কঙ্কাল–ব্যাটিং, ওয়ানডেতে বাংলাদেশ এখন ৫০ ওভারও খেলতে পারে না

কঙ্কাল–ব্যাটিংয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার এই চিত্র বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য খুবই নিয়মিত চিত্রপ্রথম আলো গ্রাফিকস

মেহেদী হাসান মিরাজের কথাতেই যেন ফুটে উঠল ছবিটা। গতকাল রাতে আফগানিস্তানের কাছে ধবলধোলাই হওয়ার পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিরাজ বললেন, ‘পুরো ৫০ ওভার খেলতে হবে আমাদের...’।

এই আকুতি এখন ওয়ানডে সংস্করণে বাংলাদেশ মাঠে নামলে শোনা যাচ্ছে নিয়মিতই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বাংলাদেশ এখন ব্যাট করতে পারছে না পুরো ৫০ ওভার!

এখন মানে সময়টা অল্পস্বল্পও নয়। সর্বশেষ ১০ ওয়ানডের মাত্র দুটি ম্যাচে অলআউট হয়নি বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে আফগানিস্তানের কাছে ধবলধোলাই হওয়ার পর তাই উঠতে শুরু করেছে এ প্রশ্নটাও—বাংলাদেশ কি পছন্দের সংস্করণ ওয়ানডে খেলতে ভুলে গেছে?

উত্তরটা বোলারদের জন্য কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে; কিন্তু ব্যাটসম্যানরা যে ওয়ানডে খেলতে পারছেন না, তা বলে দেওয়া যায় কোনো সংশয় ছাড়াই। পুরো ৫০ ওভার খেলা তো দূরের কথা, বাংলাদেশের জন্য শেষ দুই ম্যাচে কঠিন হয়ে গেছে এক শ পেরোনোও!

কাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে ৯৩ রানে অলআউট হয়ে তাঁরা ফিরিয়ে এনেছেন ৭ বছর আগের বাজে এক স্মৃতি। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ শেষবার এক শর নিচে অলআউট হয়েছিল ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। কেন এমন হচ্ছে? এককথায় উত্তর হতে পারে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য নেই।

ক্রিজে টিকে থাকার অভ্যাসটাই যেন হারিয়ে ফেলেছেন ব্যাটসম্যানরা
এসিবি

টি–টোয়েন্টির যুগে ওয়ানডে ব্যাটিংটা যে আলাদা, সেটিই ভুলতে বসেছেন তাঁরা। প্রয়োজনের সময় ধরে খেলা, এক–দুই রান নিয়ে ইনিংস এগিয়ে নেওয়া, শক্ত ভিত তৈরি হলে সেটির ওপর দাঁড়িয়ে চালিয়ে খেলার সামর্থ্যও কমেছে ব্যাটসম্যানদের।

আলাদা করে কোনো জায়গা নয়—টপ, মিডল কিংবা লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যান সব জায়গায় যোগ হয়েছে দুশ্চিন্তা। সেটি কাটাতে বাংলাদেশকে যেতে হচ্ছে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে। শেষ পর্যন্ত সেসব পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়েছে। ওপেনিংয়ের কথাই ধরুন, পঞ্চাশ পেরোনো জুটি বাংলাদেশ পেয়েছিল ১১ ম্যাচ আগে। এই সময়ে পাঁচবার উদ্বোধনী জুটি বদলানো হয়েছে, ৬ ব্যাটসম্যান খেলেছেন ওপেনিংয়ে। কিন্তু কোনো জুটিই ভরসা জোগাতে পারেনি।

আরও পড়ুন

টপ অর্ডারে ব্যর্থতা মাঝের ব্যাটসম্যানরাও সামলে নিতে পারেননি একদমই। এমন কাজের জন্য বাংলাদেশের বড় ভরসা ছিলেন মুশফিকুর রহিম। তাঁর অবসরের পর ‘কঙ্কাল’ হয়ে গেছে মিডল অর্ডার। গত ফেব্রুয়ারি–মার্চে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর ওয়ানডেকে বিদায় বলেন মুশফিক।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাটিং অর্ডারে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ—অর্থাৎ মিডল অর্ডারের জুটিগুলোয় এক শ ছাড়াতে পেরেছে মাত্র একবার। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে প্রথম ম্যাচে তাওহিদ হৃদয় আর মেহেদী হাসান মিরাজের এক শ ছাড়ানো মিডল অর্ডারে এ সময়ে বাংলাদেশের একমাত্র পঞ্চাশ ছাড়ানো জুটিও।

আফগান বোলার বিশেষ করে স্পিনারদের বল খেলতেই পারছেন না ব্যাটসম্যানরা
এসিবি

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বড় ইনিংস খেলার সামর্থ্য কি আসলেই কমে গেছে? তা বোঝা যাবে এই পরিসংখ্যানটাতে—শেষ ১৬ ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মাত্র একজনই সেঞ্চুরি পেয়েছেন। তাওহিদ হৃদয়ের সেই সেঞ্চুরিটা আবার ভারতের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে হেরে যাওয়া ম্যাচে।

এসব তো সংখ্যার বিচার। এর বাইরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে বড় একটা প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে দলের স্পিন বোলিং কোচ মুশতাক আহমেদের কথা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডের পর তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বল নয়, খেলেছে বোলার (রশিদ খানের) নাম দেখে!

আরও পড়ুন

নানা ধাপ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে এসেছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। শুধু তাঁদের সামর্থ্যের ওপরই নয়, নিজেদের কোচিং স্টাফের এক সদস্যের বলে দেওয়া কথাটা সত্য হলে, তা বড় প্রশ্ন তুলে দেয় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা নিয়েও।

ওয়ানডেতে খারাপ সময়টা খুব বাজ হওয়ার দিকে যাচ্ছে মেহেদী হাসান মিরাজের অধিনায়ক হওয়ার পর। নেতৃত্বের এই বদলটা পছন্দ ছিল না তাঁর পূর্বসূরি নাজমুল হোসেনের। অধিনায়কত্ব বদল হওয়ার পর থেকে ব্যাট হাতেও অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে গেছেন নাজমুল—৬ ম্যাচের মাত্র দুটিতে যেতে পেরেছেন দুই অঙ্কে।

অধিনায়ক হিসেবে মিরাজ এখনো পাশ–মার্কস তুলতে পারেননি
প্রথম আলো

নতুন অধিনায়ক মিরাজও সুবিধা করতে পারছেন না একদমই। ভারপ্রাপ্ত আর পূর্ণকালীন অধিনায়ক হিসেবে সব মিলিয়ে ১০ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া মিরাজও জয় পেয়েছেন মাত্র একটিতে। প্রশ্ন উঠছে তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়েও।

তবে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সংকটটা ‘কঙ্কাল’ হয়ে পড়া ব্যাটিং, প্রশ্নবোধক অধিনায়কত্ব কিংবা বোলিংয়ে তাসকিন আহমেদ–মোস্তাফিজুর রহমানের বিকল্প হাসান মাহমুদ–নাহিদ রানা–শরীফুল ইসলামরা হতে পারবেন কি না—এসব প্রশ্নের চেয়েও আরও গভীর। যেটি থেকে তাঁদের উতরে উঠতে হবে দ্রুতই। কারণ, ২০২৭ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে অন্তত সেরা নয়ে না থাকতে পারলে যে সরাসরি খেলা যাবে না বিশ্বকাপে।