মাশরাফিকে হারিয়ে কুমিল্লার চারে চার

৫২ বলে ৭৯ রানে অপরাজিত থাকেন জনসন চার্লসছবি: শামসুল হক

ফাইনাল তো নয়, যেন তালগোল পাকানো এক হিসাব! এর আগে তিনবার বিপিএলের ফাইনালে উঠে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস কখনো হারেনি। ওদিকে সিলেট স্ট্রাইকার্সের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও চারবার ফাইনালে উঠে চারবারই দেখা পেয়েছেন ট্রফির।

আজ ফাইনালে তাই মুখে মুখে ঘুরল প্রশ্নটা—কুমিল্লার চারে চার নাকি পাঁচে পাঁচ হবে মাশরাফির? ওদিকে মাশরাফির পাঁচে পাঁচ হয়ে যাওয়া মানে প্রথমবার বিপিএলে এসেই সিলেট স্ট্রাইকার্সের শিরোপার দেখা পেয়ে যাওয়া। ফাইনালের ফলাফলটা তাই অপেক্ষা করছিল অনেক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে।

সেই শেষ দৃশ্যে যাওয়ার আগে বিপিএলের ফাইনাল নিয়ে চিরাচরিত উত্তেজনা, আকস্মিক তৈরি হওয়া আকর্ষণ। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের বৃত্তাকার গ্যালারিতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকল না। টিকিটের আশায় বাইরেও অপেক্ষমাণ ছিলেন অনেক মানুষ। বিপিএলে এই অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষণীয়।

আরও পড়ুন

প্রতিবারই টুর্নামেন্টটা নানা কারণে সমালোচনার তিরে এফোঁড়–ওফোঁড় হয়। কিন্তু যেই না ফাইনালের সময় আসে, সবারই একটা টিকিট চাই। টিকিট কাউন্টারে ভিড়, বিসিবির কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মুঠোফোনে অনুরোধ–বার্তা। কিন্তু শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারির ধারণক্ষমতা তো মাত্র ২৫ হাজার। তার ওপর আছে ‘সৌজন্য টিকিটে’র প্রভাবশালী দাবিদারেরা। বিপিএলের ফাইনাল স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ দর্শকদের মুখে তেমন হাসি ফোটাতে পারে না।

রানতাড়ায় ৩৯ বলে ৫৫ রান করেন লিটন দাস
ছবি: প্রথম আলো

তবে এটা আরও একবার প্রমাণিত যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের জন্য বিপিএল ফাইনাল মানেই হাসি, শিরোপা জয়ের উল্লাসে ভেসে যাওয়ার রাত। এবারও মাশরাফিকে ‘পেন্টা’ বঞ্চিত করে শেষ পর্যন্ত কুমিল্লারই জয়জয়কার। লিটন দাসের (৩৯ বলে ৫৫) দারুণ শুরুর পর জনসন চার্লসের মারকাটারি ব্যাটিংয়ে ৫২ বলে অপরাজিত ৭৯ রান।

কুমিল্লাকে ১৭৫ রানের বড় লক্ষ্য দিয়েও সিলেটের বোলাররা একবারের জন্যও জয়ের সম্ভাবনা জাগাতে পারেননি। লিটনের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ৭০ রানের জুটির পর মঈন আলীর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ৭২ রানের জুটিতে চার্লসই শেষ করে দেন ম্যাচটা।

আরও পড়ুন

কুমিল্লার ব্যাটসম্যানরা সিলেটের ১৭৫ রানকে তুচ্ছ প্রমাণ করলেও তাদের ফিল্ডিংটা ছিল দেখার মতো। দেখার মতো মানে দেখে হাসাহাসি করার মতো আর কি! সিলেটের ইনিংসের বর্ণনায় তাই নাজমুল হোসেন আর মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিংটাই প্রাধান্য পাবে নাকি কুমিল্লার ফিল্ডারদের একের পর এক ‘কমেডি শো’র আলোচনাটাই আগে আসবে, সেটা একটা প্রশ্ন। শুরু আর শেষটাই তো উদ্ধৃতি চিহ্নের মতো ‘কমেডি’ দিয়ে!

