তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল লর্ডসে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০০৫ সালের ২৬ মে। ২০ বছর পর সেই মুশফিকুর রহিম দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম টেস্ট খেলার দুয়ারে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যানের পুরো ক্যারিয়ারই কাছ থেকে দেখেছেন প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র। বাংলাদেশের ১১ ক্রিকেটারের গল্প নিয়ে ২০১৯ সালে প্রকাশিত উৎপল শুভ্রর লেখা 'এগারো' বইয়ের এক চরিত্রও মুশফিক। তাঁকে নিয়ে লেখাটাতে ক্রিকেটার মুশফিকের সঙ্গে মানুষ মুশফিককেও কিছুটা চিনতে পারবেন।
লর্ডস দিয়ে শুরু করব, না ওয়েলিংটন? নাকি দুবাই?
খুব স্বাভাবিক হয় গল আর মিরপুর দিয়ে শুরু করলে। মুশফিকুর রহিম বললে প্রথমে হয়তো সবার তা-ই মনে হয়। তাঁর সবচেয়ে বড় দুটি কীর্তির সাক্ষী তো এই দুটি স্টেডিয়াম। এমন কীর্তি, বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে যা উঠে গেছে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায়।
এক পাশে সাগর আর আরেক পাশে চার শ বছরের বেশি বয়সী এক ডাচ দুর্গ নিয়ে শুয়ে থাকা ছবির মতো গল স্টেডিয়ামে টেস্টে তাঁর প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। ৭৬তম টেস্টে এসে বাংলাদেশের পক্ষেও যা প্রথম। ইতিহাস তাই সেখানেও হয়েছিল, তবে সেটি চিরকালীন কিছুর রূপ পায়নি। যা পেল মিরপুরে। অপরাজিত ২১৯ টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ, এটা নিছকই একটা তথ্য। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তো, কী হয়েছে! প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, রানটাই-বা এমন কী! ক্রিকেট বিশ্বে এটি শোরগোল তোলার মতো কিছু নয়। তারপরও ঠিকই তা তুলল। কত শত ডাবল সেঞ্চুরির মধ্যে এটির অনন্যতা তো অন্য কারণে। প্রায় দেড় শ বছরের বুড়ো টেস্ট ক্রিকেট অবিশ্বাসে চোখ কচলে এই প্রথম দেখল, উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব সামলেও কোনো ব্যাটসম্যান দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারে! বাকি সব ছাপিয়ে মুশফিকুর রহিমের পরিচয় তাই ডাবল সেঞ্চুরি দিয়েই। তা হলে তো মুশফিক নিয়ে লিখতে গেলে গল আর মিরপুরই সবার আগে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়।
কিন্তু আমি কেন লর্ডস দিয়ে শুরু করতে চাইছি? কেন ওয়েলিংটন আর দুবাই-ও কানের কাছে ‘আমাকে দিয়ে শুরু করো’ ‘আমাকে দিয়ে শুরু করো’ বলে তারস্বরে দাবি তুলছে! লর্ডসটা তো আপনি অনুমান করতেই পারেন। ক্রিকেট-তীর্থেই শুরু তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। কিন্তু শুরু থেকেই শুরুর দিব্যি তো কেউ দেয়নি। লর্ডসের কথায় তাই পরে আসি। আগে ওয়েলিংটন আর দুবাই রহস্যের সমাধান হোক।
ওয়েলিংটন কেন? কারণ, আমার চোখে দুটি ডাবল সেঞ্চুরিকেও ছাপিয়ে ২০১৭ সালে ওয়েলিংটনে ১৫৯ টেস্ট ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিমের সেরা ইনিংস। আর দুবাই? কারণ, ওয়ানডেতে তাঁর সেরা ইনিংসটি দেখেছে এই মরুশহর। ২০১৮ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই ১৪৪ মুশফিকের ব্যক্তিগত হিসাবনিকাশ থেকে বেরিয়ে সম্ভবত বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসেরই সেরা। এভাবে একাই একটা ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়ার উদাহরণ হরহামেশা মেলে না।
যে ইনিংসটির কথা ভাবলে তামিম ইকবালের মুশফিকের জন্য খুব দুঃখ হয়। নিজেকে একটু অপরাধীও লাগে। ভাঙা হাত নিয়ে একটা বল খেলে ওই ম্যাচের ‘হিরো’ হয়ে যাওয়াটাকে মনে হয় মুশফিকের জন্য অভিশাপ। প্রসঙ্গটা উঠলেই আফসোস করেন, তাঁকে নিয়ে ধন্য-ধন্য রবে মুশফিকের ইনিংসটি প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। তামিমের ওই আফসোসেই আসলে যা পেয়ে যাচ্ছে। ইয়ান চ্যাপেল একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কে কী বলল, তাতে কিছুই আসে যায় না। একজন ক্রিকেটার মাথায় করে রাখেন শুধু তাঁর টিমমেটদের প্রশংসা। বাকিদের কথা গোল্লায় যাক, টিমমেটরা আপনাকে কীভাবে রেট করে, সেটাই আসল।’
চ্যাপেল ইংরেজিতে ‘রেসপেক্ট’ বলেছিলেন, প্রশংসার চেয়ে ‘শ্রদ্ধা’ই মনে হয় ভালোভাবে বোঝাতে পারে অর্থটা। পরে আরও অনেক ক্রিকেটারের মুখেই কথাটা শুনেছি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মুশফিকুর রহিম নিজেকে পরিতৃপ্ত ভাবতেই পারেন। বাংলাদেশ দলে তাঁর টিমমেটদের মধ্যে নানা বিষয়ে নানা মত আছে, তবে একটা জিনিস কমন পাবেনই পাবেন। মুশফিকের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। তাঁর ব্যাটসম্যানশিপের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি ক্রিকেটে তাঁর নিবেদনের প্রতি। ‘সম্ভবত’ শব্দটা আসলে এখানে অকারণে ব্যবহার করা হলো, শুধু নিশ্চিত না হলেই না নিরাপদ থাকার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। মুশফিকের ওই দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে তো কারও মনেই সংশয় নেই। ‘সংশয়াতীত’ বলে একটা শব্দও তো বাংলা ভাষায় আছে। সেটিই বরং এখানে ভালো মানায়।
ক্রিকেটের প্রতি তাঁর নিবেদনটা বুঝতে মুশফিকের টিমমেট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে যাঁদের নিত্য ওঠাবসা, সবারই তা জানা। কোচিং স্টাফ জানে, সাংবাদিকেরা জানেন, জানেন মুশফিকের সংস্পর্শে এসেছেন, এমন সবাই। পরদিন বাংলাদেশ দলের ঐচ্ছিক অনুশীলন। সবাই নিশ্চিত হয়ে যান, একজন মাঠে থাকলেও মুশফিক থাকবেন। সেটি আগের দিন কিপিং করার পর লম্বা ইনিংস খেললেও। বিকেএসপিতে তাঁর কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তো আর এমনিতেই বলেন না, ‘একজন কোচ চাইবেন, তাঁর সব ছাত্রই যেন মুশফিকুর রহিমের মতো হয়।’ মুশফিক ব্যাপারটা হালকা করতে বলেন, ‘আমার প্রতিভা কম তো, এ কারণে বেশি পরিশ্রম করতে হয়।’ সেটির এমনই ফল পেয়েছেন যে, তামিম ইকবাল একবার প্রস্তাব করেছিলেন, ‘পরিশ্রমে সৌভাগ্যের বসত’ বা ‘কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে’ জাতীয় প্রবাদগুলোর বদলে ‘মুশফিকুর রহিম’ ব্যবহার করলেই তো হয়। আমি তা একটু বদলে দিয়েছিলাম। ‘কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে’র বদলে ‘কষ্ট করলে ডাবল সেঞ্চুরি মেলে’ বললেই তো হয়। তাহলে তরুণ ব্যাটসম্যানদের উপকার হবে। শুনে মুশফিকুর রহিম হো হো করে হেসেছিলেন।
