স্বপ্নের সীমানাটা এখন অনেক বড়
তারিখ: ১৯ মার্চ ২০১৫
ভেন্যু: মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড
প্রতিপক্ষ: এখনো নিশ্চিত নয়, সম্ভাব্য ভারত

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটির আগে হ্যামিল্টনের ম্যাচটিকে মনে হচ্ছে অকারণ ‘ঝামেলা’! এটির জন্য যে শুধু এক শহর থেকে আরেক শহর নয়, এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার হ্যাপাও সঙ্গী। ইমিগ্রেশন-কাস্টমস পেরোও, প্রস্থান-আগমন কার্ড পূরণ করো, মোবাইলের সিম কার্ড বদলাও, আবার টাকা ভাঙাও।
বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক বলে অস্ট্রেলিয়ার ভিসাই নিউজিল্যান্ডে প্রবেশের অধিকার দিচ্ছে। তবে তা যে খুব নির্বিঘ্নে হচ্ছে, এমন নয়। নিউজিল্যান্ড ইমিগ্রেশনের পুরো সিস্টেম বিগড়ে বসায় কাল সকালে অ্যাডিলেড বিমানবন্দরে যেমন চেক ইন করতে করতে বিমান প্রায় ছেড়ে যায় যায়!
নেলসনে স্কটল্যান্ড ম্যাচ খেলে আবার অস্ট্রেলিয়ায় ফেরার সময়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্ষোভ গুঞ্জরিত হচ্ছিল। নিউজিল্যান্ড পর্বটা একেবারে শেষ করে গেলেই তো হতো! বিশ্ব ক্রিকেটের ‘তিন মোড়ল’-এর সূচিটা তো ঠিকই তাদের সুবিধামতো করা হয়েছে।
‘তিন মোড়ল’-এর একটিকে বিদায় করে দেওয়ার পর বাংলাদেশ দল অবশ্য বিশ্বকাপে বাড়তি সমাদর পাচ্ছে। অ্যাডিলেড থেকে অকল্যান্ড ফ্লাইটে তো রীতিমতো সাদর অভ্যর্থনা জানানো হলো দলকে। বিমানে সহযাত্রীদের মুখেও আগের রাতের ম্যাচ আর বাংলাদেশের প্রশংসা। সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই প্রথম বিশ্বের ইমিগ্রেশনের কপালে ভাঁজ পড়ে। আর অকল্যান্ড বিমানবন্দরে তা হাতে পেয়েই ইমিগ্রেশন অফিসার হাসিতে উদ্ভাসিত, ‘দারুণ খেলেছে আপনাদের দল!’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ‘অকারণ’ ম্যাচটি একেবারেই যে গুরুত্বহীন, তা কিন্তু নয়। এটির ফলাফলে বদলে দিতে পারে কোয়ার্টার ফাইনাল লাইনআপ। যদিও বাংলাদেশ দল একরকম ধরেই নিয়েছে, ১৯ মার্চ মেলবোর্নে সামনে থাকবে ভারতই। কল্পচোখে সেই ম্যাচটিও যেন দেখতে পাচ্ছেন সাকিব। এমসিজিতে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ টিভিতে একটু-আধটু দেখেছেন। নব্বই হাজার ছুঁই ছুঁই দর্শকের গ্যালারি কেমন ভারতীয় সমর্থকদের দখলে চলে গিয়েছিল, সেটি আরও ভালো শুনেছেন গ্রায়েম স্মিথের কাছ থেকে। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ম্যাচের পরদিন সাকিবকে বলেছেন, মেলবোর্নে ভারতের ম্যাচ দেখার আর ইচ্ছা নেই তাঁর। দর্শকদের চিৎকারে তখনো নাকি তাঁর মাথা ঝিমঝিম করছে!
নাসির হোসেন সেই চিৎকার থামানোর একটা উপায় বাতলে দিলেন সাকিবকে, ‘উইকেট নেবেন আর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলবেন।’ সাকিবেরও খুব পছন্দ হলো কথাটা, ‘আমরা ভালো একটা স্কোর করে শুরুতেই ওদের দুই-তিনটি উইকেট তুলে নিতে পারলে গ্যালারি নীরব করে দেওয়া যাবে। এর মজাটাই হবে আলাদা!’
