পন্ত কতটা গিলক্রিস্ট, কতটা পন্ত

অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও ঋষভ পন্তএএফপি

ধারাভাষ্যকার ‘ভালো’ হলে টিভিতে খেলা দেখার আনন্দটা বেশি। ভালো বলতে আসলে তাঁরা খেলার চার, ছক্কা, উইকেটের বাইরের ছোট গল্পগুলো তুলে ধরতে পারেন। খেলার মধ্যে খেলাগুলো চোখ এড়ায় না। এই মাইক আথারটনের কথাই ধরুন।

সেদিন হেডিংলিতে ঋষভ পন্ত ইনিংসের প্রথম ২৩ বল খেলার পর নিজেকে কিছু একটা বলছিলেন। স্টাম্প মাইকের সৌজন্যে সেটি আথারটনের কানে গেল। কিন্তু কথা তো হিন্দিতে। আথারটন তো তা বোঝেন না। সমস্যা নেই—পাশেই ছিলেন দীনেশ কার্তিক। পন্ত কী বলেছেন, সেটি জানা গেছে তাঁর সৌজন্য।

পন্ত আসলে কী বলেছিলেন—‘সোজা ব্যাটে খেলেও আমি বল মিডল করতে পারি। আলাদা কিছু করার দরকার নেই।’ এই কথার শানে নুজুল আছে। সেটি না জানলে খাপছাড়া লাগতে পারে।

পন্ত সাধারণত উইকেটে এসেই আক্রমণ করে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ ফেলতে চান। প্রথম ইনিংসে নিজের খেলা দ্বিতীয় বলেই উইকেট থেকে বেরিয়ে এসে বোলার বেন স্টোকসের মাথার ওপর দিয়ে চার মারেন। দ্বিতীয় ইনিংসেও সেটিই চেয়েছেন। ডাউন দ্য উইকেটে এসে চারও মেরেছেন। তবে এবার ক্রিস ওকসের বল আর ব্যাটের মাঝে লাগেনি। এজ হয়ে গেছে স্লিপের মাথার ওপর দিয়ে।

ফলিং সুইপ ব্যাটে বলে হয়নি পন্তের
এএফপি

পন্তের মনে ‘ডাউট’! এরপর ব্রাইডন কার্সের বোলিংয়ে বল তুলে দেন আকাশে। ভাগ্য ভালো! পেয়ে যান চার। একই ওভারে খেলতে চান ‘ফলিং সুইপ’। আবার ব্যর্থ। পন্ত তখনই বুঝে যান—সামথিং ইজ নট রাইট! এরপরই পন্ত নিজেকে বোঝানোর সিদ্ধান্ত নেন, যা কাজেও লেগেছে। সেঞ্চুরি করেছেন। ৯০–এর ঘরে গিয়ে এলোপাতাড়ি কিছু করতে চাননি। ঠান্ডা মাথায় তিন অঙ্কের ঘরে গেছেন।

পন্তের ব্যাটিংয়ের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। ইনিংসের শুরুতে নিজের ডিফেন্সে খুব একটা ভরসা নেই তাঁর। তাই তিনি শুরুতে আক্রমণ করে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে বাধ্য করেন। খোঁচা দিয়ে স্লিপে তুলে দেওয়ার চেয়ে এটি হয়তো ভালো!

টেস্ট ইতিহাসে পন্তই দ্বিতীয় উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান, যিনি এক টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন।

এই আগ্রাসী শুরু প্রতিপক্ষকে বাধ্য করে স্লিপ বা শর্ট লেগে ফিল্ডার না রেখে বাউন্ডারির দিকে সরাতে। এটিই কাজে লাগান তিনি। তবে হেডিংলিতে সেদিন তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আক্রমণটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে শুধরেছেন, ফল পেয়েছেন।

পন্তের সেদিনের সেঞ্চুরি তাঁকে জায়গা করে দিয়েছে বিরল এক তালিকায়। টেস্ট ইতিহাসে পন্তই দ্বিতীয় উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান, যিনি এক টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন। এর আগে এই কীর্তি ছিল শুধু জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের।