কুমিল্লার পেসার আন্দ্রে রাসেলের ১৮ রান দেওয়া প্রথম ওভারের প্রথম বলেই ওভার থ্রোতে চার। শেষ বলেও তা–ই, সঙ্গে লেগ বাইয়ে ১ রান। ম্যাচের প্রথম ওভারেই দুই–দুইবার বোকা বনে যাওয়াটা যেন কুমিল্লার ফিল্ডারদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা নাড়িয়ে দিল।

জনসন চার্লসের ইনিংসে ছিল ৭টি চার ও ৫টি ছয়
ছবি: শামসুল হক

মাঝে কী ঘটেছে সেটা জানার আগে শেষটা শুনে নিন। শেষ ওভারের শেষ বল, এবারও বোলার রাসেল। কট বিহাইন্ড হয়েছিলেন মুশফিক। বেঁচে যান রাসেলের পা দাগের বাইরে থাকায় আম্পায়ারের ডাকা ‘নো’ বলের সুবাদে। ফ্রি হিটেও মিড উইকেটে ক্যাচ দেন মুশফিক। কিন্তু ফ্রি হিট যে ছিল, সেটাই যেন ভুলে গেলেন ক্যাচটা নেওয়া লিটন!

এদিকে মুশফিক আর তানজিম হাসান দ্রুত প্রান্ত বদল করছেন, ওদিকে গ্যালারির দিকে ফিরে উদ্‌যাপনে মাততে চাইলেন লিটন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, আরে এ তো ফ্রি হিট! কিন্তু সংবিৎ ফিরে পেয়ে বল ছুঁড়ে মারার আগেই সিলেটের দুই ব্যাটসম্যানের ২ রান নেওয়া সারা।

সিলেট স্ট্রাইকার্সের তৃতীয় উইকেটজুটিতে ৭৯ রান তোলেন নাজমুল হোসেন–মুশফিকুর রহিম
ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার ফিল্ডাররা যেন হাতে মোম মেখেই নেমেছিলেন এদিন! ক্যাচ পড়ল একটার পর একটা। কখনো অধিনায়ক ইমরুল কায়েস, কখনো মোস্তাফিজুর রহমান, কখনো জনসন চার্লস, কখনো লিটন, কখনো–বা মঈন। ১৮তম ওভারে মোস্তাফিজের পরপর দুই বলে সিলেটের ব্যাটসম্যান জর্জ লিন্ডের ক্যাচ ফেলেন লিটন ও মঈন।

পঞ্চম ওভারে সুনীল নারাইনের বলে নাজমুলের ক্যাচ পড়ে মোস্তাফিজের হাত থেকে। অষ্টম ওভারে বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলামের বলে সিলেট ওপেনারের ক্যাচ ছাড়েন কুমিল্লার অধিনায়ক ইমরুলও। ৪৫ বলে ৬৪ রানের ইনিংসে ঝলমলে সব শট খেলা নাজমুল নিশ্চয়ই ওই দুটি নতুন জীবনের জন্য মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছেন মোস্তাফিজ ও ইমরুলকে।

আরও পড়ুন

কুমিল্লার সামনে ১৭৫ রানের লক্ষ্য দেওয়াতে অবশ্য সবচেয়ে বড় অবদান মুশফিকের ৪৮ বলে অপরাজিত ৭৪ রানের ইনিংসটার। পাঁচ বাউন্ডারির সঙ্গে তিন ছক্কা, এর মধ্যে নারাইনকে রিভার্স সুইপে মারা চারে ফিফটি পূর্ণ ৩৫ বলে। অবশ্য মুশফিকের এই বিনোদনদায়ী ইনিংসেও বিশেষ দ্রষ্টব্য হয়ে আছে একটা ক্যাচ ছাড়ার দৃশ্য। মঈনের করা ১১তম ওভারের প্রথম বলে চার্লসের হাত থেকে পড়েছে সেই ক্যাচ। ১৬তম ওভারে নিজের বলে রায়ান বার্লকেও জীবন দেন মোস্তাফিজ।

ক্রিকেট খেলাটাই এমন যে জয়ের আনন্দ ঢেকে দেয় সব ভুলত্রুটি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের জয়টা তো আবার এল ফাইনালের মতো ম্যাচে! খেলা শেষে তাই সব ছাপিয়ে ট্রফির ঔজ্জ্বল্যটাই চোখ ধাঁধানো বেশি। শুরুর কনসার্টই বলুন কিংবা শেষের আতশবাজি আর লেজার শো, সবই যেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের চতুর্থ শিরোপা জয়কে উৎসর্গ করে।