রোমাঞ্চকর শেষ দিনে অস্ট্রেলিয়ার জয়

পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর অস্ট্রেলিয়া দলের ফটোসেশনছবি: এএফপি

ভুভুজেলার আওয়াজ থেমে গেল, থেমে গেল দর্শকদের উল্লাস। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ভোকাল কর্ডটা কেউ যেন হুট করেই ছিঁড়ে দিয়ে গেল ওই সময়। নাথান লায়নের অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা টার্ন করে ভেতরে ঢুকছিল, ডিফেন্ড করতে গিয়ে বাবর আজমের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল গেল স্টিভ স্মিথের কাছে। গতকাল দিনের শেষ ওভারের পঞ্চম বলে আবদুল্লাহ শফিকের ক্যাচটা ছেড়েছিলেন স্মিথ। এবার ভুল করলেন না আর।

সিরিজে আগের ১৪ দিনের ক্রিকেট, রাওয়ালপিন্ডির ম্যাড়মেড়ে ম্যাচের পর করাচিতে মহাকাব্যিক লড়াইয়ের দুইটি টেস্ট ম্যাচ দুই দলকে আলাদা করতে পারেনি। সব এসে ঠেকেছিল শেষ টেস্টের এই শেষ দিনে। অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের মাটিতে তাদের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের মধ্যে ব্যবধান হয়ে ছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক বাবরই। ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে বাবর ফিরলেন, পাকিস্তানের প্রতিরোধের শেষ দেয়ালটা যেন ভেঙে পড়ল তাতেই।

অস্ট্রেলিয়া সুযোগ হাতছাড়া করেনি আর। আগের দিন তাদের ইনিংস ঘোষণার সময়ই পাওয়া গিয়েছিল আক্রমণাত্মক মানসিকতার ইঙ্গিত, শেষ পর্যন্ত সফল তাঁরাই। ১১৫ রানের জয়ে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, ২৪ বছর আগে পাকিস্তানের মাটিতে সর্বশেষ সিরিজেও জয়ী দলের নামটা একই ছিল।

পাকিস্তানের আশা হয়ে থাকা বাবরও শেষ দিনে হার এড়াতে পারলেন না। আউট হওয়ার পর
ছবি: এএফপি

পঞ্চম দিনে মাঝেমধ্যে একটু আক্রমণ ছাড়া পাকিস্তান ছিল রক্ষণাত্মক। ঘুরেফিরেই এদিন আলোচনায় এসেছে রিভিউ। কখনো টেলিভিশন আম্পায়ার অন-ফিল্ডের সিদ্ধান্ত বদলেছেন বিতর্কিতভাবে, কখনো ব্যাটসম্যান অযাচিত রিভিউ নিয়ে নষ্ট করেছেন, কখনো রিভিউ না নিয়ে উইকেট হারিয়েছেন, কখনো বা ফিল্ডিং দল হাতছাড়া করেছে রিভিউ নিয়ে উইকেট পাওয়ার সুযোগ। দিন শেষে লড়াইয়ে বাড়তি রোমাঞ্চই জুগিয়েছে সেসব!

বিনা উইকেটে ৭৩ রান নিয়ে পঞ্চম দিন শুরু করেছিল পাকিস্তান। প্রথম ওভারেই প্যাট কামিন্সকে চার মেরেছিলেন ইমাম-উল-হক। তবে পাকিস্তানকে দ্রুতই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দিনের তৃতীয় ওভারে ক্যামেরন গ্রিন প্রথম ব্রেকথ্রু এনে দেওয়াতে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে আবদুল্লাহ শফিক কট বিহাইন্ড হলে ভাঙে ৭৭ রানের উদ্বোধনী জুটি।

আজহার আলী নামার পর খোলসবন্দীই ছিলেন, ৩৯তম ওভারের আগপর্যন্ত। ওই ওভারে দুই চার মেরেছিলেন, তবে সে পর্যন্তই। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ফিরতে হয়েছে টেলিভিশন আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে। লায়নের অফ স্টাম্পের বাইরের বল সুইপ করতে গিয়েছিলেন আজহার, প্যাড থেকে বল উঠেছিল স্লিপে। তবে বেশ কয়েকবার রিপ্লে দেখার পর টিভি আম্পায়ার আসিফ ইয়াকুবের মনে হয়েছে, আলট্রা-এজে পার্থক্য করার মতো স্পাইক আছে।