৪০ ও ৮২
প্রথম ৪৪ টেস্টে গিলক্রিস্টের ৪০ ছক্কার বিপরীতে পন্তের ছক্কা ৮২টি

একজন উইকেটকিপার হিসেবে তাঁর রেকর্ড এখনই কিংবদন্তিতুল্য। যদি প্রতিটি ৯০–এর ঘরের ইনিংসকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারতেন, তবে তাঁর ঝুলিতে থাকত ১৫ সেঞ্চুরি, মাত্র ৪৪ টেস্টেই! পন্তের সেঞ্চুরি ৮টি, যার ৪টিই ইংল্যান্ডে—ভারতীয়দের মধ্যে ইংল্যান্ডে এর চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি আছে কেবল রাহুল দ্রাবিড়ের (৬)। এই পন্তই একমাত্র কিপার, যিনি অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সেঞ্চুরি করেছেন।

তাই তো বারবার সেই নামটার সঙ্গে তাঁর তুলনা হচ্ছে। মানে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সঙ্গে। আক্রমণাত্মক উইকেটকিপার বলতে তো এত দিন শুধু এই নামটাই নেওয়া হতো। এখন পন্ত সেখানে ভাগ বসাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জও ছুড়ছেন। কিন্তু তা কতটা?

গিলক্রিস্টের টেস্ট অভিষেক ১৯৯৯ সালে
এএফপি

পন্ত এখন পর্যন্ত ৪৪টি টেস্ট খেলেছেন। ৪৪ টেস্টে গিলক্রিস্টের পারফরম্যান্স কেমন ছিল? সংখ্যা পাশে রাখলে গিলক্রিস্টই এগিয়ে। দুজনের সেঞ্চুরি যদিও সমান ৮টি; তবে পন্তের গড় যেখানে ৪৪.৪৪, সেখানে গিলক্রিস্টের ৫৮.৮০। পন্ত এত পেটানোর পরও স্ট্রাইক রেট ৭৪.০৩। গিলক্রিস্টের ছিল ৮২.৬৫। অবশ্য পন্ত গিলক্রিস্টের ডাবল ছক্কা মেরেছেন। ৪৪ টেস্ট পরে গিলক্রিস্টের ছক্কা ছিল ৪০টি, পন্তের ৮২টি।

সংখ্যার বাইরেও চোখ দিতে হবে। গিলক্রিস্টের টেস্ট অভিষেক ১৯৯৯ সালের ৫ নভেম্বর, আর শেষ ম্যাচ খেলেন ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। এই সময়ে তিনি করেছেন ৫,৫৭০ রান, যা এই টাইমলাইনে অস্ট্রেলিয়ার চতুর্থ সর্বোচ্চ।

আরও পড়ুন

একই সময়ে রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেইডেন ও জাস্টিন ল্যাঙ্গারও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দাপট দেখিয়েছেন। এই সময়ে পন্টিং করেন ৮,১১৫ রান, হেইডেন ৭,৯৮১ আর ল্যাঙ্গার ৬,৩৯১ রান।

গিলক্রিস্ট যা করেছেন, তা অবশ্যই অসাধারণ। তবে তিনি অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণালি দলে খেলেছেন, যেখানে পুরো স্কোয়াডে ম্যাচ জেতানো খেলোয়াড় ছিল। ল্যাঙ্গার, হেইডেন, পন্টিং, মার্টিন, ক্লার্ক আর মাইকেল হাসির মতো ব্যাটসম্যানরা তখন ইনিংস গড়ার কাজ করতেন, গিলক্রিস্ট তখন নিচের দিকে নেমে ইনিংসের গতি বাড়িয়ে দিতেন।

ঋষভ পন্তের ডিগবাজি। এভাবে সেঞ্চুরি উদযাপন করেন তিনি।
এএফপি

পন্তের গল্পটা ভিন্ন। দেশ থেকে বিদেশে, যেখানেই খেলেছেন, এই অল্প সময়েই পন্ত পারফর্ম করে দেখিয়েছেন। পন্ত এমন এক সময় খেলছেন, যখন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট টেবিলে টিকে থাকতে দলগুলো রেজাল্টমুখী উইকেট তৈরি করছে। অভিষেকের পর থেকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক পন্ত।

শীর্ষে থাকা বিরাট কোহলির চেয়ে তিনি পিছিয়ে আছেন মাত্র ২৩৬ রানে, অথচ কোহলির চেয়ে ১৭ ইনিংস কম খেলেছেন। পন্তের টেস্ট গড় ৪৪.৪, আর স্ট্রাইক রেট ৭৪.০৩, যা তাঁর অভিষেকের পর টেস্টে শীর্ষ ১৫ রান সংগ্রাহকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

পন্ত গিলক্রিস্টকে ছাড়িয়ে যাবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। তবে এখনই যে তাঁর নামটা গিলক্রিস্টের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে, সেটিই–বা কম কিসে! বয়স যে মাত্র ২৭!

আরও পড়ুন