মুশফিকের প্রাণখোলা হাসি উল্লেখ করার মতোই একটা ব্যাপার। চাহিবামাত্র যেটি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের, বেশির ভাগ সময়ই নিজেকে নিজের মধ্যে একটু গুটিয়ে রাখেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার আগে মেজাজ-মর্জিটা আঁচ করে নেওয়াটাও তাই জরুরি। সেটি সবচেয়ে ভালো জানেন সাংবাদিকেরা। ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের ম্যাচ কাভার করলে বেশির ভাগ সময় টিম হোটেলেই থাকি। অন্য ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা হলেই কথা হয়, কখনো কখনো আড্ডাও। ম্যাচ বা অনুশীলন না থাকলে রাতভর আড্ডার অভিজ্ঞতাও তো আছে। সেসবে মুশফিককে পাওয়াটা অমাবস্যার চাঁদ পাওয়ার মতো।
তবে দেখা তো মুশফিকের সঙ্গেও হয়। তাঁর মুখ দেখে কথা বলতে খুব একটা ভরসা হয় না। ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ। একদিন লিফটের সামনে মুশফিককে পেয়ে বলেই ফেললাম, ‘মুশফিক, আপনার সঙ্গে কথা বলতে কেমন যেন ভয়-ভয় করে!’ হাসলে মুশফিকের পুরো মুখটা আলোকিত হয়ে যায়।
সমাধানটা মুশফিক পুরোপুরি গ্রহণ করলেন বলে মনে হলো না। নইলে কেন বলবেন, ‘আমরাও মানুষ। আমাদেরও ফ্যামিলি আছে। এমন অনেক কিছু লেখা হয়, যা আসলে সত্যি নয়।’ প্রথম আলো তে অন্তত আমরা এসব ব্যাপারে খুব সচেতন থাকি বলে আমি নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলাম।
সেই ঝকঝকে হাসিটা দিয়ে বললেন, ‘কী বলেন ভাই, সাংবাদিকেরা কাউকে ভয় পায় নাকি! উল্টো সাংবাদিকদেরই তো সবাই ভয় পায়। আমিও পাই।’ এরপর ভয় পাওয়ার কারণ হিসেবে সাম্প্রতিক ও দূর অতীত মিলিয়ে যে দু-তিনটি নিউজের কথা বললেন, তা তাঁর অতি স্পর্শকাতরতার প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মুশফিক, এসব কি আর খুব সিরিয়াস কিছু! তা ছাড়া আপনারা পাবলিক ফিগার, আপনাদের নিয়ে একটু কাটাছেঁড়া তো হবেই। প্রশংসাও তো কত হয়! দুটিতে কাটাকাটি করে নিলে দেখবেন, প্রশংসা ইনিংস ব্যবধানে জিতবে।’
সমাধানটা মুশফিক পুরোপুরি গ্রহণ করলেন বলে মনে হলো না। নইলে কেন বলবেন, ‘আমরাও মানুষ। আমাদেরও ফ্যামিলি আছে। এমন অনেক কিছু লেখা হয়, যা আসলে সত্যি নয়।’ প্রথম আলো তে অন্তত আমরা এসব ব্যাপারে খুব সচেতন থাকি বলে আমি নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলাম।
থাক, মানুষ মুশফিকের বিশ্লেষণে পরে আসি। দুবাইয়ের ব্যাখ্যাটা দেওয়া হয়েছে। লর্ডস আর ওয়েলিংটনটা এখনো বাকি। ওয়েলিংটনের ১৫৯-কে কেন দুটি ডাবল সেঞ্চুরির চেয়েও এগিয়ে রাখছি? ব্যাখ্যা তো একটু দাবি করেই। কারণ, ডাবল সেঞ্চুরি ডাবল সেঞ্চুরিই, ক্রিকেটের তা মুড়িমুড়কির মতো বিলানোর অভ্যাস নেই। এটির মহিমা খাটো না করেই বলি, দুই ডাবল সেঞ্চুরির চেয়েও অনেক কঠিন পরীক্ষায় জয়ের গল্প ওয়েলিংটনের ওই ১৫৯।
২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে গলের উইকেট ছিল প্রায় আক্ষরিক অর্থেই স্টেডিয়ামের পাশের রাজপথের মতো। পাঁচ দিনে পড়েছিল মাত্র ১৯টি উইকেট, রান উঠেছিল ১৬১৩। তিন সেঞ্চুরিখচিত বাংলাদেশের ৬৩৮ রানের প্রথম ইনিংস আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে সেই উইকেটের চরিত্র। টেস্ট শুরুর আগেই আমাকে যেটির আভাস দিয়ে রেখেছিলেন সেই মাঠের কিউরেটর জয়ানন্দ বর্ণবীরা। আমি বিশ্বাস করিনি। মনে হয়েছিল, এটাও একটা ‘খেলা’।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্বাগতিক দলের খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সে দেশের বাকিরাও তো প্রতিপক্ষের সঙ্গে যার যার মতো করে খেলে। এর আগে স্পিন-স্বর্গ বলে প্রমাণিত গলের উইকেট এবার এমন চরিত্র বদলে ব্যাটিং-স্বর্গ হয়ে যাবে, এটা কীভাবে বিশ্বাস করি! সেই ম্যাচে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস উইকেট নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করার পর আবার গেলাম বর্ণবীরার কাছে। বর্ণবীরা বললেন, ‘আপনিই বলুন, আমি আগেই বলেছিলাম কি না। অ্যাঞ্জেলোকেও বলেছি, তাড়াতাড়ি ইনিংস ছেড়ো না। বাংলাদেশ এখানে কমপক্ষে ৩৫০ করবে। এখন আমাকে দোষ দিয়ে লাভ কী!’ বর্ণবীরার কল্পনাও বাংলাদেশের ৩৫০ রানের বেশি দেখতে পায়নি। সেখানে ৬৩৮! এক ব্যাটসম্যান ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলবে, আরেক ব্যাটসম্যান প্রায় ডাবল সেঞ্চুরি—বাংলাদেশ দলই কি এটা কল্পনা করেছিল! গল তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটে চিরদিনই এক সুখস্বপ্ন হয়ে থাকবে। মুশফিকের জন্য তো আরও বেশি।
মুশফিকের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিতে উইকেট ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর মতো তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেনি। ২০১৮ সালের ওই টেস্টে মিরপুরের উইকেট গলের মতো বোলারদের বধ্যভূমি ছিল না। তবে এখানে মুশফিকের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ না হলেও মোটামুটি ভালো ‘বন্ধু’ জিম্বাবুয়ের বোলিং। আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড একটু পিছিয়ে থাকলেও থাকতে পারে, তবে পুরোনো টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর মধ্যে জিম্বাবুয়ের বোলিংই সম্ভবত দুর্বলতম। সম্ভবত শব্দটা তুলেও দিতে পারেন। গল আর মিরপুরের চেয়ে রানসংখ্যায় পিছিয়ে থেকেও এখানেই এগিয়ে ওয়েলিংটন।
মুশফিককে চিনতে খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন একটা তথ্যও খুব কাজে আসবে। বাংলাদেশ দলে একটু নিয়মিত হয়ে গেলে প্রায় সব ক্রিকেটারই যেখানে একাডেমিক লেখাপড়াটাকে অকারণ ঝামেলা মনে করে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেন, মুশফিকুর রহিম সেখানে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। ক্রিকেট নিয়ে মহা ব্যস্ততার মধ্যেও মাস্টার্স শেষ করেছেন।
বেসিন রিজার্ভের ওই উইকেটেও একটা ডাবল সেঞ্চুরি আছে। ডাবল সেঞ্চুরিয়ান সাকিব আল হাসানের সঙ্গে মুশফিকের ৩৫৯ রানের একটা রেকর্ড জুটিও। যা দেখে মনে হতেই পারে, সেটিই-বা এমন কী কঠিন উইকেট ছিল! কিন্তু ঘটনা হলো, আপাতদৃষ্টিতে ফ্ল্যাট মনে হওয়া কিউই উইকেটেও বোলারদের জন্য কিছু না কিছু থাকেই। বেসিন রিজার্ভেও ছিল। সাকিব আর মুশফিক খুব ভালো ব্যাটিং করেছিলেন বলে যা বোঝা যায়নি।
নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে কিউই ফাস্ট বোলারদের খেলা সব সময়ই পুরুষকারের চরমতম প্রদর্শনী দাবি করে। মুশফিক সেটি ভালোভাবেই মিটিয়েছিলেন। ভোররাতে উঠে সেই টেস্টে নিল ওয়াগনারের সঙ্গে মুশফিকের লড়াইটা দেখছিলাম আর রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। এই না হলে টেস্ট ক্রিকেট! একদিকে রাগী ফাস্ট বোলার আর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া অসীম সাহসী ব্যাটসম্যান।
প্রথম ইনিংসে ১৫৯ রানের চেয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে মুশফিকের মাত্রই ১৩ রানের ইনিংসটির মহিমাও কম ছিল না। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় বাউন্সারের ছোবলে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল ভেঙে গেছে। পরের দুই দিন মাঠেই নামেননি। দ্বিতীয় ইনিংসে দলের প্রয়োজনে ঠিকই নামতে হলো। পেশাদার ক্রিকেটে সৌজন্য-ভদ্রতা, প্রতিপক্ষের প্রতি সহমর্মিতা ড্রেসিংরুমে রেখেই মাঠে নামে দলগুলো। মুশফিকের চোট পাওয়া আঙুল কিউই বোলারদের ‘বুলস্ আই’য়ে পরিণত হওয়াতে তাই অখেলোয়াড়োচিত কিছু খুঁজে পাইনি। প্রথম ইনিংসে অত বড় একটা সেঞ্চুরির মুশফিককে যদি মহান বলি, দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেটে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের মুশফিককে বলতে হবে মহত্তর। আঙুলের ব্যথা সয়ে দাঁতে দাঁত চেপে যে লড়াইয়ের শেষ অ্যাম্বুলেন্সে মাঠ ছেড়ে।
সাউদির বাউন্সার কানের পেছনে লাগার পর যেভাবে পড়ে গিয়েছিলেন, তাতে আরেকটি ‘ফিল হিউজ’ ট্র্যাজেডির ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম। মাঠে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে, এই দৃশ্যটাই তো বুকে কাঁপন তোলার জন্য যথেষ্ট। ওয়েলিংটনে মুশফিকের প্রথম ইনিংসটা যদি ব্যাটসম্যানশিপে উজ্জ্বল হয়ে থাকে, দ্বিতীয় ইনিংসটা সাহস আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞায়। এই দুইয়ের যুগলবন্দীই আসলে মুশফিকুর রহিম। ওয়েলিংটনের ওই টেস্টটিকে তাই বলতে পারেন মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে বানানো এক ডকুমেন্টারি!
মুশফিককে চিনতে খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন একটা তথ্যও খুব কাজে আসবে। বাংলাদেশ দলে একটু নিয়মিত হয়ে গেলে প্রায় সব ক্রিকেটারই যেখানে একাডেমিক লেখাপড়াটাকে অকারণ ঝামেলা মনে করে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেন, মুশফিকুর রহিম সেখানে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। ক্রিকেট নিয়ে মহা ব্যস্ততার মধ্যেও মাস্টার্স শেষ করেছেন। এটা তো আর এক-দুই বছরের ব্যাপার নয়, পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকেই ক্রিকেট আর ক্রিকেট। আজ এখানে তো কাল ওখানে। আজ এই দেশে তো কাল ওই দেশে বললে বোধ হয় বুঝতে আরও সুবিধা হয়, কাজটা কেমন কঠিন ছিল! এত বছর ধরে কঠিন সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়াটা ‘আমি করেই ছাড়ব’—এমন একটা শপথ নেওয়া ছাড়া হওয়া সম্ভব ছিল না। অনেক ট্যুরেই বইপত্র নিয়ে যেতে হয়েছে, প্লেনে বসে পড়তে হয়েছে, কখনো-বা বিমানবন্দরেও। মুশফিকের মাস্টার্স শেষ করতে পারা এক দিক থেকে তাই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করার চেয়েও অনেক কঠিন ছিল। সেই কঠিন কাজটা করেছেন বলেই গলে ডাবল সেঞ্চুরির পর তাঁকে নিয়ে লেখাটার হেডিং করতে খুব সুবিধা হয়েছিল। মাস্টার্সে তাঁর বিষয় ছিল ইতিহাস। হেডিংটা তাই অনায়াসেই আঙুলের ডগায় এসে গেল—ইতিহাসের মুশফিক ইতিহাসে। প্রথম আলো র সেই পাতাটা ফ্রেমবন্দী হয়ে মুশফিকের ঘরে শোভা পাচ্ছে বলেই জানি।
এই হেডিংটার প্রসঙ্গেই তারা ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ‘তারা ভাই’ মানে মাহবুব হামিদ। মুশফিকুর রহিমের বাবা। বগুড়া জেলা দলের হয়ে ফুটবল ও ভলিবল খেলেছেন। কিন্তু ছেলের কারণেই হয়তো এখন ক্রিকেট-অন্তঃপ্রাণ। বাংলাদেশের যেকোনো ক্রিকেট ম্যাচে গ্যালারিতে অবধারিত উপস্থিতি শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটির। এমনই সরব উপস্থিতি যে কখনো কখনো মনে হয়, তাঁর বয়স বোধ হয় মুশফিকের চেয়েও কম! বাঁশি-টাশি বাজিয়ে, নেচে-গেয়ে চারপাশ সরগরম করে রাখেন। একবার একটা লেখায় তাঁকে তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘সাপোর্টার নাম্বার ওয়ান’ খেতাব দিয়ে দিয়েছিলাম। ছেলের খেলা দেখতে দেশের বাইরেও যান। সেবারও শ্রীলঙ্কায় গিয়েছেন। মুশফিক ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলবে জানলে নিশ্চয়ই টেস্ট সিরিজেই যেতেন। না যাওয়ার আফসোস নিয়ে আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওয়ানডে সিরিজ দেখতে গেছেন। ফোনে কথাও হয়েছে।
সেটিই খুব কাজে লাগল। ওয়ানডে সিরিজের গৎবাঁধা প্রিভিউ না করে ভিন্ন কী করা যায়, আমি তা হাতড়ে বেড়াচ্ছি। হঠাৎই মনে হলো, মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরির রেশ এখনো যায়নি, তারা ভাইও এখানে, তাঁর কথা দিয়েই সেটি করলে কেমন হয়! আবার ফোন দিয়ে কথা বলার পর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ-টিশ্লেষণ মিলিয়ে এত সুন্দর বললেন যে আমার কাজ বলতে বাকি থাকল শুধু তা সাজিয়ে লেখা। হেডিংটাও করলাম তাঁকে দিয়েই, ‘তারা ভাই’য়ের চোখে ওয়ানডে সিরিজ।
যেটিতে মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরির প্রসঙ্গও স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। আম্পায়ারের ভুল এলবিডব্লুর সিদ্ধান্তে শেষ হয়েছিল মুশফিকের সেই ইনিংস। এ নিয়ে একটু আফসোস করার পর তারা ভাই ক্ল্যাসিক এক বাণী দিলেন, ‘আম্পায়ার ওই ভুলটা তো মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরির আগেও করতে পারত। তাহলে আপনি যে লিখেছেন, “ইতিহাসের মুশফিক ইতিহাসে”, কিসের ইতিহাস, মুশফিক তো ভূগোলে পড়ে থাকত।’ বলেই হা হা করে হাসলেন। আমি হাসলাম আরও জোরে।
তারা ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের গল্পটাও এই সুযোগে বলে নিই। আমার সাংবাদিকতা-জীবনের বিব্রতকর যে স্মৃতির কথা আগেও নানা উপলক্ষে বলেছি। মনে আছে, ফোনটা এসেছিল মাছের বাজারের তুমুল শোরগোলের মধ্যে।
‘আপনি কি উৎপল শুভ্র বলছেন?’
