সাক্ষাৎকারে আম্পায়ার মাসুদুর রহমান
‘ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা যেকোনো সিদ্ধান্তের পর খুবই ভদ্র ছিল’
বাংলাদেশ দলের এশিয়া কাপ শেষ আরও আগেই। কিন্তু আম্পায়ার মাসুদুর রহমান ও গাজী সোহেলের সৌজন্যে এশিয়ার ক্রিকেটযুদ্ধে বাংলাদেশের নামটা এখনো উচ্চারিত হচ্ছে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের হয়ে যাওয়া দুটি ম্যাচে মাসুদুর ছিলেন মাঠের আম্পায়ার। হাইভোল্টেজ দুটি ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল প্রশংসনীয়।
আরেক বাংলাদেশি গাজী সোহেলও এখন পর্যন্ত দুটি ম্যাচে মাঠের আম্পায়ার ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান-ভারতের ম্যাচ দুটি পরিচালনা করায় মাসুদুরকে নিয়েই হচ্ছে সব আলোচনা। কাল প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তান-ভারতের দুটি ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন মাসুদুর। জানিয়েছেন বাংলাদেশের আম্পায়ারিং নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: ভারত-পাকিস্তানের দুটি ম্যাচ পরিচালনা করলেন, কেমন লাগছে?
মাসুদুর রহমান: ভালো লাগছে। এখানে যাঁরা আছেন, সবাই খুব প্রশংসা করছে। আমাদের দেশের অন্যান্য আম্পায়ার, যেমন তানভির, সৈকত—ওরা তো অনেক প্রশংসা করেছে। মুঠোফোন অন করে দেখি আলিম দার মেসেজ করেছে। ডেভিড বুনের মেসেজ পেয়েছি। আইসিসিও অনেকে প্রশংসা করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও অভিনন্দন জানিয়েছে। যেহেতু আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন হয়নি, সবাই খুব খুশি, গর্বিত। এটা দেখে ভালো লাগছে। সবকিছুই যেন খুব দ্রুত হয়ে গেল। ঘটনাটা হঠাৎ করেই ইউ টার্ন নেওয়ার মতো ছিল।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: বাংলাদেশ দল নেই। কিন্তু আপনার মাধ্যমে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এখনো এশিয়া কাপে আছে...
মাসুদুর: দল না থাকলেও আমার মাধ্যমে বাংলাদেশ এখনো আলোচনায় আছে—এটা অবশ্যই ভালো লাগার বিষয়। আমাদের নামের সঙ্গে কিন্তু বাংলাদেশ নামটাও থাকে। আমরা ভালো করা মানেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়া। সবকিছু মিলিয়ে ভালো সময় যাচ্ছে। সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এমন টুর্নামেন্টের বড় ম্যাচ পরিচালনা করার এমনিতেই আলাদা আনন্দ আছে। আর যখন আপনি ভারত-পাকিস্তানের মতো দুটি ম্যাচ পরিচালনা করবেন এবং সফলভাবে শেষ করবেন, তাহলে তো কথাই নেই।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: আম্পায়ারিং তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবহেলিত অংশ। আপনার কী মনে হয়, ধীরে ধীরে বদল আসছে?
মাসুদুর: দেখুন, সাকিব-তামিমরা বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক অবদান রেখেছে। ওরা এত ভালো পারফর্ম করেছে যে সারা বিশ্ব এখন তাদের চেনে। ওদের কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট এত দূর এসেছে। আমরা যদি ভালো করি, তাহলে বাংলাদেশের আম্পায়ারদের নাম হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে অবহেলিত সেক্টর এটি। এখানে আমাদের ভালো করার জায়গা আছে। আমরা যদি সেটা করতে পারি, তাহলেই প্রাপ্য সম্মান পাব। এ টুর্নামেন্ট আমাদের জন্য একটা পরীক্ষা। আমরা যদি ভালোভাবে শেষ করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভালো অ্যাসাইনমেন্ট পাব। তাহলে আম্পায়ারিং নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা বদলে যাবে। যারা আম্পায়ারিং করতে চায়, তাদেরও আগ্রহ বাড়বে।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: এ পর্যায়ে আসতে করোনার সময় ঘরের মাঠের সিরিজগুলো আপনাদের কতটা সাহায্য করছে?
