা হতো ১৯ বছর বয়সী এই বাঁহাতির। গত কয়েক বছরে নিজেকে নতুন করে গড়েছেন। ফিটনেসে উন্নতির সঙ্গে গতিও বাড়ে। যুব বিশ্বকাপে ধারাবাহিকভাবে ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে বল করেছেন শরিফুল। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতেও শরিফুল ছিলেন দুর্দান্ত। অভিজ্ঞ বাঁহাতি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করেছেন তিনি। জাতীয় দলের নেটেও শরিফুলকে মনে হয়েছে তিনি ভিন্ন ধাতুর গড়া। সবই যেন একটু একটু করে শরিফুলকে সাহায্য করেছে ওয়ানডের মূল দলে জায়গা করে নিতে।

এই তিনজনকে নিয়েই নির্বাচকদের স্বপ্নটা বড়। ২০২৩ বিশ্বকাপ সামনে রেখে নতুনদের দেখার ইচ্ছা টিম ম্যানেজমেন্টের। সে জন্যই মেহেদী, হাসান ও শরিফুলের দলে ডাকা। এবার তাঁদের সুযোগটা দখল করার পালা। কাল প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন বলছিলেন, ‘আমরা তিনজন নতুনকে সুযোগ দিয়েছি, এটা পরিকল্পনার অংশ। এ সিরিজ থেকেই আমরা শুরু করছি। ওদের তৈরি করা এবং টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে রেখে কাজ করানোর জন্যই এই তিনজনকে রাখা।’