বাংলাদেশ দলের কাছে এখন বিশ্বকাপ মজাই। চার বছর আগে দেশের মাটিতে যা পারা যায়নি, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে তা করতে পেরে ক্রিকেটাররা নিজেরাই যেন একটু চমকে গেছেন। খুশি তো দলের সবাই। তবে তামিম ইকবালের মনে খুশির সঙ্গে ভারমুক্তির আনন্দও। বাংলাদেশ হেরে গেলে যে তাঁকেই ভিলেন হতে হতো! ওকসের ক্যাচ ফেলে দেওয়ার পর কেমন লেগেছিল প্রশ্নে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব! এটা কি বলে বোঝানো যায়!’ কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার প্রতিক্রিয়া এক লাইনেও শেষ করে দিচ্ছেন, ‘অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে এসে আমরা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলছি...আর কী বলার আছে!’ মাশরাফি ইংল্যান্ডকে হারানোর পর সংবাদ সম্মেলনেই বলেছেন, ‘আশা সবাই করেছিল, কিন্তু যারা ক্রিকেট বোঝে তারা ঠিকই জানত কাজটা কত কঠিন। শুধু কি কন্ডিশন, এসব মাঠেই তো আমরা কখনো খেলিনি।’
মাথায় লাল-সবুজ পতাকা জড়িয়ে জয়টাকে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেছেন। হঠাৎ করেই ভাবনাটা তাঁর মাথায় এসেছে, এমন নয়। দেশের জন্য কিছু করার কথা উঠলেই মাশরাফি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। নেলসনে স্কটল্যান্ড ম্যাচের আগেই বলছিলেন, ‘দেশের জন্য আমরা আর কী করতে পেরেছি? যতটুকু করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। অথচ অনেক মুক্তিযোদ্ধা তো না খেয়ে থাকেন। অনেকে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন, দেশের জন্য কিছু করে থাকলে ওনারাই করেছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আসলেই অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। তবে স্বাধীন বাংলাদেশকে সর্বজনীন উৎসবের দেশে পরিণত করার কাজটা যেন ক্রিকেটারদেরই দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ে টানা হরতালে বিরতি পড়েছে জেনে সবাই খুব খুশি। আরও খুশি হবেন দেশে ফিরতে ফিরতে অশান্তির আগুনটা নিভে গেলে।
দেশে ফেরার তারিখটা অনিশ্চিত হয়ে পড়াতেও খুশির বান বইছে দলে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১ পয়েন্ট পাওয়ার পরই মাশরাফি মজা করে বলছিলেন, ‘যদি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাই আর সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পাই, ওরা “চোক” করবে। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে পেলে তো হয়েই গেল, ওরা তো ফাইনালে উঠতেই চায় না। আর ফাইনালে উঠে গেলে ফিফটি-ফিফটি চান্স।’ বলেই লিখতে বারণ করে দিয়েছিলেন, ‘গ্রুপ থেকেই আউট হয়ে গেলে তখন মানুষ যাচ্ছেতাই বলবে।’ কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তো লেখাই যায়!
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ‘মাস্কটে’ পরিণত মুশফিকুর রহিমও স্বপ্নের সীমানা এখন অনেক বড় করে দিয়েছেন। নইলে সেমিফাইনাল খেলা সম্ভব কি না প্রশ্নে কেন হেসে বলবেন, ‘একটাই তো ম্যাচ, দেখা যাক্!’ বিশ্বকাপ অভিষেকেই ভারতের বিপক্ষে জয় দেখেছেন, যাতে তাঁরও বড় অবদান ছিল। এর পরও স্মরণীয় জয়ের দেখা কম পাননি ক্যারিয়ারে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টাকে রাখছেন সবার ওপরে। কারণ ওই বিরুদ্ধ কন্ডিশন। সেঞ্চুরি না পাওয়ার দুঃখ আছে, সেটি ভুলতে চাইছেন স্বভাবসুলভ দলীয় চেতনায়, ‘এমন একটা মাইলফলক না হলে খারাপ তো লাগেই। কিন্তু আমি সেঞ্চুরি করার পর দল হারলে কী হতো? যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে।’
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালেই শেষ হয়ে গেলেও ‘যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে’ কথাটা বলা যাবে। তবে কে জানে, এই বিশ্বকাপ আরও বড় কোনো উপহার নিয়ে অপেক্ষা করছে কি না!