যেভাবে ফিরতে পারেন বিশ্বকাপের সাকিব

২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আলছবি: প্রথম আলো

সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা শেষ। এবার মাঠে ফিরে নিয়মিত খেলতে চান গত বিশ্বকাপের খেলাটাই। বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সটাকেই নতুন শুরুর মানদণ্ড ধরতে চান তিনি। তবে আট ম্যাচে ৬০৬ রান, ১১ উইকেট—বিশ্বকাপের অবিশ্বাস্য এই ফর্ম ধরে রাখা সহজ কথা নয়। সাকিব কীভাবে পারলেন বিশ্বকাপজুড়েই এমন অতিমানবীয় ক্রিকেট খেলতে? কী করলে এক বছর পর মাঠে ফিরে আবারও তিনি খেলতে পারবেন সেই ক্রিকেট? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা যাক—

দুর্দান্ত ফিটনেস
‘আইপিএলই বিশ্বকাপ প্রস্তুতির আদর্শ জায়গা’—২০১৯ বিশ্বকাপের আগে কথাটা বলেছিলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। গত বিশ্বকাপজুড়ে স্টোকস যেমন দাপুটে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, সাকিব আল হাসানও ঠিক তা-ই করেছেন। আইপিএলে স্টোকসের মতো ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি সাকিবের। সানরাইজার্স হায়দরাবাদে চার বিদেশিদের ভিড়ে তাঁর জায়গাই হয়নি। ম্যাচ না খেলায় হাতে ছিল প্রচুর সময়। সেই সময় সাকিব কাজে লাগিয়েছেন ফিটনেস ও দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করে। দেশ থেকে প্রিয় কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আইপিএলের সময় সাকিবকে সাহায্য করেছেন তিনি; প্রস্তুতির মূল উদ্দেশ্য যদিও ছিল বিশ্বকাপ।

এবারও বিকেএসপিতে সাকিবের ফেরার প্রস্তুতির বড় অংশজুড়ে ছিল ফিটনেস। বিশ্বকাপের আগে সাকিবকে দেখে সবাই চমকে গিয়েছিল। ওজন কমিয়ে যেন ফিরে গিয়েছিলেন কৈশোরে! এবারও ঠিক তা-ই। প্রায় এক মাস বিকেএসপিতে সময় কাটিয়েছেন নিজেকে প্রস্তুত করতে। সাহায্য নিয়েছেন সালাউদ্দিনের। দীর্ঘদিন খেলা-অনুশীলনে না থাকায় ফিটনেসেই বেশি জোর দেন সাকিব।

অনুশীলনে সাকিব আল হাসান।
ফাইল ছবি

বিশ্বকাপে ফিটনেস ভালো থাকায় লম্বা ইনিংস খেলতে পেরেছেন স্বচ্ছন্দে। বিশ্বকাপে সাকিবকে খেলতে হয়েছে কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিডি, জফরা আর্চার, মার্ক উড, মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্সদের বল। গতিময় বোলিং খেলতে ফিটনেস ভালো হতেই হয়। ক্লান্তি পেয়ে বসলে শট নির্বাচনে ভুল হয়, শট খেলাটাও কঠিন হয়ে যায়, ক্লান্তিতে হাতের ব্যাটটাও যেন ঠিকমতো পোষ মানতে চায় না। বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের সামাল দিতে বিশ্বকাপে সাকিবের যেমন ফিটনেস থাকা দরকার ছিল, তেমনই ছিল। এবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে সাকিবকে খেলতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শ্যানন গ্যাব্রিয়েল, কেমার রোচ, জেসন হোল্ডার, শেল্ডন কটরেলের মতো পেসারদের। কে জানে, ফিট সাকিব হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই আগের রূপে ফিরবেন।

অন্যের আয়নায় নিজেকে দেখা

আইপিএলের সময়টায় সাকিব তাঁর চেনা প্রায় সব ক্রিকেট বিশ্লেষকের (অ্যানালিস্ট) সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। তাঁদের নিজের ব্যাটিংয়ের খুঁত খুঁজে বের করতে বলেছিলেন। উদ্দেশ্য, প্রতিপক্ষ দল তাঁকে কীভাবে আউট করার ছক আঁকে, সেটি তাদের আয়নাতেই দেখে নেওয়া। কোচ সালাউদ্দিনের সঙ্গে সাকিবের দক্ষতার অনুশীলনটাও হয় সেই অনুযায়ী। সাকিব জানতেন, বিশ্বকাপে তিন নম্বরে ব্যাট করতে হলে তাঁকে দ্রুতগতির বোলারদের খেলতে হবে। পাঁজর বরাবর বোলিং করে সাকিবকে চাপে ফেলা হবে। থ্রি কোয়ার্টার লেংথ থেকে জোরের ওপর অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে বল করা হবে। এই বলগুলোয় সাকিব যেভাবে রান করার উপায় বের করেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ।

বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাকিব।
ছবি: প্রথম আলো

আর্চার, উডদের শর্ট বলের বিপক্ষে বিশ্বকাপে যেভাবে জায়গা বানিয়ে সাবলীল ব্যাটিং করেছেন, সেটিও সাকিবের জন্য নতুন ছিল। এত গতির বিপক্ষে জায়গা বানিয়ে খেলা সহজ তো নয়! আগে বাউন্সারের বিপক্ষে এলোপাতাড়ি হুক খেলতেন সাকিব। শেষ পর্যন্ত আউট হতেন। বিশ্বকাপে হুক খেলেছেন অনেকটা নিয়ন্ত্রিতভাবে। যেখানে ঝুঁকি কম, কিন্তু পুরস্কার বেশি।

বিশ্বকাপে প্রায় প্রতি ম্যাচেই সাকিব নামেন ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে। কিন্তু কোনো ম্যাচেই শুরুতে তাঁকে তাড়াহুড়ো করতে দেখা যায়নি। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে ব্যবহার করতে হবে। দ্রুত কিছু রান তুলে রাখতে হবে। এসব তাড়ার ফাঁদে পড়ার ভুল করেননি সাকিব। প্রচুর এক-দুই রান নিয়েছেন। কমপক্ষে ৩০ ওভার ব্যাটিং করে যাওয়ার লক্ষ্য ছিল তাঁর। এক শ করার পণ করেই যেন প্রতিটি ম্যাচে খেলতে নেমেছিলেন। রান করার এই ক্ষুধা নিশ্চয়ই ক্রিকেটে ফিরেও ধরে রাখতে চাইবেন সাকিব।

নিজের সেরা সময়টা খুব ভালো চেনেন সাকিবের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটাররা। সেরা সময়ে প্রতিপক্ষকে যেমন ছাড় দিতে চান না, নামের পাশে থাকা পরিসংখ্যানের সংখ্যাগুলোও বাড়িয়ে নিতে চান দুই-তিন গুণ।

স্পিনে আগ্রাসন
স্পিন বলে সাকিব ডেভিড ওয়ার্নার, জনি বেয়ারস্টোর মতো খেলতে চেয়েছিলেন। কোচ সালাহউদ্দিনের কাছে এই আকুতি ছিল তাঁর। ২০১৯ আইপিএলে ওয়ার্নার-বেয়ারস্টো জুটির সামনে কেউ দাঁড়াতেই পারছিলেন না। স্পিনের বিপক্ষে এই দুই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংটা খুব টানছিল সাকিবকে। একটু শর্ট বল পেলে দুজনই ব্যাকফুটে গিয়ে পুল শটে চার-ছক্কা মেরে দেন। পুরোটাই শক্তি আর পায়ের কাজের খেলা। সাকিবও সেই শক্তি, সেই পায়ের কাজ নিজের ব্যাটিংয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বিশ্বকাপে তিনি দাপট দেখিয়েছেন মাঝের ওভারে, যখন বেশির ভাগ সময় খেলতে হয়েছে স্পিনের বিপক্ষে। সাকিবের সামনে স্পিনারদের বাজে বলের শাস্তি পেতেই হয়েছে।

মাঝে লম্বা বিরতি গেলেও সাকিব সেই ছন্দটা ধরে রাখতে চাইবেন নতুন করে মাঠে ফেরার পরও। নিজের সেরা সময়টা খুব ভালো চেনেন তাঁর মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটাররা। সেরা সময়ে প্রতিপক্ষকে যেমন ছাড় দিতে চান না, নামের পাশে থাকা পরিসংখ্যানের সংখ্যাগুলোও বাড়িয়ে নিতে চান দুই-তিন গুণ। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, স্টিভ স্মিথরা কয়েক বছর ধরে এটাই করছেন। আগে কুমার সাঙ্গাকারা, এবি ডি ভিলিয়ার্স, হাশিম আমলারাও তা–ই করে গেছেন। এবার হয়তো সাকিবের পালা।