পাকিস্তানের রক্ষণাত্মক ব্যাটিংয়ের সুবিধা নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা। উইকেট নেওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ানদের উদ্‌যাপন
ছবি: এএফপি

শুক্রবার বলে বর্ধিত প্রথম সেশনে খেলা হয়েছে আড়াই ঘণ্টা, ৩৩ ওভারে পাকিস্তানের তোলা ৬৩ রানই ইঙ্গিত দিয়েছিল তাদের মনোভাব—লড়াইটা ড্রয়ের জন্যই। সে লড়াইয়ে স্বাগতিকদের পরের আঘাতটা করেন লায়নই, বিরতির পর দ্বিতীয় ওভারে লায়নের বলে ফ্লিক করতে গিয়ে ব্যাট-প্যাডে ক্লোজ-ইনে ধরা পড়েন ৭০ রান করা ইমাম। রিভিউ নিয়েছিলেন, যদিও আলট্রা-এজে বড়সড় স্পাইকই ধরা পড়েছে।

পরের দুইটি উইকেট পাকিস্তান হারিয়েছে ২ রান ও ১২ বলের ব্যবধানে—এবারও আলোচনায় এসেছে রিভিউ। প্যাট কামিন্স তাক করছিলেন ব্লকহোল, ফাওয়াদ আলম ও মোহাম্মদ রিজওয়ান ধরা পড়েছেন তাতেই। ফাওয়াদের পর এলবিডব্লিউ হয়েছেন রিজওয়ানও। ফাওয়াদ রিভিউ নষ্ট করেছেন, রিজওয়ান রিভিউ নেননি। তবে পরে বল ট্র্যাকিং দেখিয়েছে, রিভিউ নিলে বেঁচে যেতেন আগের টেস্টে দারুণ এক শতক করা রিজওয়ান—ইমপ্যাক্ট ছিল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে। এর আগে ফাওয়াদের বিপক্ষে একটা রিভিউ নষ্ট করেছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্রুত ২ উইকেটের পর বাবর আজমকেও দ্রুত ফেরাতে পারত অস্ট্রেলিয়া। ২০ মিনিটের মধ্যে দুইবার জীবন পান বাবর। ৪০ রানে লায়নের বলে স্মিথের হাতে ক্যাচ তুলেও বাবর বাঁচেন অস্ট্রেলিয়া রিভিউ না নেওয়ায়, ৪৫ রানে ট্রাভিস হেড না বুঝে উঠতে পেরে হাতছাড়া করেন ক্যাচ।

পাকিস্তানের শেষ উইকেটটি নিয়ে জয়ের আনন্দে ভেসে যান স্মিথ–কামিন্সরা
ছবি: এএফপি

৮১তম ওভারের ২ বল পরই দ্বিতীয় নতুন বল নেয় অস্ট্রেলিয়া, তবে এরপর স্টার্কের ওভারে আসে তিনটি চার। ৮১ থেকে ৮৩তম ওভারে ২২ রান ইঙ্গিত দিচ্ছিল, আক্রমণকেই রক্ষণের সবচেয়ে বড় উপায় মনে করছে পাকিস্তান। তবে কাজ হয়নি তাতে। বাবর হার মেনেছেন লায়নের কাছে, এরপর স্টার্কের বলে চিপ করতে গিয়ে মিডউইকেটে সহজ ক্যাচ দিয়েছেন সাজিদ খান।

৮৮তম ওভারে লায়নকে ছয়ের পর রিভার্স সুইপে চার মেরে একটু বিনোদন দেওয়া হাসান আলী আউটও হয়েছেন অদ্ভুতভাবে। সুইপ করতে গিয়ে মিস করেছেন, এরপর হেলমেট ও ব্যাটের পেছনে লেগে বল আঘাত করেছে স্টাম্পে।

পাকিস্তানের টেল-এন্ড খুব বেশি ঝামেলায় ফেলতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে—লায়নের বলে ডিপ মিডউইকেটে মিচেল সোয়েপসনের দারুণ ক্যাচে পরিণত হয়েছেন শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহকে বোল্ড করেছেন কামিন্স। ৮৩ রানে ৫ উইকেট নেন লায়ন।