হারের পর ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাল ভারত

আগ্রাসী ক্রিকেটে দ্বিতীয় টেস্টে রেকর্ড জয় পেয়েছে ভারত।
ছবি: বিসিসিআই

সপ্তাহের শেষ ভাগেই আইপিএলের নিলাম। চেন্নাইয়ে আজ শেষ দিকে যেন সেদিকেই নজর ছিল মঈন আলীর। টেস্টের ভাগ্য নিয়ে আগ্রহ শেষ সাতসকালেই। একটু লড়াই করে যে টেস্টকে দ্বিতীয় সেশনে নেবেন, সে আশাও নেই। তাই একের পর এক বল ঠেকিয়ে টিকে থাকার পরিকল্পনার দিকে গেলেনই না এই অলরাউন্ডার। বরং হাত খুলে মারা শুরু করলেন।

কুলদীপ যাদবকে এক ছক্কা ও এক চারে শুরু করেছিলেন। শেষ করলেন ওই কুলদীপের বলেই। মাঝে অক্ষর প্যাটেলের বলে ছক্কার হ্যাটট্রিক করেছেন, অশ্বিনকেও টানা দুই বলে চার-ছয় মেরেছেন। যখনই মনে হচ্ছিল টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডটা এই বাঁহাতির দখলে যাবে, তখনই কুলদীপের বলে স্টাম্পড মঈন। ১৮ বলে ৪৩ রান করেই থামলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার। আর ইংল্যান্ডও থামল ১৬৪ রানে। ভারতকে হারানোর লক্ষ্যটা তখনো ৩১৮ রান দূরে।

মঈনের এই ঝোড়ো গতির ৪৩ রানেই দুটি কাজ হলো। দুই ইনিংস মিলিয়েই ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ ইনিংস মঈনের ৪৩। আর মঈনের এমন ক্ষণিকের ঝড়ে শেষ উইকেট জুটিতে এল ৩৮ রান। দুই ইনিংস মিলেই যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রান! কতটা দাপটে ভারত ম্যাচটা জিতেছে, তার প্রমাণ তো এখানেই। ভারত যে ঘুরে দাঁড়ানোকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে, সে প্রমাণও মিলল।

আজ প্রথম সেশনেই খেলা শেষ করে ফেলেছে ভারত।
ছবি: বিসিসিআই

গত সপ্তাহে চেন্নাইয়েই খেলেছে দুই দল। করোনাকালে ঘরের মাঠে প্রথম ম্যাচটা হতাশ করেছে স্বাগতিকদের। ভারত মাত্রই অস্ট্রেলিয়া জয় করে এসেছে। ওদিকে শ্রীলঙ্কাকে গলে ধবলধোলাই করে এসেছে ইংল্যান্ড। আত্মবিশ্বাসী দুই দলের খেলায় যেমন লড়াই হওয়ার কথা ছিল, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। জো রুটের ডাবল সেঞ্চুরিতে প্রথম দুই দিনেই ম্যাচের ভাগ্য লিখে নিয়েছিল ইংল্যান্ড। ২২৭ রানে ভারতকে চেন্নাইয়ের উইকেটে হারিয়ে দিয়েছে ইংল্যান্ড।

এমন এক হারেও ভারতজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়নি। হারের হতাশা ছিল। কিন্তু এই ভারত দলের ওপর আস্থা হারায়নি কেউ। ভারত দল যে এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে জানে, সেটা তো অস্ট্রেলিয়াতেই দেখা গেছে। প্রথম টেস্টে নিজেদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার পর সবাই ভারতকে উড়িয়েই দিয়েছিল। বিরাট কোহলির অনুপস্থিতিতে ক্ষীণশক্তির চোটগ্রস্ত ভারতই অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজ জিতে এসেছে।

আস্থার প্রতিদান দিতে ভারত এবারও দেরি করেনি। চেন্নাইয়েই হয়েছে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। প্রথম টেস্টে ২২৭ রানের হারের বদলা রেকর্ড গড়েই নিয়েছে। ইংল্যান্ডকে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারানোর নিজেদের রেকর্ডটা নতুন করে লিখেছে কোহলিদের ভারত। ৩১৭ রানের এ জয়ের পেছনে ইংলিশ বিশ্লেষকেরা উইকেটের দায় খুঁজতে চাইছেন। অনেকেই টস ভাগ্যকেই জয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। এ সিরিজে যারা আগে ব্যাট করবে, তারাই জিতবে—এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। দুটি প্রায় সমশক্তির দল যখন মুখোমুখি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই টস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ভারতের স্পিনবান্ধব উইকেটে।

