বল টেম্পারিং বোলারদের অসহায়ত্বের কথাও বলে!

শ্রীলঙ্কা সফরের দ্বিতীয় টেস্টে এভাবেই ক্যামেরাবন্দী হন স্টেইন। ছবি: রয়টার্স
শ্রীলঙ্কা সফরের দ্বিতীয় টেস্টে এভাবেই ক্যামেরাবন্দী হন স্টেইন। ছবি: রয়টার্স
অস্ট্রেলিয়ানদের বল টেম্পারিং সমর্থন করছেন না, তবে বোলারদের অসহায় দিকটাও তুলে ধরছেন দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলার।


কাজটা অন্যায় ছিল, সন্দেহ নেই। কারও চোখে ছিল প্রতারণা। গত মার্চে অস্ট্রেলিয়ানদের বল টেম্পারিং বিতর্ক আলোড়ন তুলেছিল বিশ্বজুড়েই।

তবে কাজটা যতই অন্যায়-প্রতারণা হোক না কেন, অন্য দিক থেকে ভাবলে এটি বোলারদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টাও। যদি ভাবতে পারেন ডেল স্টেইনের মতো করে। দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলারের চোখে, বল টেম্পারিং অবৈধ ঠিকই, তবে সেটি আসলে দিনে দিনে অসহায় হয়ে পড়া বোলারদের সাহায্যের আবেদন। কিছু একটা করার চেষ্টা।

টেস্টে শন পোলকের সমান ৪২১ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার যৌথ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনি, গত এক দশকের ভয়ংকরতম ফাস্ট বোলারদের তালিকা করলেও স্টেইনের নাম প্রথম কয়েকজনের মধ্যেই আসবে। অস্ট্রেলিয়ার সেই বল টেম্পারিং কাণ্ডটা ঘটেছেও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। অথচ স্টেইনই বলছেন এমন কথা!

বলবেন না-ই বা কেন! ক্রিকেটে এখন যত সুবিধা সব যেন ব্যাটসম্যানদের জন্য। যত নিয়মের বদল সব ব্যাটসম্যানদের দিচ্ছে আরও হাত খোলার সনদ, আর বোলারদের পায়ে বাঁধছে বেড়ি। ওভারে দুটির বেশি বাউন্সার দেওয়া যাবে না, নো-বলের শাস্তি ফ্রি-হিটে, ওয়ানডেতে দুই দিকে নতুন বল এসেছে, ব্যাটসম্যানদের ব্যাট ঢাউস হয়েছে, মাঠের আকার হচ্ছে ছোট...টি-টোয়েন্টির মারকাটারি বিনোদনের যুগে বল-ব্যাটের লড়াইয়ে ভারসাম্য আছে, সে দাবি আর কে করবে!

স্টেইন তো করবেনই না, ‘অবশ্যই এটা (বল টেম্পারিং) ঠিক নয়। তবে অন্যভাবে যদি ভাবেন, এটা (বোলারদের দিক থেকে) অনেকটা যেন সাহায্যের আবেদন। কিছু একটা করা দরকার আমাদের। এখন ব্যাটসম্যানদের পক্ষে কত কিছুই না আছে!’ ব্যাটসম্যান-বান্ধব নতুন সব নিয়মের ফিরিস্তি শেষে বললেন, ‘কখনো দেখিনি একটা নিয়ম আসছে, যেটা বোলারদের সাহায্য করছে।’ সে জন্যই কি বলের পাশাপাশি ক্রিকেটের আইন নিয়েও খেলতে শুরু করেছেন বোলাররা? হয়তো। স্টেইনের ভাবনা, বলে সুইং আনতেই এত নতুন নতুন পথের পেছনে ছুটছেন বোলাররা।

নতুন বলে সুইং সহজই। বলের সিম ধরাতেই যত কারিকুরি, তারপর বাতাসে বলটাকে বাঁক খাইয়ে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানানোর চেষ্টা। কিন্তু পুরোনো বলে? আশির দশকে পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুসরা যে রিভার্স সুইংয়ের শিল্প ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে, ওয়ানডেতে দুই দিকে নতুন বলের কারণে সেটিই এখন হারাতে বসেছে। বল পুরোনো হওয়ার সময়ই তো পাচ্ছে না! রিভার্স সুইং হবে কীভাবে!

অস্ট্রেলিয়ানদের বল টেম্পারিংয়ে ধরা পড়াও বলে রিভার্স সুইং আনতে গিয়েই। কেপটাউনে সেই টেস্টের তৃতীয় দিনে ১ উইকেট হারিয়েই দ্বিতীয় ইনিংসে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ১০০ রানের বেশি লিড নিয়ে ফেলেছিল, সিরিশ কাগজ দিয়ে বল খসখসে করে রিভার্স সুইংয়ের পরিকল্পনা ফেঁদেছিলেন অস্ট্রেলিয়ানরা। আড়ালে-আবডালে এমন পরিকল্পনা হয়তো অনেক দলই করে। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার মূল্য দিতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ানদের। সিরিশ কাগজ দিয়ে বলে ‘ঘষামাজা’র দায়িত্ব পালন করা ক্যামেরন ব্যানক্রফট নিষিদ্ধ হয়েছেন ৯ মাস। স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার অধিনায়কত্ব ও সহ-অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন, পেয়েছেন ১২ মাসের নিষেধাজ্ঞা।

ভারতে একটা প্রচারণা অনুষ্ঠানে এসে রিভার্স সুইং হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে স্টেইন বলেছেন, ‘রিভার্স সুইং যেদিন হারিয়ে যাবে, সেদিনটা দেখা হবে অনেক কষ্টের। আমি (ওয়াসিম) আকরামকে দেখে বড় হয়েছি। ওয়াকারকে (ইউনুস) দেখেছি। অন্য অনেক দারুণ বোলারদের দেখেছি, যাঁরা রিভার্স সুইং করাতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা দেখা যায় না। উদীয়মান ফাস্ট বোলারদের তাহলে আর প্রেরণার কী থাকল, যদি তারা ফাস্ট বোলার হতে অনুপ্রেরণা জোগানোর মতো এমন কাউকে আর না দেখে? এর চেয়ে তো একটা বোলিং মেশিন রেখে সবাই ব্যাটসম্যান হওয়ার চেষ্টাই শুরু করে দিতে পারে!’

রিভার্স সুইং ফেরাতে ওয়ানডেতে দুই প্রান্তে দুই বল নীতিটা পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব সম্প্রতি করেছিলেন ভারতীয় ব্যাটিং কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। সেটির পাশাপাশি স্টেইনের চাওয়া আরেকটু বেশি। তাঁর আপত্তি ওভারে দুই বাউন্সারে নিষেধাজ্ঞা নিয়েও, ‘ওরা নিয়মটা বদলে দিয়ে বলেছিল, আমরা দুটি নতুন বলে খেলব। কিন্তু উপমহাদেশের মতো জায়গায় তো আমি নতুন বল চাই না। পুরোনো বল চাই, যেটিকে সহজেই মাঠের বাইরে উড়িয়ে ফেলা যাবে না। এমন একটা বল চাই, যেটাতে বাউন্সে হেরফের হবে, যাতে ব্যাটসম্যান মারতে না পারে। এখনকার নিয়মগুলো বোলারদের মোটেও সাহায্য করছে না। যদি কারও উপকারে এসে থাকে, তবে সেটি ব্যাটসম্যানদেরই।’
আইসিসি কি শুনছে?