বিপিএল ‘শেষনিশ্বাস’ ফেলছে না তো

বিপিএলের এমন দিনও ছিল! এক সময় খেলতেন বিশ্বের সেরা ক্রিকেটাররা। টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার ছিল গাড়ি। ২০১২ সালে টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার গাড়ির সঙ্গে সাকিবের এই ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাসই পড়েছবি: প্রথম আলো

দিন দিন কেমন সংকুচিত চেহারা নিয়ে নিচ্ছে বিপিএল। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের চাকচিক্য আর নেই। তারকা ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিতে মলিন হয়ে আসা বিপিএল নিয়ে বিসিবি কর্তারাও এখন আর উচ্চকণ্ঠ নন। আইপিএলের পর বিপিএলই দ্বিতীয় সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট বলে একসময় যাঁরা আওয়াজ তুলেছিলেন, তাঁদেরই একজন কাল মাঠের দিকে তাকিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বললেন, ‘সে তো তখন বলেছি, এখন কি আর বলি!’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

বিশ্ব ক্রিকেটে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ একটা পণ্য এবং সেই পণ্যের বাজারজাতকরণে পিছিয়ে পড়েছে বিসিবি। দক্ষিণ আফ্রিকায় আজ শুরু হচ্ছে এসএ২০, দুবাইয়ে ১৩ জানুয়ারি শুরু হবে ইন্টারন্যাশনাল লিগ টি–টোয়েন্টি (আইএল টি–টোয়েন্টি)। স্বাভাবিকভাবেই বড় বড় ক্রিকেটারের চোখ বিপিএলের চেয়ে অনেক বেশি অর্থকরী এই দুই টুর্নামেন্টের দিকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসে খেলতে আসা ইংল্যান্ডের ডেভিড ম্যালানকেই তাই আপাতত এবারের বিপিএলের সবচেয়ে বড় তারকা মেনে নিতে হচ্ছে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি সাবেক ফাস্ট বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস
ছবি: প্রথম আলো

কাল সিলেট স্ট্রাইকার্স–কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ম্যাচের পর অবশ্য মনে হলো ম্যালানও নন, এবারের বিপিএলের সবচেয়ে বড় তারকা যিনি, তিনি আসলে এই টুর্নামেন্টে খেলছেনই না! ক্যারিবীয় কিংবদন্তি সাবেক ফাস্ট বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস, গত পরশু ঢাকায় এসে কাল থেকে যিনি ধারাভাষ্যকক্ষে বসছেন। দিনের প্রথম খেলা শেষে ম্যাচ বিশ্লেষণ করতে মাঠে নেমে অ্যামব্রোসের ছবিশিকারি টিভি ক্রু আর সাংবাদিকদের কবলে পড়ার দৃশ্যটা দেখেই আসলে প্রথম মনে হলো, না, বিপিএলে একজন তারকাও আছেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

আইপিএলের আদলে বিপিএলটা মূলত ছিল বিসিবির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মস্তিষ্কপ্রসূত। ২০১২ সালে এই টুর্নামেন্ট মাঠে নামানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় ক্রিকেটারদের টি–টোয়েন্টির পারফরম্যান্সে উন্নতি আনা। বিশ্বের বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করে তাঁদের টি–টোয়েন্টিজ্ঞান ঋদ্ধ হবে, অনেক কিছু শিখবেন, জানবেন—এই ছিল আশা। সঙ্গে অর্থকড়ির ব্যাপারটা যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। কিন্তু বিসিবি বরাবরই বলে এসেছে, রাজস্ব আয়ের চেয়ে বিপিএলে তাদের বড় উদ্দেশ্য দেশের ক্রিকেটারদের টি–টোয়েন্টির মান বাড়ানো।