‘জি, বলছি। আপনি কে বলছেন?’
‘আমার নাম মাহবুব হামিদ। আমি মুশফিকুর রহিমের বাবা।’
ফোন করার কারণটা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম। আগের দিন জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। কথা নিশ্চয় তা নিয়েই।
আমি তাই বললাম, ‘কনগ্র্যাচুলেশনস্। আপনার ছেলে তো আট নম্বরে নেমেও সেঞ্চুরি করে ফেলল।’
তারা ভাই বললেন, ‘এ জন্যই আপনাকে ফোন করেছি। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, একদিন প্রথম আলো তে আমার ছেলের ছবি ছাপা হবে।’
ও আচ্ছা, ছবি ছাপা হয়েছে বলে কৃতজ্ঞতা জানাতে ফোন।
আমি একটু হালকা সুরেই বললাম, ‘আপনার স্বপ্ন তো পূরণ হয়ে গেল। ছেলের ছবি তো ছাপা হয়েছে আজ। এভাবে খেলতে থাকলে আরও কত ছাপা হবে।’
অন্য প্রান্তে একটু নীরবতায় আমি একমুহূর্তে অনেক কিছু ভেবে ফেললাম। পেস বোলার শাহাদাতও ভালো করেছিলেন সেই ম্যাচে। ‘এ’ দলের ম্যাচ আর এমন কী, তাই এক কলামের মধ্যেই শাহাদাত আর মুশফিকের দুটি ছবি ছাপা হয়েছে। দুজনেরই হাফ কলাম করে ছবি আরকি, আকারে স্বাভাবিকভাবেই ছোট। এটাই কি তাহলে ভালো লাগেনি মুশফিকের বাবার!
কিন্তু তারা ভাই যা বললেন, তাতে তো আমার মাথা খারাপ অবস্থা। ‘ভাই, ফোনটা আমি ছবির কথা বলতেই করেছি। এটা আমার ছেলে নয়, অন্য কারও ছবি।’ তাঁর কণ্ঠটা খুব বিষন্ন শোনাল, ‘পেপারে প্রথম ওর ছবি ছাপা হলো, আর সেটিই ওর নাম দিয়ে অন্য একজনের। মনটা খুব খারাপ হয়েছে।’
ভুলটা কীভাবে হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝে ফেললাম। উদীয়মান প্রতিভা হিসেবে তখন মুশফিকুর রহিমের নাম একটু-আধটু শোনা যাচ্ছে। বয়সভিত্তিক দলে নিয়মিতই ছিলেন। মূলত উইকেটকিপার হিসেবে খেলেছেন, ব্যাটিং করেছেন অনেক নিচের দিকে। চেহারায় খুব বেশি মানুষ তখনো তাঁকে চেনে না। ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব বড় কোনো কীর্তি নেই। যে কারণে প্রথম আলো র ছবির বিশাল ভান্ডার খুঁজেও তাঁর পোর্ট্রেট খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক খুঁজে-টুজে প্রিমিয়ার লিগে মুশফিকের দল ওল্ড ডিওএইচএসের একটা গ্রুপ ছবি পাওয়া গেছে। সেখান থেকে মুশফিককে খুব ভালো চেনেন দাবি করে তা কেটে বের করে দিয়েছেন আলোকচিত্র সাংবাদিক। এখন তো দেখা যাচ্ছে, ওটা মুশফিক নয়, তাঁর কোনো ওল্ড ডিওএইচএস সতীর্থের।
মাস তিনেক পর লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নেমেছি। সেদিনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাটা হাতে নিয়ে খেলার পাতায় গিয়েই দেখি, মুশফিকুর রহিমের বিশাল এক ছবি। নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে প্রস্ত্ততি ম্যাচে দারুণ এক সেঞ্চুরি করেছেন। সাসেক্সের বিপক্ষে আগের ম্যাচে খেলেছেন ৬৩ রানের এক ইনিংস। বয়স তখনো সতেরোও হয়নি, দেখতে লাগে আরও কম। তাঁর ব্যাটিং ইংল্যান্ডে এমনই আলোড়ন তুলেছে যে ছবির ক্যাপশনে লেখা: লিটল ওয়ান্ডার!
তারা ভাইয়ের ফোনটার কথা মনে পড়ে গেল। ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো প্রথম লেখাটা শুরুও করলাম এ দিয়ে: মুশফিকুর রহিমের বাবা নিশ্চিত থাকতে পারেন, আর কোনো দিন পত্রিকায় মুশফিকুরের ভুল ছবি ছাপা হবে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, ইংল্যান্ডেও এখন তাঁকে সবাই চেনে।
ইংল্যান্ডের ওই সফরে মুশফিকের ‘পর্যটক’ হয়েই থাকার কথা ছিল। টেস্ট সিরিজের পর ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ, সঙ্গে বেশ কটি প্রস্তুতি ম্যাচ—প্রায় দুই মাসের সফর। টেস্ট স্কোয়াডে মুশফিকের চমক জাগানো সিলেকশন খালেদ মাসুদের বিকল্প উইকেটকিপার হিসেবে। মূলত প্রস্ত্ততি ম্যাচে তাঁকে একটু বিশ্রাম দিতে। পরপর দুটি প্রস্ত্ততি ম্যাচে অমন ব্যাটিংয়ের পর দেখা গেল, লর্ডসে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে প্রথম নামটিই লিখতে হয় মুশফিকুর রহিম।
কথায় কথায় লর্ডসে চলেই এলাম। মাত্র ১৬ বছর ২৬৭ দিন বয়সেই মুশফিকের আলোড়ন তোলা টেস্ট অভিষেক। টেস্ট অভিষেকে বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারের স্মরণীয় কীর্তি আছে। মুশফিকের অভিষেক নিয়ে আলোড়ন অন্য অর্থে। অভিষেকের আগে বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে এত হইচই হয়নি। লর্ডসে এত কম বয়সে যে কেউ কখনো টেস্টই খেলেনি।
বাংলাদেশের ১০৮ রানের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১৯। টেস্ট ক্লাসটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওতেই। ১৭৭ মিনিট স্থায়ী বাংলাদেশের ইনিংসের প্রায় অর্ধেকটা সময়ই (৮৫ মিনিট) ক্রিজে, আদর্শ ইংলিশ কন্ডিশনে সাপের মতো সুইং করতে থাকা বলে হাবুডুবু খাওয়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দও লেগেছিল তাঁকেই।
দ্বিতীয় টেস্টেও না খেলার কোনো কারণ ছিল না। খেলতে পারেননি ডারহামের হেরিটেজ টাইপ টিম হোটেলের আদ্যিকালের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা মচকে ফেলায়। দশ মাস পর দ্বিতীয় টেস্ট খেললেন বগুড়ায়। ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো উইকেটকিপার কি জীবনের প্রথম দুটি টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন? টেস্ট ইতিহাসে আদ্যিকালে কেউ খেললেও খেলে থাকতে পারেন। সাম্প্রতিককালে তো নয়ই, সময়ের সরণিতে হেঁটে অনেকটা পিছিয়ে যাওয়ার পরও এমন কাউকে খুঁজে পেলাম না। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিকুর রহিমের একাধিক ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটি এক অর্থে তাই কোনো বিস্ময় নয়।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা মুশফিকের এই উচ্চতা প্রসঙ্গেই টেনে এনেছিল বড় বড় সব নাম, ‘ডন ব্র্যাডম্যান, হানিফ মোহাম্মদ, সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারার মতো অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানই উচ্চতায় খাটো। মুশফিকুর রহিমও তাঁদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।’
