বার্সেলোনায় ক্রিকেট মাঠ, নেপথ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তরুণীরা

ভারত-পাকিস্তানের এই মেয়েরা বার্সেলোনায় ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মানের পরিকল্পনার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন।ছবি: সংগৃহীত

বার্সেলোনা... ক্রিকেট...

দুটি শব্দ এক সঙ্গে শুনতে কেমন যেন একটু খটকা লাগছে না!

বার্সেলোনা মানে তো লিওনেল মেসি। বার্সেলোনা মানে ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে চিরশত্রুতা। বার্সেলোনা মানে স্প্যানিশ ফুটবলের একটা অঙ্গ। বার্সেলোনা নামটা যে কেবল ফুটবলের সঙ্গেই যায়। একটা বাস্কেটবল দল থাকার কারণে একটু-আধটু সেটিও মনে করাতে পারে। কিন্তু তাই বলে ক্রিকেট?

ব্যাট-বলের ঠোকাঠুকির সঙ্গে বার্সেলোনার নামটা একবাক্যে লেখার সময় আসলেই এসেছে। ফুটবল-পাগল বার্সেলোনা শহরে একটা ক্রিকেট স্টেডিয়াম হতে যাচ্ছে। চমক শুধু এতটুকুই নয়, এ স্টেডিয়াম বলতে গেলে সেখানকার বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি কয়েকজন তরুণীর অবদান। অনেক দিন ধরেই এই তরুণীরা সেখানে ক্রিকেট খেলছেন। এখন তাঁদের দাবি, সেখানে সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একটা স্টেডিয়াম করে দিতে হবে। সে দাবি মেনে নিয়েছে বার্সেলোনা শহরের প্রশাসন!

ক্রীড়াক্ষেত্রে উন্নয়নের চেষ্টার অংশ হিসেবে বার্সেলোনার প্রশাসন সম্প্রতি ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ইউরো মূল্যের কোনো স্টেডিয়ামের প্রস্তাব দিয়েছিল, মানুষকে বলা হয়েছিল ভোট দিয়ে এর মধ্যে তাঁদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের প্রকল্প বেছে নিতে। অনেককে চমকে দিয়ে ৮২২টি প্রকল্পের মধ্যে বার্সেলোনার মানুষ বেছে নিয়েছেন ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রকল্পকেই!

কীভাবে এ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখল, সেটির পেছনের গল্প জানিয়েছেন সেখানে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতে থাকা ভারতীয় ও পাকিস্তানি তরুণীদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, ২০ বছরের হিফসা বাট।

হিফসা যখন মাধ্যমিকের ছাত্রী, তাঁদের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক স্কুলের সময়ের পর ক্রিকেট খেলার প্রস্তাব দেন। এরপর হিফসার বাবা সবাইকে ক্রিকেট খেলার খুঁটিনাটি ধরিয়ে দেন।

‘তিন বছর আগে মাধ্যমিক স্কুলে সবকিছু শুরু হয়েছিল, যখন আমাদের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক এসে বললেন, ‘‘আমরা এখন থেকে স্কুলের সময়ের পর খেলার জন্য একটা ক্রিকেট ক্লাব করব। কে কে যোগ দিতে চাও?’’...আমার বাবা আমাদের কীভাবে খেলতে হয়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন, এরপর আমরা নিজেরা নিজেরা খেলতে শুরু করলাম’—ইংলিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে বলছিলেন হিফসা।

খেলাটা পছন্দ হলো তরুণীদের। নিজেরা নিজেরা এরপর একটা ইনডোর ক্রিকেট লিগ আয়োজন করেন। ক্রিকেট মাঠ হিসেবে কাজে লাগানো হয় মন্তিউর একটা বাস্কেটবল মাঠকে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন! মেয়েরা এখন চান, তাঁদের নিজেদের একটা ক্রিকেট মাঠ হোক। যেখানে সবুজ ঘাস থাকবে, কাঠের বল থাকবে, ব্যাট-প্যাড সব থাকবে।

উইকেটকিপার নেইমার!
ছবি: টুইটার

‘একেবারে যথাযথভাবে ক্রিকেট খেলতে চাই আমরা। ১১ ক্রিকেটার নিয়ে। কাঠের বলে, ইনডোরে যে টেনিস বল দিয়ে খেলি, সেটাতে নয়। সে কারণে আমাদের এখন একটা যথাযথ ক্রিকেট মাঠ দরকার, যেখানে সিনথেটিক নয়, সত্যিকারের ঘাস থাকবে’—বললেন হিফসা।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো ক্রিকেটপ্রেমী দেশের অনুভবটা স্পেনেও ছড়িয়ে দিতে চান তাঁরা। হিফসার কথা, ‘আমরা পাকিস্তান ও ভারতের মেয়ে, যে দেশগুলো ক্রিকেট কী, সেটা জানে। আমরা এখন স্পেনে এ খেলার খবর ছড়িয়ে দিতে চাই।’

সে পথে যাত্রাটা একেবারে সহজ অবশ্য হবে না। প্রথমত স্টেডিয়াম যে বানাবে, সেটির জায়গা তো ঠিক করতে হবে। বার্সেলোনা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ক্লাবের অস্ট্রেলিয়ান সভাপতি ড্যামিয়েন ম্যাকমিউলেন বলছিলেন, ‘সমতল এবং ১৬০০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে আছে...এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করা বার্সেলোনায় প্রায় অসম্ভব।’

আপাতত মন্তিউর ছোট পাহাড়ের ওপরের সমতল চূড়াতে অ্যাস্ট্রোটার্ফ ক্রিকেট পিচ নিয়ে মাঠটা বানানোর পরিকল্পনা। প্রায় ১.২ মিলিয়ন বা ১২ লাখ ইউরোর এই পরিকল্পনাই বার্সেলোনার ক্রীড়াপ্রকল্পের পরিকল্পনা নিয়ে ভোটে ছক্কা হাঁকিয়েছে!

বার্সেলোনা যে রাজ্যের শহর, সেই কাতালুনিয়ায় এরই মধ্যে ২০টা ক্রিকেট ক্লাবও হয়ে গেছে বলে জানালেন ম্যাকমিউলেন। এই ক্লাবগুলোতে প্রায় ৭০০ ক্রিকেটার আছেন। মাদ্রিদ, আলিকান্তে, ভ্যালেন্সিয়া ও মিনোর্কাতেও এরকম ক্রিকেট খেলুড়ে দল আছে বলে জানিয়েছেন ম্যাকমিউলেন।

ইংলিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, মিনোর্কার দলটা পুরোপুরি ইংলিশ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া। বার্সেলোনার ক্লাবগুলোতে মূলত নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটার বেশি। লিগের কয়েকটা দল পুরোপুরিই ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশিদের নিয়ে গড়া বলে লিখেছে দ্য গার্ডিয়ান।

পাশের বাদালোনা অঞ্চলের ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি নাদিম আরমান যেমন দ্য গার্ডিয়ানে বলেছেন, তাঁর ক্লাব প্রায় পুরোটাই পাকিস্তান আর বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে তৈরি। তবে এখানে একটা সমস্যা দেখছেন নাদিম, ‘সমস্যাটা হলো আমাদের খেলার কোনো জায়গা নেই, আর সে কারণে মানুষকে এ খেলায় টেনে আনা আরও কঠিন হচ্ছে।’ তবে ম্যাকমিউলেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনিও জানিয়েছেন যে, বার্সেলোনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েই চলেছে।