'কলঙ্কিত আজহার'কে নায়ক বানানোর চেষ্টা?

আজহারকে মহিমান্বিত করার ছবি ‘আজহার’। ছবি: সংগৃহীত।
আজহারকে মহিমান্বিত করার ছবি ‘আজহার’। ছবি: সংগৃহীত।

মুক্তি পেয়েছে মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে নিয়ে নির্মিত ছবি ‘আজহার’। অনেক প্রতীক্ষার পর মুক্তি পাওয়া এই ছবি দেখতে প্রথম দিনই নাকি বিভিন্ন ছবিঘরে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। তবে ভিড় ঠেলে ছবিটি দেখে হতাশই হয়েছেন দর্শকেরা। এটি ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে কলঙ্কিত ভারতের এই সাবেক অধিনায়কের ইমেজ ফেরানোর প্রয়াস বলেই অভিমত বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমের।
পুরো ছবিটিই নাকি বলিউডি মসলায় ভরপুর। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এই ছবির বিভিন্ন সংলাপ নিয়েও কটাক্ষ করেছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই ছবিটি অনেক সম্ভাবনা চূড়ান্ত অপচয় বলেই মনে করছে অনেকে। পুরো ছবিতে আজহাররূপী ইমরান হাশমির অভিনয়ও নাকি বেশ গড়পড়তা। সবচেয়ে বড় কথা, স্পট ফিক্সিংয়ের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আজীবন নিষিদ্ধ আজহারউদ্দিনকে কিছু হাস্যকর দৃশ্যপটের মাধ্যমে ধোয়া তুলসীপাতা সাজানোর একটা অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে এই ছবিতে, যা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে বেশ।
ছবিতে দেখানো হয়েছে আজহারউদ্দিন কোনো এক ম্যাচের আগে জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। টাকার পরিমাণ প্রায় এক কোটি। কিন্তু টাকা নিয়েও তিনি ব্যাট হাতে দলকে জিতিয়ে ফিরছেন। কারণটাও বলা হয়েছে আজহারের জবানিতেই। তিনি নাকি টাকা নিয়েছিলেন সেই জুয়াড়ি যেন তাঁর দলের অন্য কোনো খেলোয়াড়কে টাকা সাধতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য! কী যুক্তি!

আজহার ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বড় তারকা। তাঁর জীবন উত্থান-পতনে ঘেরা। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে একটি পুরো দৈর্ঘ্যের ছবি করতে যে পরিমাণ গবেষণার দরকার, সেটাই অনুপস্থিত এই ছবিতে। গোটা নব্বইয়ের দশকজুড়ে ভারতের অধিনায়ক থাকার সময় কীভাবে ম্যাচ পাতানোর দানবটি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাজঘরে ঢুকে পড়েছিল, তার কানাকড়িও দেখানো হয়নি এই ছবিতে।
১৯৮৪ সালে পরপর তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ক্যারিয়ার শুরু করা এই আজহার কীভাবে ১৯৯০ সালে দলের অধিনায়ক হয়ে গেলেন—রাজসিং দুঙ্গারপুরের সেই বিখ্যাত উক্তি—মিয়া, কাপ্তান বানোগি! পরপর তিনটি বিশ্বকাপে ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়া, অতঃপর হিরো থেকে জিরো—৯৯ টেস্টেই ক্যারিয়ারের দুঃসহ পতন! সবকিছুই নাকি ভাসা ভাসাভাবে এসেছে ছবিতে। ছবিতে আজহারের ‘শততম’ টেস্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে আট বছরের আইনি লড়াইকে। যে লড়াইয়ে তিনি আজীবন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আদালতের রায় পেয়েছিলেন।
ছবিতে মনোজ প্রভাকর, রবি শাস্ত্রী, কপিল দেব ও নভজোৎ সিং সিধুর চরিত্র টেনে আনা হয়েছে। ছবির শুরুতেই আইনি ঝামেলা এড়াতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, এটি ঠিক বায়োপিক নয়। শাস্ত্রীর চরিত্রটি দেখানো হয়েছে নারীলিপ্সু এক ক্রিকেটার হিসেবে, যে বিদেশে গেলেই অভিসারের ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রভাকরকে দেখানো হয়েছে ভারতীয় দলে আজহারের এক নম্বর শত্রু হিসেবে, যিনি কোনো দিনই ভারতের অধিনায়ক হিসেবে আজহারকে মেনে নেননি।
আজহারকে ফাঁসাতে মনোজের স্টিং অপারেশন দিয়েই ছবির শুরু। কপিলকে (দেব) প্রথমে আজহারের বন্ধু হিসেবে দেখালেও বিপদের সময় তাঁর পাশে না থাকার একটা অভিযোগ ছবিতে তোলা হয়েছে। নভজোৎ (সিধু) চরিত্রটিকেও একই কায়দায় দেখানো হয়েছে।
১৯৯৫ সালে কানপুরে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার সেই ‘কুখ্যাত’ ওয়ানডে ম্যাচটির প্রসঙ্গ এসেছে এই ছবিতে। যে ওয়ানডেটিতে ধীরগতির ব্যাটিংয়ের জন্য সাসপেন্ড হয়েছিলেন নয়ন মঙ্গিয়া ও মনোজ প্রভাকর। ছবিতে আজহারের জবানিতেই অভিযুক্ত করা হয়েছে মনোজকে। যে মনোজ স্টিং অপারেশন করে আজহারকে ফাঁসিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধেই তো ম্যাচ গড়াপেটার এন্তার অভিযোগ।
ছবিতে সংগীতা বিজলানির চরিত্র আছে। আছে আজহারের প্রথম স্ত্রী নওরিনের চরিত্রও। নওরিনের সংসার ভাঙার আকুতিও উঠে আসেনি, যতটা উঠে এসেছে বলিউড তারকার সঙ্গে এক ক্রিকেটার তারকার প্রেমের আঙ্গিক।
মোটকথা, পুরো ছবিতে আজহারকে ‘বীর’ বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যুক্তিতর্কের ধারে-কাছে না গিয়ে তাতে বলিউডি মসলা আর নাটকীয়তার অতি ব্যবহারে সেই চেষ্টা রীতিমতো মাঠে মারা গেছে। আজহার দেখে আজ্জুর ভক্তদেরই আহাজারি—এ আবার কেমনতরো ছবি!