মুশফিককে নিয়ে আসল যে বিস্ময়, সেটি শুরুতেও ছিল, এখনো আছে। যখনই তাঁকে দেখি, মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হয়, ছোট্ট এই শরীরটায় কোথায় লুকিয়ে অমন সব শট খেলার শক্তি! লর্ডসে তাঁর টেস্ট অভিষেকের আগে তাঁর বয়স নিয়ে যত আলোচনা হয়েছিল, শারীরিক আকৃতি নিয়েও ততটাই। ইংলিশ সংবাদমাধ্যম সেই বিস্ময় মনে না রেখে মুশফিকের কাছে প্রকাশও করেছিল। মুশফিকের জবাবটা ছিল ক্ল্যাসিক, ‘ক্রিকেট তো বয়স বা উচ্চতার খেলা নয়।’
দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা মুশফিকের এই উচ্চতা প্রসঙ্গেই টেনে এনেছিল বড় বড় সব নাম, ‘ডন ব্র্যাডম্যান, হানিফ মোহাম্মদ, সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারার মতো অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানই উচ্চতায় খাটো। মুশফিকুর রহিমও তাঁদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।’
মুশফিক সম্ভবত এটি পড়েননি। পড়লে মাঠে নেমে তাঁর হাত-পা জমে যাওয়ার কথা! কী সব কিংবদন্তির সঙ্গে তুলনা! এঁদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে আমি মুশফিককে মেলাতে পারি। শরীরের গড়নের দিক থেকে হানিফ মোহাম্মদ, আর ক্রিকেটকে সাধনায় পরিণত করায় শচীন টেন্ডুলকার। ২০০১ সালে হানিফ মোহাম্মদকে তাঁর করাচির বাড়িতে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে আমার বিস্ময়ই কাটছিল না। এই হালকা-পাতলা ছোটখাটো মানুষটি কীভাবে অমন ফাস্ট বোলারদের সামলে টেস্টে ১৬ ঘণ্টার বেশি ব্যাটিং করেছেন! তখন তো ব্যাটসম্যানরা হেলমেট-আর্ম গার্ড-থাই গার্ড-চেস্ট গার্ডে সজ্জিত হয়ে এমন গ্ল্যাডিয়েটরের বেশেও নামতেন না। হানিফ আমাকে বলেছিলেন, ব্রিজটাউনে টেস্ট ইতিহাসের দীর্ঘতম ইনিংসটি খেলার সময় তিনি মোটা একটা রুমাল পকেটে গুঁজে নিতেন। সেটাই ছিল তাঁর ‘থাই গার্ড’! শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল!
মুশফিকের টেস্ট অভিষেকের কথা ভাবলে কেন যেন আমার ডেভিড ফ্রিথকে মনে পড়বেই পড়বে। ইতিহাসবিদ আর লেখকসত্তা মেলালে ক্রিকেট বিশ্বে তাঁর কোনো তুলনা নেই। সম্ভবত এই সময়ের সেরা ক্রিকেট লেখক গিডিয়ন হেইগ একবার আমাকে কার যেন বিখ্যাত এক বাণীর অনুকরণে বলেছিলেন, ‘আমি যা ক্রিকেট জানি, ডেভিভ ফ্রিথ তার চেয়ে বেশি ভুলে গেছেন।’ ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে ফ্রিথের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। সাংবাদিকদের মধ্যে ডনের বাড়িতে একমাত্র তাঁরই ছিল অবারিত দ্বার। ক্রিকেটে আশ্চর্য রকম আচ্ছন্ন এক মানুষ। অন্য কোনো খেলা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। লর্ডস টেস্ট শুরুর আগের রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেই অত্যাশ্চর্য ফাইনালটি হয়েছে। এসি মিলানের সঙ্গে তিন গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত জিতেছে লিভারপুল। ক্রিকেটের প্রেসবক্সেও মুখে মুখে সেই ম্যাচ। এক সাংবাদিকের সঙ্গে আরেক সাংবাদিকের দেখা হলে কথাই শুরু হচ্ছে এ দিয়ে।
অথচ ফ্রিথের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর ‘কালকের ফাইনালটা দেখেছেন? কী একটা ম্যাচই না হলো!’ বলার পর পাল্টা প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম, ‘কোন ফাইনাল?’
প্রথমে ভেবেছিলাম, রসিকতা করছেন।
‘কেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল!’
শুনে উত্তর দিলেন, ‘ওহ্, ফুটবল! আমি ফুটবল দেখি না। ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলাই দেখি না।’
ক্রিকেট নিয়েও চরম রক্ষণশীল। বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় জানার পরই প্রশ্ন করেছেন, ‘আচ্ছা, আমাকে বলো তো, বাংলাদেশ কেন টেস্ট ক্রিকেট খেলবে?’ বাংলাদেশের টেস্ট খেলার যোগ্যতা নিয়ে তখন নিয়মিতই প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশ টেস্ট খেলায় টেস্ট ক্রিকেটের জাত-কুল-মান সব বিসর্জনে চলে যাচ্ছে ভেবে ইংলিশ মিডিয়া মহা চিন্তিত। লর্ডসে বাজেভাবে হারার পর এক পত্রিকায় তো এমনও লেখা হয়েছে, ভবিষ্যতে এই হতচ্ছাড়া বাংলাদেশিদের লর্ডসের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া উচিত নয়। ফ্রিথের প্রশ্নটা সেই লাইনেই ভেবেছিলাম। কিন্তু আসলে তা নয়। অদ্ভুত এক বিশ্বাসের মশাল তাঁর হাতে—যেসব দেশের অনেক বছরের ক্রিকেট ঐতিহ্য আছে, তারাই শুধু টেস্ট ক্রিকেট খেলবে। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের ‘ফালতু’ স্লোগান শুনলে তাঁর গা জ্বলে যায়।
লর্ডস স্টেডিয়ামের স্পেসশিপ সদৃশ প্রেসবক্সের পেছনে পানাহারের একটা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়েই ফ্রিথের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। দুজনেরই চোখ দেয়ালে ঝোলানো টেলিভিশনে। বাংলাদেশের আরেকটা উইকেট পড়তেই কথার মাঝখানে হঠাৎই ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ‘যাই, প্রেসবক্সে গিয়ে বসি। ওই ছেলেটা এখন নামবে।’ বাংলাদেশের টেস্ট খেলা নিয়েই এমন ঘোর আপত্তি, তাহলে খেলা দেখতে এসেছেন কেন? প্রশ্নটা অনেকক্ষণই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জবাবটা দিলেন যেতে যেতে, ‘মুশফিকুর রহিম না কী যেন নাম, আমি ওই ছেলেটাকে দেখতে এসেছি। ইউ ডোন্ট গেট দ্য চান্স টু সি আ সিক্সটিন ইয়ার ওল্ড প্লেয়িং টেস্ট ক্রিকেট এভরি ডে।’
চার-পাঁচ দশকের ক্রিকেট দেখার চোখ দিয়ে মুশফিককে দেখে পরে আমাকে বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে, এই বালকের (‘বয়’-এর আক্ষরিক অনুবাদ) মধ্যে জিনিস আছে।’ তা যে আছে, সেটি তো এখন সবারই জানা। ভেতরে আগুনও আছে। স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হয়ে দুটি টেস্ট খেলার পর উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট অভিষেক ২০০৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে। সেটিও কার জায়গায়? খালেদ মাসুদ পাইলট, তর্কযোগ্যভাবে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা উইকেটকিপার। প্রথম ৪৭টি টেস্টের ৪৪টিতেই যিনি খেলেছেন। নতুন ভূমিকায় নামছেন, টেস্টের আগের দিন টিম হোটেলের করিডরে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সামনে এনে বসিয়ে দেওয়া হলো মুশফিককে।
এক সাংবাদিক অবধারিত প্রশ্নটা করলেন, ‘পাইলট দলে থাকার পরও আপনি কি এই সিরিজে উইকেটকিপার হিসেবে খেলার আশা করেছিলেন?’
