স্বপ্নের ইডেনে বাংলাদেশের মেয়েদের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ

ইডেনে প্রথম খেলেছিলেন বাংলাদেশের এই নারী ক্রিকেটাররাছবি: সংগৃহীত

স্মৃতিতে ধুলো জমেছে পারভিন নাছিমা নাহারের। তবে অমন স্মৃতি ভুলে যান কী করে! ৩৯ বছর পেছন ফিরে বলেন, ‘আমরা কিন্তু বাংলাদেশের ছেলেদের আগে ইডেনে খেলে এসেছি। ইডেনে পা দিয়ে আমরা ভীষণ রোমাঞ্চিত ছিলাম সেদিন।’

রোমাঞ্চিত মনোয়ার আনিস খানও। তাঁর স্মৃতিতে উঠে আসে ১৯৮৩ সালের মার্চে ইডেনযাত্রার আগে তিন মাসব্যাপী মেয়েদের প্রথম ক্রিকেট ক্যাম্পের সেই আনন্দময় দিনগুলো।

মনোয়ার আনিস বলেন সেই স্মৃতির কথা, ‘ঢাকায় সেই ক্যাম্প শেষে মেয়েদের নিয়ে দুটি দল করা হয়। আমরা অনুশীলন ম্যাচ খেলি। ক্যাম্প শেষে আমরা একটা গ্রুপ আবাহনীর ইনডোরে অনুশীলন করতাম। কোচ সৈয়দ আলতাফ হোসেন ভাইয়ের ছেলেদের পাশাপাশি আবাহনীর মেয়েদেরও অনুশীলন করাতেন।’

কর্মকর্তারা অনুশীলন দেখতেন আর মেয়েদের বলতেন, ‘তোমরা প্র্যাকটিস করতে থাকো। আমরা তোমাদের কলকাতা নিয়ে যাব।’ পাসপোর্ট বানিয়ে সত্যি সত্যিই একদিন মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হলো ‘পাশের বাড়ি’।

স্বপ্নের মতো কেটেছিল মেয়েদের সেই দিনগুলি
ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিমবঙ্গ মহিলা ক্রিকেট দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা হলো একটি প্রীতি ম্যাচের। সেটিই হয়ে গেল ইতিহাস। এপার বাংলার নারী ক্রিকেটারদের প্রথম বিদেশি দলের সঙ্গে ম্যাচ এবং প্রথম বিদেশ সফরও।

কিন্তু যাওয়ার আগে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না এপার বাংলার মেয়েদের। ঢাকায় ছেলেদের দলের সঙ্গে কয়েকটি অনুশীলন ম্যাচ, এই যা। এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যশোর-বেনাপোল হয়ে সড়কপথে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মেয়েরা গেলেন রোমাঞ্চকর এক সফরে।

ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেনে দুই বাংলার মেয়েদের প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ হলো ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ। ৩০ ওভারের ম্যাচে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা ক্রিকেট সংস্থা সভাপতি একাদশ ৩ উইকেটে ১৪৩ রান তোলে। আবাহনীর ইনিংস থেমে যায় ৬ উইকেটে ৭৭ রানে। ৬৬ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচে সর্বোচ্চ ২২ রান করেছিলেন শাহীন।

অধিনায়ক মুসারাত কবির আইভী করেছিলেন ১৫ রান। শাহীন আক্তার লুবনা ৭ (বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী), দুর্দানা নিতু ৬, নার্গিস আক্তার (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী) ৫। এ ছাড়া ম্যাচটি খেলেছিলেন আফসানা আক্তার (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে অবসর নিয়েছেন), অরুন্ধতী, পারভীন নাছিমা নাহার পুতুল, ডলি ক্রুজ প্রমুখ। সাবা পন্নি (বিদেশে থাকেন) ছিলেন দ্বাদশ খেলোয়াড়। (সূত্র: পাক্ষিক ক্রীড়াজগৎ, এপ্রিল, ১৯৮৩)

