রাহুল দ্রাবিড়: শূন্যতা থেকে পূর্ণতা এবং বেকারত্বের আনন্দ

রাহুল দ্রাবিড়ের দুই ছবির মধ্যে ব্যবধান ১৭ বছরের। দুটিই ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ২০০৭ বিশ্বকাপে কেঁদেছিলেন, ২০২৪ বিশ্বকাপ শেষে তাঁর মুখে প্রশান্তির হাসিআইসিসি

২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত।

ইএসপিএনক্রিকইনফোর ফটো গ্যালারিতে গিয়ে সেদিনের কিছু ছবি চাইলে দেখতে পারেন। চোখে লেগে থাকার মতো দুটি ছবি পাবেন। একটিতে ট্রফি হাতে দলের অধিনায়ক পৃথ্বী শর সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল কোচ রাহুল দ্রাবিড়। ফ্লাডলাইটের রশ্মি যেন ঠিকরে পড়ছে ট্রফিটার ওপর, যা আলোর ঝলকানির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আরেকটিতে দ্রাবিড় দর্শকদের অভিনন্দনে সিক্ত হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতা মানেও কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা পাওয়া। তবে ছোটদের বিশ্বকাপ তো আর সত্যিকার অর্থে বিশ্বজয়ের পরিপূর্ণ আনন্দ দেয় না। দ্রাবিড়ের মতো কিংবদন্তির জন্য তো একদমই নয়।

একদিন বড়দের বিশ্বকাপও জিতবেন—২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জিতে যেন সেই আভাস দিয়ে রেখেছিলেন দ্রাবিড় (ডানে)
আইসিসি

তবে বারবার ফাইনালে হেরে আসা মানুষটা যখন ছোটদের নিয়ে হলেও বিশ্বকাপ ট্রফির স্বাদ পান, তখন তা আগের কষ্টগুলোকে কিছুটা হলেও ছাইচাপা দেয়। সঙ্গে দেয় বড় এক পূর্বাভাসও—‘আরে, এ তো ছিল মহড়া! একদিন আমি ভারত জাতীয় দলেরও কোচ হব, বিশ্বকাপ জিততে না পারার আক্ষেপ ঘোচাব।’

বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে (বাংলাদেশ সময়) পরশু রাতে বিরাট কোহলি যখন দ্রাবিড়ের হাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই যে নিন, এটা আপনার...’, সদা বিনয়ী-শান্ত স্বভাবের দ্রাবিড়কে শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ট্রফি উঁচিয়ে ধরে গর্জন করতে দেখে ওই কথাগুলোই মনে পড়ছিল।

খেলোয়াড়ের ভূমিকায় তিনটি বিশ্বকাপে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দ্রাবিড়। তিনি যে সময় বিশ্বকাপ খেলেছেন, তখন তা এক সংস্করণেরই ছিল—ওয়ানডে। ১৯৯৯ সালে ভারত বিদায় নেয় সুপার সিক্স থেকে, ২০০৩ ফাইনালে রিকি পন্টিংয়ের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে রানার্সআপ।

২০০৭ বিশ্বকাপের দুঃস্মৃতি কেউ মনে করিয়ে দিতে চাইলে দ্রাবিড় হয়তো তাঁর সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওই হারটা ভারতকে গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে দেওয়ার শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল। পরে ভারত শ্রীলঙ্কার কাছেও হারলে এবং বাংলাদেশ বারমুডাকে হারিয়ে দিলে ভারতের বিদায় নিশ্চিত হয়।

ভারতীয়দের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক সেই বিশ্বকাপে দ্রাবিড় দলের অধিনায়ক ছিলেন বলেই ব্যর্থতার দায় অনেকাংশেই তাঁর ওপর বর্তেছিল। বাংলাদেশের কাছে হারের পর দ্রাবিড়ের মাঠ ছাড়ার মুহূর্তটা ছিল ধু ধু মরুভূমিতে চলা একলা পথিকের বুকে জমা একরাশ হতাশার মতো। আর লঙ্কানদের সঙ্গে হার প্রায় নিশ্চিত হওয়ার পর কুইন্স পার্ক ওভালের ড্রেসিংরুমে বাঁ চোখে হাত দিয়ে নোনাজল মোছার মুহূর্তটাকে কিসের সঙ্গে তুলনা করবেন, তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন।

২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের হারের পর রাহুল দ্রাবিড়
এএফপি

২০১৩ সাল পর্যন্ত পেশাদার ক্রিকেট খেলেছেন দ্রাবিড়। বিলুপ্ত চ্যাম্পিয়নস লিগ টি-টোয়েন্টি ফাইনাল হয়ে আছে তাঁর শেষ ম্যাচ। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে সেই ‘অল ইন্ডিয়ান ফাইনালেও’ হার। পরের বছর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি রাজস্থানের হয়েই কোচিংয়ে হাতেখড়ি। আধুনিক ক্রিকেটে কোচিংয়েরই আরেকটু পরিশীলিত পদ পরামর্শকের ভূমিকায়।