উত্তরে পাইলটের প্রশংসা-টশংসা করে তাঁর মতো বা কাছাকাছি পারফর্ম করলেও খুব খুশি হবেন, এমনই তো বলবেন মুশফিক।
সেসবের ধারেকাছেও না গিয়ে ঝাঁজালো কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমি তো এখানে খেলতেই এসেছি। এখানে বেড়াতে এসেছি নাকি?’
কেউ একজন প্রশ্ন করলেন, ‘প্রস্ত্ততি ম্যাচে অপরাজিত ৩৩ রান কি আপনার দলে আসায় ভূমিকা রেখেছে?’ মুশফিক মুখে একটু বিরক্তি ফুটিয়েই বললেন, ‘লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটে ৩৩ কোনো রানই না।’
প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক খুবই মাইন্ড করলেন। মুশফিক উঠে যাওয়ার পর ‘চরম বেয়াদব এক ছেলে’ বলে রায়ও দিয়ে দিলেন। আমার কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দই হলো। বলার ধরনটা হয়তো আরেকটু মোলায়েম হতে পারত, সেটিকে ধর্তব্যে না নিয়ে আত্মবিশ্বাসটাকেই আমি বড় করে দেখলাম। অনানুষ্ঠানিক সেই সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকের সাধারণ বাংলাদেশি ক্রিকেটারের চেয়ে একটু ভিন্ন ধরনের চরিত্র আরও নানাভাবেই প্রকাশ পেয়েছিল।
কেউ একজন প্রশ্ন করলেন, ‘প্রস্তুতি ম্যাচে অপরাজিত ৩৩ রান কি আপনার দলে আসায় ভূমিকা রেখেছে?’
মুশফিক মুখে একটু বিরক্তি ফুটিয়েই বললেন, ‘লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটে ৩৩ কোনো রানই না।’
উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে বলতে গেলে এটা তাঁর নতুন করে টেস্ট অভিষেক প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘বগুড়া টেস্টেও কিন্তু আমি ২০-২৫ ওভারের মতো কিপিং করেছিলাম।’
সেটির সূত্র ধরেই প্রশ্ন হলো, ‘পাইলটের মতো উইকেটকিপারের জায়গায় আপনাকে নেওয়ার বড় কারণ তো ব্যাটিং। ব্যাটিংয়ে বাড়তি প্রত্যাশাটাকে কি চাপ মনে হচ্ছে?’
মুশফিক উত্তর দিলেন, ‘আমরা পেশাদার। পেশাদারদের এসব ভাবলে চলে না।’
বাংলাদেশের অনেক তরুণ ক্রিকেটারের শুরুর দিকের সংবাদ সম্মেলনে থাকার সুযোগ হয়েছে। এমন চমৎকৃত খুব বেশি হয়েছি বলে মনে পড়ে না । মুশফিককে নিয়ে লেখার শেষটা করেছিলাম তাই একটা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে—এই ছেলে অনেক দূর না গেলে অবাক হতে হবে। পুরোনো পত্রিকা থেকে বের করে লেখাটা পড়ার পর মনে হলো, লাইনটা ভালো হয়নি। ‘এই ছেলে অনেক দূর না গেলে সেটিই হবে বিস্ময়কর’ লিখলে আরও ভালো হতো। যা-ই হোক, অর্থ তো তাতে একই থাকত। ঠিক থাকত ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে এক শতে এক শ নম্বর পাওয়াও।
মুশফিকের দাদা এখনো বেঁচে আছেন কি না, জানি না। তাঁর কথা আসছে ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গেই। মুশফিকের কোনো একটা সাক্ষাৎকারেই পড়ে থাকব। মুশফিক ছোট্টটি থাকতেই আলহাজ মোজাম্মেল হোসেন নাকি বলতেন, ‘আমার নাতি নামকরা ক্রিকেটার হবে। একদিন বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করবে।’ এটা পড়েছি অনেক পরে। আমার লেখায় মুশফিক সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় আমি তাঁর দাদা আছে কি নাই, এটাই জানতাম না। কাজেই মোজাম্মেল সাহেবের কথায় প্রভাবিত হয়ে আমি ওই কথা লিখেছিলাম বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না!
কলম্বোর পি সারাভানামুত্তু স্টেডিয়ামে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের যুগল ভূমিকায় এক অর্থে মুশফিকের ‘আসল’ টেস্ট অভিষেক। তাতে তাঁর ব্যাটিং দেখার পর আমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হওয়ার ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম। প্রথম ইনিংসে ২টি চারে ৯ বলে ৯ রান করে ফেলার পর সে সময় বাংলাদেশের জন্য আতঙ্কের অন্য নাম মুরালিধরনের বলে আউট হয়ে গেলেন। দ্বিতীয় ইনিংসেও মুরালিই খেলেন তাঁকে। তবে তাতে মুরালির খুব একটা কৃতিত্ব নেই। হাফ ভলি বলটাতে ‘বাউন্ডারি’ লেখা ছিল। মুশফিক একটু দোনোমনা করাতেই উল্টো সেটি ক্যাচ হয়ে ফেরত মুরালির হাতে। এর আগেই অবশ্য ৮০ রান করা হয়ে গেছে। ২৩৫ মিনিটে ১৮৩ বলের ওই ইনিংসে ৯টি চারের সঙ্গে সেই টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র ছক্কাটিও ছিল। পুরোনো নোট বই বের করে দেখছি, তিন টেস্টের সেই সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যেটি একমাত্র ছক্কাও। সেটি মুরালিধরনকেই মেরেছিলেন।