পশ্চিমবঙ্গ দলের অধিনায়কের সঙ্গে টস করার মুহূর্ত
ছবি: সংগৃহীত

কোচ ছিলেন এই সফরে আবাহনীর কর্মকর্তা নাজমা শামীমের বড় ভাই নায়িম ফিরোজ। দল হারলেও কোচ অখুশি ছিলেন না। কারণ, তাঁর মতে ওই সফর থেকে এপার বাংলার মেয়েদের শেখার ছিল অনেক। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফেরার পর পাক্ষিক ক্রীড়াজগতে ছাপা হওয়া এক প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, ‘সফরে আমাদের দুর্বলতা ছিল বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে। এ দিকটায় নজর দিতে পারলে আমাদের খেলাটা আরও ভালো হতো।’

সেই সফরের আগের দশ বছরে ভারতের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আটবার চ্যাম্পিয়ন ও একবার রানার্সআপ হয়েছিল পশ্চিম বাংলার দলটি। আবাহনীর হার ছিল তাই খুবই স্বাভাবিক। আবাহনীর নারী ক্রিকেট দলটির যাত্রা তখন এক বছর গড়ায়নি। শুরুতে আবাহনীর কর্মকর্তা নাজমা শামীমের চেষ্টায় ক্যাম্পে এসেছিলেন ৫০—৫৫ জন মেয়ে। শেষ পর্যন্ত টিকেছেন ২০-২২ জন।

নাজমা শামীম তখন বলেছিলেন, এই দলকে সহায়তা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। মূলত, তিনি একাই সব করেছেন। ক্যাম্প শুরুর সময় তৎকালীন জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (এনএসসিবি) চেয়ারম্যানের সহায়তায় ক্রিকেট বোর্ড কিছু সরঞ্জাম দেয় মেয়েদের, যা দিয়ে অনুশীলন চালিয়ে নিতে হয়েছে। তখন ঢাকায় এমন কোনো নারী ক্রিকেট দল ছিল না, যাদের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচ খেলা যায়। দু-চারটা নারী ক্রিকেট দল থাকলে দলটির মান যাচাই করা যেত। তারপরও অল্প অভিজ্ঞতা নিয়েই সাহস করে মেয়েরা যান কলকাতা।

কলকাতা যাওয়ার পথে বেনাপোল সীমান্তেও হয়েছিল অনেক আনন্দ
ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহাসিক সফরে আবাহনীর গর্বিত অধিনায়ক মুসারাত কবির আইভী পেছন ফিরে আজও আপ্লুত, ‘সেটি ছিল দারুণ এক স্মৃতি। আমার জন্য ছিল বিশেষ কিছু। কারণ, আমি ছিলাম অধিনায়ক। কখনোই ভুলব না ওই কটা দিন। টস করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গ দলের অধিনায়ক কেয়া রায়ের সঙ্গে। আমরা স্মারক বিনিময়ও করেছিলাম।’

এরপর জানালেন সফরে যাওয়ার আগে নিজেদের প্রস্তুতির কথাও, ‘কলকাতা সফরে যাওয়ার আগে ক্যাম্পে ৩০ জন ছিলাম আমরা। কয়েকটি প্রীতি ম্যাচ খেলা হয়েছে তখন। লালমাটিয়া ক্লাবের সঙ্গে তাদের মাঠে খেলি। আবাহনী মাঠে খেলা হয়েছে আমাদের। নারায়ণগঞ্জে গিয়েও আমরা খেলেছি।’

প্রায় সব মেয়েরই সেটি ছিল প্রথম বিদেশ সফর। সেই সফরের অন্যতম সদস্য আফসানা আক্তারকে পুরোনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর তিনিও আপ্লুত, ‘ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা তখন আমাদের যৎসামান্য। জীবনে প্রথম বাইরে খেলতে যাওয়া সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। তবে কলকাতায় লোকজন আমাদের খেলা দেখে বলেছিল, “ওরা এত অল্প সময়ে এত ভালো খেলছে। খেলার চর্চাটা যেন বন্ধ না করে। এই টিম যেন ধরে রাখা হয়। অনুশীলন করানো হয়”।’