দুই অধিনায়কই একমত, দ্বিতীয় টেস্টে শ্রেয়তর দল ছিল ভারত।
ছবি: বিসিসিআই

ভারত অবশ্য কাজেই দেখিয়েছে ইংলিশ সাবেক ক্রিকেটারদের ভুল। যে উইকেটে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৩৪ রান তুলেছে, সেখানেই ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮৬ রান করেছে। যে উইকেটে রান তুলতে নাভিশ্বাস ইংল্যান্ডের, সেখানেই রবিচন্দ্রন অশ্বিন সেঞ্চুরি পেয়েছেন। কোহলিও চাপের মুখে দলকে পথ দেখিয়েছেন। জো রুট তাই দ্বিতীয় টেস্টে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে কোনো দ্বিধা করেননি, ‘ভারতকে কৃতিত্ব দিতে হবে, ওরা সব বিভাগেই আমাদের চেয়ে ভালো ছিল। এ থেকে শিখতে হবে এবং এমন কন্ডিশনে রান করতে শিখতে হবে। ছয়টি বলই একজনকে করতে পারার ব্যাপারটা ভালোভাবে আয়ত্তে আনতে হবে।’

প্রথম টেস্টের উইকেটের চেয়ে দ্বিতীয় টেস্টের উইকেট যে ভিন্ন, সেটা বলেছেন রুট। কিন্তু এটাও মেনে নিয়েছেন, এমন বড় ব্যবধানে হারের নিজেদের দায়ও আছে, ‘প্রথম দিনে আমাদের বোলিং আরও নিখুঁত হতে পারত। ওদের এত অনায়াসে রান তোলা কঠিন করে তোলা যেত।’ রুটদের জন্য কাজটা কঠিন করে তুলেছিল চীপকের গ্যালারিও। বহুদিন পর গ্যালারিতে দর্শক পেয়ে ভারত উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। যখন দলের অনুপ্রেরণা দরকার হয়েছে, গ্যালারি তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

দর্শক শক্তি জুগিয়েছে ভারতকে।
ছবি: বিসিসিআই

মাঠে একটু বেশি আগ্রাসী থাকেন বলে কোহলির সমালোচনা হয়। কিন্তু গ্যালারির শক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটি আবার দেখিয়ে দিয়েছেন ভারত অধিনায়ক। আগের টেস্টে দল এত বড় ব্যবধানে হারার পরও সমর্থকেরা হতাশ হননি, যখনই কোহলি বাড়তি উৎস খুঁজে নিতে চেয়েছেন, গ্যালারি গর্জন তুলেছে। কোহলিও ম্যাচ শেষে নিজেদের পারফরম্যান্সে দর্শকদের অবদানের কথা বলেছেন, ‘প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠে দর্শক ছাড়া খেলা খুব অদ্ভুত ছিল। সত্যি বলছি, খুব পানসে লাগছিল। আমারও ভালো লাগছিল না। আমাদের এই বাড়তি শক্তিটা দরকার ছিল। এ ম্যাচে আমরা নিজেদের সেরাটা খুঁজে পেয়েছি এবং দর্শক অনেক বড় তফাত করে দিয়েছে। এটাই দলকে আরও কষ্ট করতে আগ্রহী করে তোলে। দল হিসেবে আমাদের দৃঢ়তা ও নিবেদনের উদাহরণ এই ম্যাচ। সবাই জানে চেন্নাইয়ের দর্শক বুদ্ধিমান এবং তারা ক্রিকেট খুব ভালো বোঝে। ১৫-২০ মিনিট পরপর বোলারদের দর্শকের সমর্থন দরকার হয়। আর আমার দায়িত্ব সেটা জোগাড় করে দেওয়া। এমন গরমে যখন বোলিং করবেন, তখন দর্শকের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাগবেই।’

ইংলিশ সাবেক খেলোয়াড়েরা টস ভাগ্য নিয়ে কথা বলছেন অনেক। কিন্তু কোহলি সে আলোচনাকে পাত্তাই দেননি, ‘কন্ডিশন দুই দলের জন্যই কঠিন ছিল। কিন্তু আমরাই বেশি দৃঢ়তা, নিবেদন ও চেষ্টা দেখিয়েছি। আমার মনে হয় না টস কে জিতল, তাতে কিছু এসে যেত না এই উইকেটে। আমাদের বিশ্বাস ছিল, দ্বিতীয় ইনিংসেও আমরা রান পাব এবং প্রায় ৩০০ করেছি।’

যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলছে ভারত, তাতে কোহলির কথা বিশ্বাস না করে উপায় কী?