তানভীর ইসলাম: তৃতীয় বিভাগ থেকে ৫ উইকেটের ক্লাবে
তৃতীয় বিভাগ থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন তানভীর ইসলাম।
দুই চারের সঙ্গে এক ছক্কা—তানভীর ইসলামের প্রথম ওভারেই এল ১৭ রান। এমন কিছুর পর ভড়কে যাওয়ার কথা যে কারওই। এমনিতেই স্কোরবোর্ডে রান কম—দ্রুত ফিরে আসাটাও তাই জরুরি। ভয়টা আরও বাড়ল কামিন্দু মেন্ডিস আর কুশল মেন্ডিসের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে। বিপর্যস্ত দল কি আরও এক হারে হতাশাই বাড়াবে?
প্রশ্নটা উঁকি দিতে শুরু করেছে কেবল, তেমন হলে তা যে খুব সুবিধার কথা নয়; শুরু হয়েছে ওই আলোচনা। তানভীর ফিরলেন তখনই, ফেরালেন বাংলাদেশকেও। প্রথম দুই ওভারে ২২ রান দিয়ে দেওয়া বাঁহাতি স্পিনার তৃতীয় ওভারে এসে উইকেট পান কেবল ১ রান দিয়ে। সেই শুরু, এরপর গল্পের মোড় দ্রুতই ঘুরিয়ে দিতে থাকেন তানভীর। ১০ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে তুলে নেন ৫ উইকেট।
‘দ্রুত’ কিছু করার এই তাড়না বা করে দেখানোর সাফল্য তানভীরের জন্য যদিও নতুন কিছু নয়। জীবনের নানা বাঁকে ঠিক পথটা বেছে নিতেও তাঁর কাছে সময় ছিল অল্প। মা-বাবা দুজনেই সরকারি চাকরি করতেন। বরিশালের ছেলে তানভীরের ছোটবেলা কেটেছে নানির কাছে। মাস শেষ হলেই নানির কাছে করতেন ব্যাট-বলের আবদার। পাড়ার ‘বড় ভাই’দের ক্রিকেটে সুযোগ পাওয়ার জন্য এসবের মূল্য তখন অনেক বেশি।
পাড়ার ক্রিকেট পেরিয়ে তানভীরের মাথায় ঢাকার একাডেমির পোকা ঢুকিয়ে দেন বরিশাল বুলসের এক টিম বয়। কিন্তু তানভীরের স্বপ্নে তখন বাদ সাধে বাবার অনাগ্রহ। প্যারামেডিকেল, ডেন্টাল কিংবা পুলিশের চাকরি—বিকল্প হিসেবে তানভীরের সামনে রাখা হয়েছিল এসব। কিন্তু তাঁর কল্পনাজুড়ে তখনো শুধুই ক্রিকেট।
নানির আবদার আর চাপে ক্রিকেটে কিছু করে দেখানোর জন্য দুই বছরের সময় দিয়ে তানভীরকে ঢাকায় নিয়ে আসতে বাধ্যই হন বাবা। নানা জায়গা ঘুরে ক্রিকেটে তানভীরের স্বপ্ন বোনার শুরু ধানমন্ডিতে এক একাডেমিতে ভর্তি হয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সংস্কৃতিতে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে জাতীয় পর্যায়ে খেলা পথ সহজ করে দেয় পরের ধাপগুলোর।
তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট দিয়ে তানভীরের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু পথ চলতে যে জানে, হোঁচট খেয়ে এগিয়ে যাওয়ার পর দৌড় শুরু করা তাঁর জন্য কঠিন কিছু নয়—তানভীরও আঁকাবাঁকা পথেও ঠিক রাস্তাটা খুঁজে বেড়িয়েছেন। যে পথেরই নতুন গন্তব্য ছিল কাল কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫ উইকেট পাওয়ার আনন্দ।
দীর্ঘ সময় ধরেই বাঁহাতি স্পিন নিয়ে ভাবতে হয়নি বাংলাদেশকে। দলের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানই করতেন কাজটা। নানা কারণে তিনি আড়াল হয়ে যাওয়ার পর নাসুম আহমেদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মূলত তাইজুল ইসলামের। টি-টোয়েন্টিতে ভাবনায় থাকলেও এই সংস্করণে তানভীর সুযোগ পেয়েছিলেন ‘অদল-বদল’ করে খেলানোতে নিজের পালা আসায়।
প্রথম ওয়ানডেতে আহামরি কিছু করতে পারেননি। তবে ১০ ওভারে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে দিয়েছেন ৪৪ রান, নিয়েছেন ১ উইকেট। তাতে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জায়গাটাও ধরে রেখেছেন। এরপর কী করেছেন, সেটা তো সবারই জানা।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই তানভীর ঢুকে গেছেন ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া বোলারদের পৃথিবীতে- যেখানে তাঁর আগেও ওয়ানডেতে আছেন ৩৬২ জন, যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের আছেন ১৪ জন, বাঁহাতি স্পিনার আরও ৪জন। তবে এদের মধ্যে তানভীরের মতো তৃতীয় বিভাগ থেকে উঠে আসা বোলারদের তালিকা করলে, সেটা বোধ হয় খুব বেশি বড় হবে না।
বিকেএসপিতে এক প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো খেলায় তানভীর সুযোগ পেয়েছিলেন প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের দল খেলাঘরে। এক মৌসুমে ২৭ উইকেট নিয়ে ক্লাবকে প্রিমিয়ার লিগে তুলে দেওয়ার পর বদলে যায় তানভীরের ভাগ্যও। জাতীয় দলের এখনকার ম্যানেজার নাফিস ইকবালের হাত ধরে সুযোগ পেয়ে যান বিপিএলের দল খুলনা টাইটানসে।
২০১৭ সালের ওই ঘটনার ৮ বছর পেরিয়ে গেছে। কাল ম্যাচসেরা তানভীরকে নিয়ে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে অনুবাদক হয়ে উপস্থিত ছিলেন নাফিস ইকবাল—তার হয়তো আলাদা একটা আনন্দও কাজ করছিল তাতে। তানভীরের? সুযোগ কাজে লাগাতে পারার কাজটা যে তিনি ভালোই পারেন, তা হোক বাবার দেওয়া অথবা নির্বাচকদের, তা ভেবে হয়তো বেশির ভাগ সময় গম্ভীর মুখে মুচকি একটা হাসি যোগ হয়েছে!