মুখ্য উদ্দেশ্যই হোক বা গৌণ—ত্রুটিপূর্ণ উচ্চাভিলাষী আর্থিক কাঠামোর কারণে বিপিএল শুরু থেকেই বিসিবির রাজস্ব আয়ে খুব বড় অবদান রাখতে পারেনি। উল্টো অনেক সময় খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক নিজেরাই দিয়ে দুর্বল আর ভেজালে ভরা ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছে। বিসিবি পরে বাধ্য হয়েছে বিপিএলের আর্থিক কাঠামো সংকুচিত করতে। কমিয়ে দেওয়া হয়েছে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক, ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি।

ফাঁকা গ্যালারি। বিপিএলে বেশির ভাগ ম্যাচে এমন দৃশ্যই দেখা যায়। বিকালের পর যা একটু দর্শক হয়
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় ক্রিকেটারদের মনোজগতে টি–টোয়েন্টির ধারণা হয়তো কিছুটা ঢোকাতে পেরেছে বিপিএল, তরুণ ক্রিকেটারদের উঠে আসার একটা পথও তৈরি হয়েছে। কিন্তু উপজাত হিসেবে অব্যবস্থাপনা, স্পট ফিক্সিংসহ বড় বড় বিতর্কের ঝাপটাও সইতে হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সমান্তরালে বিপিএল তাই কুড়িয়েছে ‘বকেয়া প্রিমিয়ার লিগ’, ‘বিতর্ক প্রিমিয়ার লিগ’ ইত্যাদি খেতাবও। এসব খেতাব মূলত সমালোচকেরাই দিয়েছেন। তবে এখন ব্যক্তিগত আড্ডায় বিসিবির কোনো বড়কর্তাও যদি বলে দেন বিপিএল আসলে ‘বাংলাদেশ পেইন লিগ’, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিপিএল নিয়ে এখন আর বিসিবির কোনো উচ্চাশা আছে বলেও মনে হয় না। বরং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত জ্বালা–যন্ত্রণাতেই অস্থির তারা। এক ডিআরএস নিয়েই তো কত হাঙ্গামা!

ডিআরএসের সরঞ্জাম মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে থাকার পরও টুর্নামেন্টে সেটি কার্যকর না থাকার কারণ হিসেবে বিসিবি বলছে, হক–আই পদ্ধতি চালানোর মতো বিশেষজ্ঞ নাকি তাঁরা পাননি। বিশেষজ্ঞরা সবাই এসএ২০ আর আইএল টি–২০–তে ‘বুকড’ হয়ে গেছেন। এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। বিসিবি যাদের দিয়ে বিপিএলের প্রোডাকশনের কাজ করছে, সেই রিয়েল ইমপ্যাক্ট কেন আগে থেকেই বিপিএলের জন্য হক–আই বিশেষজ্ঞ নিল না?

এটা ঠিক যে সব রকম প্রযুক্তিগত সুবিধা থাকার পরও আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ডিআরএসের কাজটা মূলত সেখানেই, ভুল আর বিতর্কের শঙ্কা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা। ১২ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া জিম্বাবুয়ে–আয়ারল্যান্ড সিরিজেও যেখানে ডিআরএস থাকবে বলে শোনা যাচ্ছে, সেখানে বিপিএলের মতো বহুজাতিক ক্রিকেটারদের টুর্নামেন্টকে বিতর্কমুক্ত রাখতে ডিআরএস না থাকাটা তো আলোচনার জন্ম দেবেই।

বিপিএলে আয়োজকদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন নতুন না। এবারও সেই প্রশ্ন উঠেছে
ছবি: প্রথম আলো

সব জেনেও শুধু টুর্নামেন্টের শেষ চার ম্যাচের জন্য ডিআরএস নিশ্চিত করার একটা কারণ হতে পারে বিপিএলের পেছনে খরচটাকে আর না বাড়ানোর চিন্তা। হক–আই পদ্ধতির জন্য প্রতি ম্যাচে খরচ হয় ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার ডলার। ফাইনালসহ টুর্নামেন্টের ৪৬টি ম্যাচেই ডিআরএস রাখলে খরচ হতো প্রায় ৪ লাখ ডলার। ক্রমশ ‘লো প্রোফাইল’ হয়ে আসা একটা টুর্নামেন্টের জন্য এই খরচ হয়তো বিসিবির বাড়তি মনে হয়েছে। সেটি হলে প্রশ্ন, খরচটা যেহেতু হচ্ছেই না, প্রডাকশনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের পাওনা থেকে বিসিবি সেটা কেটে রাখবে তো!