তা আর হয়নি। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ দলটি ঢাকায় ফিরতি সফরে আসার পর তৎকালীন এরশাদ সরকারের ইশারায় মেয়েদের ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যায়। নব্বইয়ের মাঝপথ পেরিয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী বিসিবির সভাপতি হওয়ার পর চেষ্টা করেন মেয়েদের ক্রিকেট ফিরিয়ে আনতে। বিসিবিতে তখন মেয়েদের ক্রিকেট কমিটি করার চিন্তাভাবনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে বিসিবির নারী ক্রিকেট কমিটি হলো। মনোয়ার আনিস মিনু বিসিবির সেই কমিটির প্রধান ছিলেন ২০০৭–০৮ সালে।

কোচ ছিলেন আলতাফ হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের মেয়েরা ক্রিকেটে আজ অনেক দূর এগিয়েছেন। সালমা-রুমানারা জিতেছেন এশিয়া কাপ টি–টোয়েন্টি। এখন খেলছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও। তবে সেই আশির দশকে ভাবাই যায়নি বাংলার মেয়েরা ক্রিকেটে এত দূর যাবেন। শুরুটা করে দেওয়ার কৃতিত্ব নিশ্চয়ই পাবেন আশির দশকের মেয়েরাও।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে ৩৭ বছর চাকরি শেষে ২০১৭ সালে অবসর নেওয়া আফসানা জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এখন পুরোনো দিনের কথা ভাবেন। স্মৃতিতে তুলে আনেন ইডেন সফর, ঢাকায় ক্রিকেট খেলার ছবিগুলো। খেলার মাঠে তাঁরা অনেক আনন্দ করতেন।

আফসানা বলছিলেন, খেলার মাঠে তাঁর শুরুটা ১৯৭৮ সালে। অফিস থেকে তখন ছুটি নিয়ে খেলতেন। পুরোনো দিনে ফিরিয়ে নিলে এই চিরকুমারী বলেন, ‘সালটা ঠিক মনে নেই। সিদ্ধেশ্বরী সরকারি কলেজে পড়ি। তখন ক্রিকেট–হকি খেলতাম। আন্তস্কুল, আন্তকলেজে খেলে উঠে আসি। মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কলেজে অ্যাথলেট ছবি আপা, অনু, সাবেক দ্রুততম মানবী কামরুন নেছা লিপি...ওনারাও ওই স্কুলে পড়তেন। আমিও ওখানে পড়ি। হকি দিয়ে আমার খেলাধুলার শুরু। তারপর ক্রিকেটে গেলাম। আর ক্রিকেটের সৌজন্যে ইডেন সফর জীবনের অন্যতম সেরা স্মৃতি হয়ে রইল।’

ঐতিহাসিক সেই ম্যাচের আরেক খেলোয়াড় কামার আফরোজ লাভলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ঢাকা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান তিনি। তাঁর মনেও অক্ষয় হয়ে আছে সেই স্মৃতি, ‘ইডেনের সেই ম্যাচের কথা কখনোই ভুলব না। পুতুল, ডলি আপা, আফসানা...সবাই মিলে অনেক মজা করেছি। আসলে তখন অন্য রকম একটা পরিবেশ ছিল। আমরা এত আন্তরিক ছিলাম যে মাঠে এসে একটা পরিবার হয়ে যেতাম।’

এই পরিবারের সৌজন্যেই ৩৯ বছর আগে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের নারী খেলাধুলায় নতুন এক অধ্যায়। ক্রিকেটে মেয়েদের এগিয়ে চলার শুরু।