হারিয়ে যাওয়া নাসুমের দারুণ ফেরা

প্রথম টি–টোয়েন্টিতে নাসুমের সামনে দাঁড়াতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াছবি: প্রথম আলো

বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদের বাবা মোহাম্মদ আক্কাস আলী রসিক মানুষ। তাঁর ছেলে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছেন। এ নিয়ে সিলেটে নাসুমদের বাড়িতে হইচই।

লোকজন এসে আক্কাস আলীকে ধরে বলছেন, ‘নাসুম ম্যাচ জিতিয়েছে। মিষ্টি খাওয়ান।’ নাসুমের বাবা রাজি না। তাঁর কথা, ‘ম্যাচ জিতিয়েছে আমার ছেলে। আমাকে মিষ্টি খাওয়াবেন আপনারা। আর আপনাদের মিষ্টি খাওয়াবে নাসুম।’

আজ সকাল থেকেই আক্কাস আলীর এই প্রাণচাঞ্চল্য দেখছেন এলাকার লোকজন। অথচ এই নাসুমই কয়েক বছর আগে ক্রিকেট থেকে প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিলেন!

তাসকিন আহমেদ, লিটন দাস, সৌম্য সরকার, নুরুল হাসান, এনামুল হক, আবু হায়দার, আবু জায়েদ, মোসাদ্দেক হোসেন। তালিকাটা বেশ বড়। তাঁদের প্রত্যেকেই ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন খেলেছেন জাতীয় দলে।

নাসুম ছিলেন ওই দলেরই ক্রিকেটার। কিন্তু তিনি গত ৮ বছরে জাতীয় দলের আশেপাশে তো দূরের কথা, নিয়মিত ছিলেন না ঘরোয়া ক্রিকেটেও। মাঝে কয়েক বছর তো দৃশ্যপটেই ছিলেন না!

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে এক ইনিংসে সেরা বোলিং পারফরম্যান্স নাসুমের
ছবি: প্রথম আলো

২৬ বছর বয়সী নাসুমের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় ২০১১ সালে সিলেট বিভাগের হয়ে। মাঝে দুই বছর বরিশাল বিভাগের হয়েও খেলেছেন। অভিষেকের ১০ বছর হতে চলল, কিন্তু নাসুম প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ২০টি! যার মধ্যে মাত্র ১২টি ম্যাচ নিজ বিভাগ সিলেটের হয়ে খেলেছেন। বাকি ৮ ম্যাচ খেলেছেন বরিশালের হয়ে, ১টি বিসিএলে।

নিজ বিভাগেই যে অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র খেলতেন! বেশির ভাগ সময় নাসুম ছিলেন তাঁর ছায়ায়।

জাতীয় লিগে নাসুমের খেলার গল্পটা অদ্ভুত। ২০১৫ সালের দিকে বিসিবি হাই পারফরম্যান্স বিভাগের প্রথম দলের অংশ ছিলেন নাসুম। কয়েক মাস হাই পারফরম্যান্সে অনুশীলন করে সিলেটে ফিরে যান এই বাঁহাতি স্পিনার।

বিসিবি দেখতে চাচ্ছিল হাই পারফরম্যান্সের অনুশীলনের পর নাসুম ম্যাচে কেমন করেন। কিন্তু বরাবরের মতোই নাসুমকে বসিয়ে রাখা হতো ডাগআউটে। এক বিসিবি কর্তা তখন সিলেট বিভাগে ফোন দিয়ে নাসুমকে ম্যাচ খেলানোর সুযোগ দিতে বলেন।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নাসুমের অভিষেক এক দশক আগে
ছবি: প্রথম আলো

ফোন পেয়ে এক ম্যাচ খেলানোও হয় তাঁকে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫ উইকেট নিলেও তাঁকে পরের ম্যাচে আবার বাদ। এরপর আবার বিসিবি থেকে ফোন। আবার আরেকটি ম্যাচ। এভাবেই থেমে থেমে এগিয়েছে নাসুমের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার। ২০১৩-১৪ বিসিএলে এক ম্যাচ খেলে ১০ উইকেট নিয়েও পরের ম্যাচে বাদ পড়তে হয় তাঁকে।

লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারের অবস্থাও একই। ২০১৪ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম দোলেশ্বরের হয়ে অভিষেক হওয়া নাসুম এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৭টি ম্যাচ খেলেছেন। প্রথমবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলার পর টানা দুই বছর কোনো ম্যাচ পাননি।

২০১৪ সালের পর নাসুমের কপাল খোলে ২০১৮ সালের প্রিমিয়ার লিগে, সেই মৌসুমে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের হয়ে ৯টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। পরের বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স নাসুমকে খেলায় মূল স্পিনার হিসেবে, যেখানে ১৩ ম্যাচে মিতব্যয়ী বোলিংয়ে ১৩ উইকেট নিলে সবার চোখ পড়ে নাসুমের ওপর।

নাসুমের বোলিং কাল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ে দারুণ ভূমিকা রাখে
ছবি: প্রথম আলো

সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের এক নম্বর বাঁহাতি স্পিনার তখন নিষিদ্ধ। সামনে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে সিরিজ। সাম্প্রতিক ফর্ম ও সাকিবের না থাকায় কপাল খুলে নাসুমের। তাঁকে রাখা হয় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে। সেই সিরিজে অবশ্য খেলানো হয়নি তাঁকে। কি দুর্ভাগ্য, এরপরই করোনায় খেলা বন্ধ হয়ে যায়।

প্রায় আট-নয় মাস পর যখন খেলা শুরু হলো, তখন সাকিব নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে এসেছেন। নাসুমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে ওঠে। অপেক্ষা বাড়ে।

অবশেষে ২০২১ সালের নিউজিল্যান্ড সফরে চোট ও পারিবারিক কারণে সাকিব না থাকায় অভিষেক হয় নাসুমের। যেখানে টানা তিন ম্যাচ বিরুদ্ধ কন্ডিশনে খেলেও ভালো করেন তিনি। হারারেতে জিম্বাবুয়ে সিরিজের শেষ ম্যাচে খারাপ করলেও গতকাল ঘরের মাঠে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে বাজিমাত করেন নাসুম।

১৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ দলকে এনে দেন স্মরণীয় জয়।

একে দুর্দান্ত ফেরা বলবেন না তো কী বলবেন!