বোল্যান্ডের গল্পটা মাথা তুলে দাঁড়ানোর
‘আমি বলি কি, অবসর নিয়ে নাও। আজকের খেলা শেষ হয়ে গেলে অবসর নাও স্কটি বোল্যান্ড। এই কীর্তি ছাপিয়ে যাওয়া যাবে না...’
ফক্স স্পোর্টস ধারাভাষ্য দলের হয়ে কথাগুলো বলতে বলতে মাইকেল ভনের হাসির শব্দটা বড্ড মেকি শোনাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে ভনের হয়তো বুক চিরে যাচ্ছিল। ইংলিশদের অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বোল্যান্ড এমসিজিতেই খান খান করেছেন। দশে নামা ওলি রবিনসন বোল্যান্ডের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে যখন ফিরছেন, অস্ট্রেলিয়ার জয় কেবলই সময়ের ব্যাপার। পরে জেমস অ্যান্ডারসনকে বোল্ড করে আনুষ্ঠানিকতাটাকু সারেন ক্যামেরন গ্রিন।
ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে এই ‘শেষকৃত্যে’র আগে ‘বিগ জি’–র মঞ্চে নায়ক ৩২ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়া সেই বোল্যান্ডই।
মাইকেল ভন এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি। জশ হ্যাজলউডের জায়গায় আগের টেস্টেই জায়গা পাওয়া ঝাই রিচার্ডসন ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। এই টেস্টে রিচার্ডসন ফিট থাকলে হয়তো বোল্যান্ডের খেলাই হতো না। টেস্টের শুরুতে যার হাত থেকে পরম আরাধ্য ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পেয়েছেন, সেই হ্যাজলউডও পরের টেস্টে ফিরতে মরিয়া। তিনি ফিট থাকলে বোল্যান্ড তো দূর, রিচার্ডসনেরই জায়গা হয় না একাদশে।
এই হিসেব জানেন বোল্যান্ডও—কামিন্স, স্টার্ক ও হ্যাজলউডদের জমানায় অস্ট্রেলিয়া দলে উঁকিঝুঁকি দিয়েই কাটিয়ে দিতে হতে পারে বাকি ক্যারিয়ার। তিনি পাঁচদিন আগেও ভাবেননি অ্যাশেজের মতো সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে ঘরের মাঠে খেলার সুযোগ পাবেন। কল্পনাতীত ব্যাপারটাই বাস্তবে ফলে যাওয়ার পর স্টার্ক-কামিন্সের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমসিজির বাইশগজি পিচকে ইংলিশদের জন্য ‘নরক’ বানিয়েছেন বোল্যান্ড। ফুল লেংথে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের অসাধারণ বিজ্ঞাপন দেখিয়ে ২৪ বলে ৭ রানে নিয়েছেন ৬ উইকেট।
ম্যাচ শেষে তাঁর বোলিং ফিগার দাঁড়িয়েছে ১৭ ওভারে ৫৫ রানে ৭ উইকেট। অর্থাৎ প্রতি ৭.৮৫ রানে ১টি করে উইকেট পেয়েছেন বোল্যান্ড। ন্যূনতম কত ম্যাচ খেলেছেন, সেটা ধর্তব্য না হলে; টেস্ট ইতিহাসে অন্তত ৫ উইকেট পাওয়া বোলারদের মধ্যে সর্বকালের সেরা এখন বোল্যান্ড। টেস্টের এক ইনিংসে এর চেয়ে কম রানে ৬ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড মাত্র একটি।
বোল্যান্ড আগের দিনের শেষ ভাগে অসাধারণ এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের কল্যাণে। ততক্ষণে মাত্রই হাসিব হামিদ আর জ্যাক লিচকে আউট করে নিজের ফিল্ডিং করার জায়গায় ফেরত যাচ্ছিলেন বোল্যান্ড। ২২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড তখন থরথরিয়ে কাঁপছে। পরের ওভারে অধিনায়ক কামিন্স নিজেই বল করার আগে বোল্যান্ডকে পাঠান থার্ডম্যানে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, মেলবোর্নের দর্শকেরা যেন আরও কাছ থেকে ঘরের মাঠের নায়ককে দেখতে পারেন, অভ্যর্থনা জানাতে পারেন মন ভরে। বোল্যান্ডও যেন উপভোগ করতে পারেন দর্শকদের ভালোবাসা।
এই টেস্টে বোল্যান্ডের প্রত্যেকটি বিশেষ মূহুর্তকে স্বাগতিক দর্শকেরা স্বাগত জানিয়েছে উত্তুঙ্গ উদ্যমে, গগনবিদারী উত্তেজনায়। তা টেস্টের শুরুতে বোল্যান্ডের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পাওয়া থেকে শুরু করে মার্ক উডকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলে প্রথম টেস্ট উইকেট পাওয়া, কিংবা জেমস অ্যান্ডারসনের বলে স্লিপ কর্ডন দিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম রান—বোল্যান্ডের সব অর্জনে উপস্থিত প্রায় সাড়ে ৪২ হাজার দর্শকদের চিৎকার শুনে মনে হয়েছে, ব্রাজিলের মারাকানার মতো লাখখানেক ক্রীড়ামোদী এসে হাজির হয়েছে বুঝি!