মাসুদুর: এটাই আসলে এত দূর আসার প্রধান কারণ। আমরা পরপর সাতটা সিরিজ করেছি। এরপর আইসিসির যে রিপোর্ট এসেছে, সেটা খুবই ভালো ছিল। এটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। আমাদের আম্পায়ারিংয়ের ব্যাপারে আইসিসির চিন্তাচেতনা তখনই পরিবর্তন হয়েছে। এত দিন আইসিসির ধারণা ছিল বাংলাদেশি আম্পায়াররা অনেক দুর্বল, ম্যাচ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তেমন নেই। তারা শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারেই সব মনোযোগ দেয়; ম্যাচ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মনোযোগ দেয় না। কিন্তু করোনার পর আইসিসির ধারণা পাল্টেছে। আমরা এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে আইসিসির অ্যাসাইনমেন্ট পাচ্ছি।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: যে দুটি বড় ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন, সেখানে দর্শকের শব্দ ছিল প্রচুর। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা কতটা প্রভাব ফেলেছে?
মাসুদুর: এমন ভরা স্টেডিয়ামে কট বিহাইন্ডের সিদ্ধান্ত দেওয়া খুব কঠিন। যদি বলে ডিভিয়েশন না থাকে, তাহলে আরও কঠিন। এ ক্ষেত্রে নিজেদের অনুভূতি ও চোখের ওপর আস্থা রেখেছি। আমার যেটা সঠিক মনে হয়েছে, সেটাই দিয়েছি।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: মাঠের নিয়ন্ত্রণ রাখাটা আইসিসি খুব গুরুত্ব দেয় শুনেছি...
মাসুদুর: যেহেতু হাইভোল্টেজ ম্যাচ, এখানে নিয়ন্ত্রণ রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। দুটি সিদ্ধান্ত ভুল দিলেও তেমন সমস্যা হবে না। কারণ, ডিআরএস আছে। সিদ্ধান্ত ভুল হলেও সেটা সঠিক হয়েই যাবে। এটা খেলার ফলাফলে প্রভাব ফেলবে না। প্রভাব ফেলবে ওয়াইড বলের সিদ্ধান্ত, ওয়ান বাউন্স কিংবা বিমারের সিদ্ধান্ত—এগুলো ডিআরএসে বদলানো সম্ভব নয়। সেগুলোয় আমাদের মনোযোগ ছিল।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: সর্বশেষ ম্যাচে আসিফ আলীর রিভিউয়ের ঘটনায় রোহিতের সঙ্গে আপনাকে কিছুক্ষণ কথা বলতে দেখা যাচ্ছিল। দুজনের মধ্যে তখন কী আলোচনা হচ্ছিল?
মাসুদুর: মজার আলাপ হচ্ছিল তখন। প্রথমে হার্দিক পান্ডিয়া এল, এরপর কে এল, রাহুল। ওরা এসে বলছিল, ‘তোমার কী মনে হচ্ছে?’ আমি বলেছি, ‘আমার তো নট আউট মনে হয়। আমি সেটাই দিয়েছি।’ সিদ্ধান্তটা দেওয়ার পর রোহিত এসে বলল, ‘আম্পায়ার, ছোট্ট স্পাইক দেখতে পেলাম যে?’ আমি তারপর তাকে বলেছিলাম, ‘গ্লাভস থেকে বল অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যে স্পাইকটা স্নিকো মিটারের দেখাচ্ছে, সেটা যেকোনো কিছু থেকে আসতে পারে।’ এ ছাড়া স্লো ওভার রেটের কিছু বিষয় নিয়ে রোহিতের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে এতটা ভদ্রতা প্রত্যাশা করা যায় না...