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা তাঁর প্রাপ্যই ছিল সেদিন। যেটি পেতে অপেক্ষা করতে হলো প্রায় আড়াই বছর এবং আরও ১৩টি টেস্ট। যা এল ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি এমনিতেই কেউ ভোলে না। আর এখানে যেভাবে এসেছিল সেই সেঞ্চুরি, সেটির প্রতিটি মুহূর্ত মনে থাকার কথা। সেঞ্চুরিটা একটু অভাবনীয়ও ছিল বটে। নবম উইকেট পড়ে যাওয়ার সময় ৬২ রানে অপরাজিত ব্যাটসম্যানের তো সেঞ্চুরির কথা ভাবারই কথা নয়। ভারতীয় বোলিং নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে উঠে পরের ২৮ বলে ৩৯ রান তুলে ঠিকই তা করে ফেললেন মুশফিক। ১৭টি চার আর ১টি ছয়ে খচিত ১১২ বলের সেই সেঞ্চুরি তখন বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে দ্রুততম। ক্ষণস্থায়িত্বের দিক থেকেও রেকর্ডটি মনে রাখার মতো। ঢাকায় পরের টেস্টেই ১০১ বলে সেঞ্চুরি করে মুশফিকের কাছ থেকে যা কেড়ে নেন তামিম ইকবাল।
টেস্টই বলুন বা ওয়ানডে—মুশফিকের সব কটি সেঞ্চুরিই বিশেষ কিছু। ২০১৪ এশিয়া কাপে ফতুল্লায় ভারতের বিপক্ষে ওই সেঞ্চুরিটার কথা মনে পড়ছে। ম্যাচটা পরিণত হয়েছিল দুই অধিনায়কের লড়াইয়ে। মুশফিকের ১১৩ বলে ১১৭ রানের ইনিংসটি দেখতে দেখতে মনে গুঞ্জরিত জন আর্লটের সেই অমর দুটি লাইন। কবি, ক্রিকেট লেখক, ধারাভাষ্যকার, ওয়াইন সমঝদার—একই মাথায় কত মুকুটই না পরেছিলেন ইংল্যান্ডের এই ভদ্রলোক! শুধুই সংখ্যায় সেঞ্চুরির মাধুর্য বোঝানোর অক্ষমতা নিয়ে যিনি লিখেছিলেন, ‘রেকর্ডেড সেঞ্চুরিস্ লিভ নো ট্রেস, অন মেমোরি অব দ্যাট টাইমলেস গ্রেস।’ আমাদের জালাল আহমেদ চৌধুরী যেটির সুন্দর অনুবাদ করেছেন—নথিবদ্ধ সেঞ্চুরির থাকে না তো দায়, অন্তহীন মাধুরীর চিহ্ন রেখে যায়। ওয়ানডের কোনো ইনিংস দেখে এমন কিছু মনে হওয়াটা একটু অস্বাভাবিকই। কিন্তু মুশফিক যে সেদিন এমন ব্যাটিংই করেছিলেন! খেলা দেখতে দেখতে ক্রিকইনফোর কমেন্টারিতে চোখ রাখছিলাম। মুশফিকের সেঞ্চুরিটা হয়ে যাওয়ার পরই কে যেন মন্তব্য করলেন, ‘দিস্ ৫-৫ ফিট গাই ইজ টলার দ্যান এভারেস্ট নাও।’
পরদিন দুপুরে টিম হোটেলে নিজের রুমের খোলা দরোজার সামনে বসে থাকা মুশফিক কী যে করুণ এক ছবি হয়ে দেখা দিলেন! পাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হেলমেট, প্যাড, থাই গার্ড। টুকরো একটা কাপড় দিয়ে যত্ন করে ব্যাটটা মুছছেন। আমার কেন যেন মনে হলো, মনে মনে অভিমান করে বলছেন, ‘তোমাকে এত যত্ন করি, আর তুমিই কিনা কাল আমার সঙ্গে এমন প্রতারণাটা করলে!’
শেষ ওভারে আউট হয়ে ফেরার সময় ভারতীয়রা দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে মুশফিকের পিঠ চাপড়ে দিয়ে এসেছিল। মুশফিকের দুর্ভাগ্য, বিরাট কোহলি সেদিন আরও ‘টলার’ হয়ে গিয়েছিলেন। ১২২ বলে ১৩৬ করে হারিয়ে দিয়েছিলেন মুশফিককে। কোনো কোনো দিন লেখার শিরোনাম করতে জান বেরিয়ে যায়। আর সেদিন সেটি লেখা শুরু করার আগেই মাথায় এসে গিয়েছিল—মুশফিক ভালো, কিন্তু কোহলি আরও ভালো।
বাংলাদেশের এই দলে কাউকে ‘ক্রাইসিসম্যান’ বলতে হলে সেটিও মুশফিকই। তিনি উইকেটে থাকলে যে ভরসাটা পাওয়া যায়, বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যানই তা দিতে পারেন না। শুধু ‘ক্রাইসিস’ই বা কেন! দল খারাপ অবস্থায় থাকলেও মুশফিক ভরসা, ভালো অবস্থায় থাকলেও। ওয়ানডেতে দ্রুত কয়েকটি উইকেট পড়ে গেছে—মুশফিক তো এখনো আছেন। ওয়ানডেতে শেষ দিকে বেশি রান তুলতে হবে—মুশফিক তো আছেন।
মুশফিকের বেশির ভাগ বড় ইনিংসই দলের বিপদে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায়। ওয়ানডেতে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরিটাতে হতে হতেও তা হতে পারেননি বলে আনন্দের বদলে সেটি উল্টো দুঃখ হয়ে গেছে। ২০১১ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে হারারের ওই ম্যাচে বলতে গেলে একাই বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন জয়ের সঙ্গে করমর্দনের দূরত্বে। শেষ ওভারে ৮ রান লাগে জিততে, অন্য প্রান্তে শেষ ব্যাটসম্যান। প্রথম বলে ২ রান নিয়ে জয়টাকে একটি শটের দূরত্বে নামিয়ে এনেছেন। সেই ২ রানেই তাঁর সেঞ্চুরি হয়েছে। ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি, অথচ ব্যাটও তোলেননি। আসল কাজটা করেই তুলবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন হয়তো। দ্বিতীয় বলে ছক্কায় ম্যাচ শেষ করতে গিয়ে লং অনে ক্যাচ হয়ে গেলেন। মাঠ থেকেই কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়েছিলেন। ড্রেসিংরুমে ফিরে আরও ভেঙে পড়েছেন। ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফিটা নিতে পর্যন্ত বেরোননি। পরদিন দুপুরে টিম হোটেলে নিজের রুমের খোলা দরোজার সামনে বসে থাকা মুশফিক কী যে করুণ এক ছবি হয়ে দেখা দিলেন! পাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হেলমেট, প্যাড, থাই গার্ড। টুকরো একটা কাপড় দিয়ে যত্ন করে ব্যাটটা মুছছেন। আমার কেন যেন মনে হলো, মনে মনে অভিমান করে বলছেন, ‘তোমাকে এত যত্ন করি, আর তুমিই কিনা কাল আমার সঙ্গে এমন প্রতারণাটা করলে!’