২০১৫ সালে দ্রাবিড়ের অধীন রাজস্থান আইপিএলে তৃতীয় হলে সে বছরই তাঁকে ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল ও ‘এ’ দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। মাত্র কয়েক মাসেই যুবাদের দলকে দারুণভাবে গুছিয়ে তোলেন।

রাহুল দ্রাবিড়ের খেলোয়াড়ি জীবনের শেষটাও হয়েছিল ফাইনাল হেরে
বিসিসিআই

পরের বছরই দলকে নিয়ে যান অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে। ঋষভ পন্ত, ঈশান কিষান, ওয়াশিংটন সুন্দর, সরফরাজ আহমেদদের নিয়ে গড়া দলটা মিরপুর শেরেবাংলার সেই ফাইনালে নিরঙ্কুশ ফেবারিট ছিল। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে শিরোপা জিতে নেয় শিমরন হেটমায়ার, কিমো পল, আলজারি জোসেফদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্রাবিড়ের আরেকটি ফাইনাল হার! তবে ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে কিছুটা দুঃখ ভোলার কথা তো আগেই বলা হলো।

পরের গল্পটা কারও অজানা থাকার কথা নয়। তবু দ্রাবিড়ের শূন্য থেকে পূর্ণ হওয়ার রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে ধরার জন্যই বলা।

২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত সুপার টুয়েলভ পর্ব থেকে বিদায় নেয়। ওই বছরের নভেম্বরে রবি শাস্ত্রীর জায়গায় প্রধান কোচ হন দ্রাবিড়। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছিল তাঁর প্রথম বড় অ্যাসাইনমেন্ট। সেবার রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের নিয়ে যেতে পারেন সেমিফাইনাল পর্যন্ত। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ১০ উইকেটের হার ছিল আঁতে ঘা লাগার মতো।

ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে পুরোপুরি সেরে ওঠার সুযোগ গত বছরই এসেছিল। তা–ও একবার নয়, দুবার—জুনে লন্ডনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল আর নভেম্বরে আহমেদাবাদে ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল। দ্রাবিড় আবারও পরাজিতদের দলে, দুবারই হৃদয়ভঙ্গ অস্ট্রেলিয়ার কাছে।

আহমেদাবাদের প্রায় দেড় লাখ ভারতীয় সমর্থককে স্তব্ধ করে দেওয়া ফাইনালের পরই ভারতীয় দলকে বিদায় বলে দিতে চেয়েছিলেন দ্রাবিড়। কিন্তু আরেকটি বিশ্বকাপ (মানে সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ) যেহেতু সাত মাস পরই, আর এই দলটিকে যেহেতু দ্রাবিড়ই এত দূর নিয়ে এসেছেন, তাহলে আবার কোচিং স্টাফ বদল কেন? এ ভাবনা থেকেই বিসিসিআই তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তবে দ্রাবিড় জানিয়ে দেন, এবারই শেষ। এবার হলে হবে, নয়তো কখনো নয়। চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ানোর ইচ্ছা নেই।

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর কোচ দ্রাবিড়কে শূন্যে ভাসায় ভারতীয় দল
আইসিসি

দ্রাবিড়ের এই ঘোষণাতেই হয়তো ক্রিকেট–বিধাতা তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। ভারত যখনই কারও জন্য বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছে, কারও হাতে বিদায়ী উপহার হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দিতে চেয়েছে, তখনই ভালো কিছু হয়েছে। জীবনের শেষ বিশ্বকাপে এসে ট্রফির ছোঁয়া পাওয়া শচীন টেন্ডুলকার এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ। ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সবাই বলবেন, ‘আমরা টেন্ডুলকারের জন্য বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছিলাম।’

এবার তা দ্রাবিড়ের জন্য প্রযোজ্য হয়ে উঠেছিল। ভারতের কোচ হিসেবে তাঁর বিদায়ী বিশ্বকাপ বলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলেছে হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন, ‘ডু ইট ফর দ্রাবিড়’ (দ্রাবিড়ের জন্য বিশ্বকাপ জেতো)।

কেনসিংটন ওভালে পরশু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মহানাটকীয় বহু বাঁকবদলের ফাইনাল শেষে সফল দ্রাবিড়। অবশেষে সত্যিকারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। ২০০৭ সালে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁকে হতাশার সাগরে ভাসিয়েছিল, ১৭ বছর পর সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই তাঁকে ক্রিকেটীয় জীবনের সেরা দিনটি উপহার দিল।

২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যে ইংল্যান্ডের কাছে ১০ উইকেটে হেরেছিল তাঁর দল, এবার সেই ইংল্যান্ডকে সেমিফাইনালেই নাকানিচুবানি খাইয়ে ভারত উঠে যায় ফাইনালে। খেলোয়াড়-কোচ উভয় ভূমিকায় যে অস্ট্রেলিয়া বারবার তাঁকে ফাইনালে আটকে দিয়েছে, এবার শিরোপা জয়ের পথে সেই অস্ট্রেলিয়াকে সুপার এইট থেকে বিদায়ের পথ দেখিয়ে দ্রাবিড়ের দল যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, ‘তোমরা এবার ফাইনাল কেন, সেমিফাইনালেরও যোগ্য নও!’