মাসুদুর: আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে একটা ওয়াইড বল মিস করলেও ১০ মাইল দূর থেকে বুঝতে পারবেন যে কী হয়েছে। যে দলের বিপক্ষে যায় সিদ্ধান্তটা, সেই দল এমন কিছু করে বসে যে সেটা সবার চোখে পড়ে। এই করলেন, সেই করলেন, ম্যাচ হারিয়ে দিলেন—আরও কত কথা! ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা যেকোনো সিদ্ধান্তের পর খুবই ভদ্র ছিল। কোনো সিদ্ধান্তে তাদের প্রশ্ন থাকলে তারা জিজ্ঞাসা করে। আপনি যদি তখন তাদের সব বুঝিয়ে বলতে পারেন, তাহলে ওরা কিছু বলবে না। কিন্তু ওদের চোখ–মুখ দেখলে বোঝা যায় যে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তখন আপনি প্রভাবিত হতে চাইবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: প্রথম ম্যাচে যখন স্লো ওভারের শাস্তি দেওয়া হলো দুই দলকে, তখন মাঠে কী ধরনের পরিস্থিতি ছিল?
মাসুদুর: দুই দলই অ্যালাউন্স চাইছিল। বল বাইরে গিয়েছে, কেউ এসে বলছে, ‘আম্পস, এটার অ্যালাউন্স আমাদের দিতে হবে।’ আবার এসে প্রতিপক্ষের কাউকে দেখিয়ে বলছিল, ‘দেখুন, সে কিন্তু দেরি করছিল।’ এসবই। বিশেষ কিছু নয়।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: মজার কোনো ঘটনা?
মাসুদুর: প্রথম ম্যাচে ফখর জামানের কট বিহাইন্ড দেওয়ার পর দিনেশ কার্তিক এসে বলছিল, ‘আপনি নিশ্চিত তো? বল আসলেই ব্যাটে লেগেছিল?’ তখন আমি বলেছি, ‘আমি একটা শব্দ শুনেছি। সেটা শুনে আউট দিয়েছি।’ পরে কার্তিক বলল, ‘আমি কিন্তু কোনো আওয়াজ পাইনি। এ জন্য আমি আপিল করিনি।’ পরে দেখা যায় যে আমার সিদ্ধান্তটাই ঠিক ছিল।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: বাংলাদেশের আম্পায়ারদের প্রতি আপনার বার্তা কী থাকবে?
মাসুদুর: বাংলাদেশি আম্পায়াররা কার যোগ্যতায় ম্যাচ পরিচালনা করছে, সেটা যেন মাথায় না নেয়। সবার যোগ্যতা আছে, তাই সবাই একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আসতে পেরেছে। সেটা থার্ড ডিভিশনের ম্যাচ হোক কিংবা প্রিমিয়ার লিগের। দেখুন, সাইমন টফেল আমাকে অনেক আগে একটা কথা বলেছিলেন, ‘যদি ভালো মানুষ না হন, তাহলে কখনো ভালো আম্পায়ার হতে পারবেন না।’ এরপর বাকিটা। আগে সততা থাকতে হবে। এরপর কে কত ভালো আম্পায়ার, সেটা একটা পর্যায়ে এসে হয়েই যায়। সততা থাকলে আপনাকে কেউ আটকাতে পারবে না। একদিন না একদিন আপনি জায়গা করে নেবেনই।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: ফাইনাল নিয়ে কোনো প্রত্যাশা?
মাসুদুর: এশিয়া কাপের অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়ার পর আমি আর গাজী সোহেল বলছিলাম, যদি বাংলাদেশ ফাইনাল খেলে, তাহলে তো হলোই; আর না খেললে আমাদের দুজনের একজন যেন ফাইনালে থাকি। এখনো অপেক্ষায় আছি এশিয়া কাপের ফাইনালের। পারফরম্যান্স দিয়ে সেখানে যেতে চাই। যদি আমাদের কেউ ফাইনালে থাকি, সেটা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করা হবে না, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা হবে।