মৃতপ্রায় বিপিএলকে নতুন প্রাণ দিতে বিসিবি পারে টুর্নামেন্টটাকে দ্বিতীয় কোনো পক্ষের হাতে তুলে দিতে। ভারতের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান নাকি বিপিএলের আয়োজন স্বত্ব কিনে নিতে বিসিবিকে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রস্তাবও দিচ্ছে। দুবাইয়ের দুটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনতে। কিন্তু বিসিবি এখন পর্যন্ত সে পথে পা বাড়াতে রাজি নয়, এমনকি ভবিষ্যতেও বাড়াবে না বলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিপিএল বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট, এটিকে পুরোপুরি বাংলাদেশেরই রাখতে চায় তারা। তা ছাড়া এক সংকট দূর করতে গিয়ে আরেক সংকটে পড়ার শঙ্কাও যে আছে! ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টি ঘিরে বিশ্ব ক্রিকেটেই যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বেটিংয়ের জাল, বিসিবির শঙ্কা, বিপিএলও তখন সেই জালের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়তে পারে।

বিপিএলে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। এবার একটি ম্যাচে ওয়াইডের সিদ্ধান্ত নিয়ে আম্পায়ারের কাছে প্রতিবাদ জানান সাকিব
ছবি: প্রথম আলো

অবশ্য নিজেদের হাতে রেখেও কি টুর্নামেন্টটাকে বিসিবি সেই জাল থেকে বাঁচাতে পারছে? বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে বিসিবি বেটিং এবং বেটিং–সম্পৃক্ত যেকোনো প্রচারণার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে চলে। তাদের যেকোনো বাণিজ্যিক চুক্তিতেই সেটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। অথচ দেশে এবং দেশের বাইরে অনলাইন ও টেলিভিশনে বিপিএলের ম্যাচের সময় দেখা যাচ্ছে বেটিংসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, মাঠে থাকা বিজ্ঞাপন ম্যাটের জায়গায়ও ভার্চ্যুয়ালি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। এসব প্রতিষ্ঠান হয়তো সরাসরি বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত নয়, কিন্তু সেগুলোর বেটিং সাইটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা সবার জানা। ঠিক একই কারণে মাস কয়েক আগে সাকিব আল হাসান বাধ্য হয়েছেন বেটউইনার নিউজ নামের একটি ওয়েবসাইটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে, যাদের মূল সাইটটি বেটিংয়ের। অথচ এখন বিসিবির পণ্য বিপিএলেই পড়ছে বেটিং প্রতিষ্ঠানের ছাপ!

বাজি ধরা বৈধ, এমন অনেক দেশে সরাসরিই ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে বিভিন্ন বেটিং প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের আইনে বেটিং নিষিদ্ধ বলে এখানে হয়তো সরাসরি ঢোকার উপায় নেই, কিন্তু নানা ফাঁকফোকর গলে তা ঠিকই আক্রান্ত করছে বিপিএলকে। এখন প্রশ্ন, বিসিবি কত দিন পারবে বিপিএলকে এই ভয়ংকর জাল থেকে বাঁচিয়ে রাখতে? নাকি ডলার–দিরহামের কাছে হেরে যেতে থাকা টুর্নামেন্টটা দমবন্ধ হয়ে একপর্যায়ে শেষনিশ্বাসই ছেড়ে দেবে!

এমন শঙ্কার কারণ বিসিবির প্রভাবশালী এক কর্তার একটা খেদোক্তি—বিপিএলটা বন্ধ করে দিলে কী হয়!