বোল্যান্ডের স্বপ্নের মতো অভিষেকটা পূর্ণতা পেয়েছে ম্যাচসেরার পুরষ্কার জনি মাল্লা মেডেল পাওয়ার মাধ্যমে। কে এই জনি মাল্লা? একটু পেছনে ফেরা যাক।
রুলস ফুটবল বা রাগবির মতো খেলায় অস্ট্রেলিয়ার দলে আদিবাসী খেলোয়াড়দের আধিক্য থাকলেও সে তুলনায় দেশটার ক্রিকেট দল ঢের পিছিয়ে। আদিবাসী কোনো খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট খেলে বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেকে তুলে ধরছেন, অস্ট্রেলিয়ায় এমন দৃশ্যপট এক সময় কল্পনাও করা যেত না। ১৮৬৮ সালে শুধু আদিবাসীদের নিয়ে গড়া একাদশ নিয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছিলেন জনি মাল্লা। তাঁর মতো আরও অনেক আদিবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলার। জাতিগত দ্বেষ, বর্ণবাদ, শ্রেণীগত বৈষম্যের কারণে সে স্বপ্নটা কখনই সেভাবে পাখা মেলতে পারেনি।
মাল্লা নিজের ক্যারিয়ারও শেষ হয়েছে ভিক্টোরিয়ার হয়ে একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেই। প্রায় ১৫০ বছর পর মাল্লার কীর্তির দাম দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, গত বছর জায়গা দিয়েছে নিজেদের ক্রিকেটের ‘হল অফ ফেম’–এ। মাল্লার সেই দলকে তখন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দেওয়া অস্ট্রেলিয়া এখন দলটাকে নিজেদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মনে করে। সে ঐতিহাসিক সফরের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার এক আদিবাসী দল ইংল্যান্ড সফর করে এসেছিল।
ড্যান ক্রিস্টিয়ান, ডার্সি শর্ট সহ সে সফরের উল্লেখযোগ্য ক্রিকেটার ছিলেন এই স্কট বোল্যান্ড। কারণ? বোল্যান্ডের পূর্বপুরুষ যে আদিবাসীই ছিলেন!
২৫ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের এই পরিচয় সম্পর্কে জানতেন না বোল্যান্ড। এখন নিজেকে গর্বিত আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। মাল্লা যে কাজটা করতে পারেননি, মেলবোর্ন টেস্টে কোনো বল মাঠে গড়ার আগে জেসন গিলেস্পির পর প্রথম আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ময়দানে নেমে সে কীর্তিটাই গড়েছেন বোল্যান্ড। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন স্বজাতির ওপর যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা সকল অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ডানহাতি পেসারের এই পরিচয়ই তাঁর ছয় উইকেট পাওয়া, ম্যাচসেরা হওয়াকে মহিমান্বিত করে তুলেছে।
হাজারো অর্জনের অভিষেক টেস্টের পর ভনের কথা শুনে বোল্যান্ড এখন যদি অবসরও নিয়ে নেন, কোনো আক্ষেপ থাকবে তাঁর? ঘরের মাঠে অভিষেক টেস্টে ৫৫ রানে ৭ উইকেট নিয়ে দেশেই ভষ্মাধার (অ্যাশেজ) রেখে ম্যাচসেরা হতে পারেন ক’জন!