ট্রফি নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার মুহূর্তে সিঁড়িতে ক্যামেরাবন্দী দ্রাবিড়
আইসিসি

২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পর টেন্ডুলকারকে কাঁধে নিয়ে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করেছিলেন কোহলি-পাঠান-রায়নারা। পরশু ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে কোহলিকে সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘এবার রাহুল দ্রাবিড় এটার যোগ্য।’ দ্রাবিড়কে কাঁধে তুলে কেনসিংটন ওভাল প্রদক্ষিণ করেনি ভারতীয় দল। তবে দলের সবাই মিলে তাঁকে শূন্যে ভাসিয়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, তাঁর মতো কিংবদন্তির স্থান অনেক অনেক ওপরে।

পরশু হাইনরিখ ক্লাসেন আর ডেভিড মিলার যখন প্রচণ্ড মারছিলেন, তখনো দ্রাবিড় খাতায় কী সব নোট নিচ্ছিলেন। অবাকই লাগছিল। আরে, এটা তো ফাইনাল। ভারতের কোচ হিসেবে তাঁর শেষ ম্যাচ। তাহলে ভুলগুলো টুকে রেখে লাভ কী?

আরও পড়ুন

পরক্ষণেই আবার মনে হলো তিনি তো রাহুল দ্রাবিড়, যিনি প্রক্রিয়া ঠিক রাখায় বিশ্বাস করেন, ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করেন। এখন তিনি ভারতীয় দলের অতীত। কিন্তু তাঁর দেশের ক্রিকেট তো থাকবে। তাঁর খাতাটাও থাকবে উত্তরসূরির দিক-নির্দেশিকা হয়ে।

বিশ্বকাপ জয়ের পর দলের সঙ্গে দ্রাবিড়ের এই উচ্ছ্বাস অনেক দিন মনে রাখবেন ভারতের সমর্থকেরা
আইসিসি

বারবার তীরে এসে তরী ডোবায় দ্রাবিড় নিশ্চয় উপলব্ধি করেছিলেন, বিশ্বকাপ জিততে হলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে হয়। এবার তাই ফাইনালপূর্ব সংবাদ সম্মেলেনে বলেছিলেন, ‘ভাগ্য সহায় হলে আমরাই জিতব।’ ফাইনালে ৬ উইকেট হাতে নিয়ে ৩০ বলে ৩০ রানের সমীকরণ মেলাতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। সেটাও ভারতের কোচ হিসেবে তাঁর বিদায়ী ম্যাচে। নিজের চেয়ে কাউকে বড় সৌভাগ্যবান কি মনে করতে পারবেন দ্রাবিড়?

ফাইনালে লাগাতার ব্যর্থতার পর অবশেষে সাফল্যের চূড়ায়—ব্যাপারটাকে অনেকে ‘দায়মোচন’ মনে করলেও দ্রাবিড় এ দলে নন। তাঁর ভাষায়, ‘(বড় মাপের) কত খেলোয়াড়ই তো (বিশ্বকাপ) ট্রফি জিততে পারেননি।’

‘সত্যিকারের’ বিশ্বকাপ জয়ের হাহাকার দূর হওয়ার পর দ্রাবিড়ের আর কী চাই? আসলেই তো আর কিছু চাওয়ার নেই। গতকাল ছিল জুনের শেষ দিন। আজ জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে তিনি ভারতের সদ্য সাবেক কোচ। তবু আরও কয়কেটা দিন দলের সঙ্গে থাকবেন। রুপালি ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরে রাজসিক সংবর্ধনায় ভাসতে হবে না!

ভারতের ড্রেসিংরুমে দ্রাবিড়কে আর দেখা যাবে না
আইসিসি

দ্রাবিড় কয়েকটা দিন যোগ করেই কথাটা বলেছেন, যে কথায় মিশে আছে তাঁর রসাত্মক দিকটাও, ‘আগামী সপ্তাহ থেকে আমি বেকার হয়ে পড়ছি। আশা করছি শিগগিরই এই (বিশ্বকাপ) জয়ের আবহ থেকে বেরোতে পারব।’

এমন বেকারত্ব যদি জীবনে সুখ বয়ে নিয়ে আসে, তাহলে সবাই নিশ্চয় রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই বেকার হতে চাইবেন!