বাইরে নিরুত্তাপ দেখালেও আবেগটা তাঁর একটু বেশিই। মিরপুরে ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হারার পর সাকিবের কান্নার ওই ছবিটি মনে আছে তো? ছোঁয়াচে হয়ে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া সেই কান্নাকাটির সূচনাটা করেছিলেন মুশফিকই। সাকিবকে জড়িয়ে ধরে তিনিই প্রথম কাঁদতে শুরু করেন। সেই ঘটনার পর তারা ভাই আমাকে বলেছিলেন, ‘ওদের এই কান্নার ব্যাপারটা কিন্তু নতুন নয়। ড্রেসিংরুমে মুশফিক প্রায়ই কাঁদে। এবার ঘটনাটা মাঠে হয়েছে বলেই সবার কাছে এটি নতুন লেগেছে।’
এই আবেগ বা তা নিয়ন্ত্রণ করার অক্ষমতাই হয়তো ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওই ‘বেঙ্গালুরু-ট্র্যাজেডি’র মূলে। ভারতের বিপক্ষে ভুতুড়ে সেই ম্যাচে শেষ ওভারে মুশফিকের পরপর দুটি চারে সমীকরণটা ৩ বলে ২ রানে নেমে আসার পর কল্পনাও করা যায়নি, ওই ম্যাচ বাংলাদেশ হারতে পারে! এখনো যতবার মনে হয়, অবিশ্বাস জাগে। ভারতের সেই দলের টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীকেই যেমন ওই ম্যাচের এক বছর পরও বিস্ময়ে অভিভূত দেখলাম। ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ইন্টারভিউ করছি। দুদিন পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সেমিফাইনাল। সেই প্রসঙ্গেই বেঙ্গালুরু টেনে এনে শাস্ত্রী বললেন, ‘তোমাদের তুলনা হয় না! আমরা লাগেজ-টাগেজ গুছিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য রেডি হয়ে গিয়েছিলাম। আর তোমরা প্লেটে করে ম্যাচটা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছ, তোমাদের দেশে বিশ্বকাপ, আর তোমরা থাকবে না! না, তোমরা যেয়ো না।’
মুশফিকের কাছেও এর কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। তাঁর কাছেও আসলে ব্যাখ্যা নেই। তবে মনে মনে হয়তো তিনিও মানেন, দ্বিতীয় চারটা মারার পর বুনো উল্লাসে ফেটে পড়াই এলোমেলো করে দিয়েছিল তাঁর মনোজগৎ। এর কদিন পর যে কাণ্ডটা করেছিলেন, সেটি তো রীতিমতো ছেলেমানুষি। ভারত টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেওয়ার পর মুশফিক টুইট করে বসলেন, ‘ Happiness is this...!!!!! ha ha ha-!!!! India lost in the semifinal.’ একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের এটা একদমই মানায় না বুঝতে পেরে পরে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
পুরো ব্যাপারটার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে বলে মনে হয় আমার। শয়নে-স্বপনে তাড়া করা বেঙ্গালুরু-দুঃস্বপ্নের অসহ্য মানসিক চাপ আর নিতে পারছিলেন না মুশফিক। বিস্ফোরিত হয়ে যা বেরিয়ে এসেছে ওই টুইটে।
আবেগের কাছে আত্মসমর্পণের ঘটনা আরও আছে। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে ওয়ানডে সিরিজ হারার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে হুট করে অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে দেওয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অধিনায়ক মুশফিককে বিচার করতে গেলে আমি অবশ্য একটু ধন্দেই পড়ে যাই। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পরপরই দলের খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে নতুন কিছু চেষ্টা করেছেন। এসবের মধ্যে বিতর্কিতভাবে যাঁকে সরিয়ে অধিনায়ক করা হয়েছিল তাঁকে, সেই সাকিবকে ‘তুমি বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি’ জাতীয় কথাবার্তা লেখা ফ্রেমে বাঁধানো একটা উপহার দেওয়ার কথা মনে পড়ছে। দারুণ লেগেছিল ব্যাপারটা। মাঠে তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে কাউকেই উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি, কিন্তু রেকর্ড দেখুন। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ৭টি টেস্ট জিতেছে তাঁর নেতৃত্বে। এর মধ্যে আছে ‘ঐতিহাসিক’ বলে স্বীকৃতি পাওয়ার মতো বড় বড় তিনটি জয়—মিরপুরে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কা। ‘জিতলে জিতব, হারলে হারব। ড্রয়ের জন্য আর খেলব না’—এই চিন্তা থেকে দেশের মাটিতে টার্নিং উইকেট বানানোর যে ধারা, সেটিও মুশফিকেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি নিজে ব্যাটসম্যান, এই চিন্তা করতে তাই সাহস লাগে। ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর নিজের জীবন কেমন কঠিন হয়ে উঠবে—এটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দলের কথা ভেবেছেন। ড্র করার চেষ্টা আর কত, এবার একটা মরণকামড় দেওয়া যাক। সেই মরণকামড়েই তো মরল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া।
অধিনায়ক মুশফিকের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও তো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। অধিনায়কত্ব তাঁর ব্যাটের ওজন না বাড়িয়ে সেটিকে বরং আরও হালকা করে দিয়েছিল। অধিনায়কের ভূমিকায় ৩৪ টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৪১.৪৪। ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৩৫.১৪। ছয় টেস্ট সেঞ্চুরির চারটিই অধিনায়ক মুশফিকের ব্যাট থেকে। সেই চারটিই দেশের বাইরে বলে বাড়তি কিছু নম্বরও যোগ করতে হয়। এরপর অবধারিতভাবেই প্রশ্নটা আসে—তাহলে মুশফিককে কেন অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো?
ক্ষমতাবানদের অপ্রিয়ভাজন হওয়ার ভয়কে পাত্তা না দিয়ে মনের কথা বলে দেওয়াটা মুশফিকের জন্য নতুন কিছু নয়। টেস্টে বাংলাদেশ যখন খুব খারাপ করছিল, প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে দেশের ক্রিকেটের অবকাঠামো, ঘরোয়া ক্রিকেটের অব্যবস্থাপনা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন। যার একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। কিন্তু বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের তা ভালো লাগবে কেন! বিপিএল নিয়ে যখন জগাখিচুড়ি অবস্থা, ধুয়ে দিয়েছেন সেটিকেও। এটা দিয়েও মুশফিককে ভালো চেনা যায়।
সবচেয়ে বেশি শোনা ব্যাখ্যা, কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই তাঁর বনিবনা হচ্ছিল না। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টের সময় যা চরমে ওঠে। কিন্তু তাঁর অধিনায়কত্ব তো গেল হাথুরুসিংহে বিদায় হওয়ার পর। যেটির ব্যাখ্যা, অপ্রিয় সত্যি কথা বলার অভ্যাসটা বোর্ডে অনেককে তাঁর শত্রু বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মুশফিকের নেতৃত্বে দল সাফল্য পাচ্ছিল বলে নীরবে সহ্য করে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সবাই ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের ভরাডুবি সেই সুযোগ করে দেয়। ২০১৭ সালের সেই সফরে নিজের অনিচ্ছায় কিপিং গ্লাভস খুলে রাখতে হয়েছিল তাঁকে। স্পেশালিস্ট স্লিপ ফিল্ডার হলে ভিন্ন কথা, নইলে অধিনায়কের চিরকালীন ফিল্ডিং পজিশন মিড অন বা মিড অফ। বড়জোর কাভার বা মিড উইকেট। মোট কথা উইকেটের কাছাকাছি, যাতে বোলারের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হয়। অথচ মুশফিককে দেখা গেল, বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করছেন। সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন হবেই। মুশফিক বলে দিলেন, আমি তো ক্লোজ পজিশনে ফিল্ডিং করতে পারি না। কারও নাম উল্লেখ না করলেও ইঙ্গিতটা বুঝতে কারোরই সমস্যা হয়নি। নিশ্চয়ই কোচ এই জাতীয় কিছু বলেছেন। টিম ম্যানেজমেন্টকে অধিনায়কের এমন খোঁচা বড় খবর হতে বাধ্য। হয়েছিলও।
ক্ষমতাবানদের অপ্রিয়ভাজন হওয়ার ভয়কে পাত্তা না দিয়ে মনের কথা বলে দেওয়াটা মুশফিকের জন্য নতুন কিছু নয়। টেস্টে বাংলাদেশ যখন খুব খারাপ করছিল, প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে দেশের ক্রিকেটের অবকাঠামো, ঘরোয়া ক্রিকেটের অব্যবস্থাপনা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন। যার একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। কিন্তু বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের তা ভালো লাগবে কেন! বিপিএল নিয়ে যখন জগাখিচুড়ি অবস্থা, ধুয়ে দিয়েছেন সেটিকেও। এটা দিয়েও মুশফিককে ভালো চেনা যায়।
‘বিপিএল’ হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। মনে যা-ই থাক, নিজেরা নিজেরা যা-ই বলুন, প্রকাশ্যে কারও মুখে বিপিএলের বিরুদ্ধে একটি কথাও শুনবেন না। মুশফিক পরোয়া করেননি।
মুশফিককে নিয়ে আলোচনায় মাশরাফির মুখে একটা কথা অনেকবারই শুনেছি, ‘সলিড ছেলে’। সেটির বড় একটা প্রমাণ আমি নিজেও পেয়েছিলাম। ঘটনাটা ২০১১ সালের। হঠাৎ একদিন সকালে মুশফিকের ফোন। ‘হঠাৎ’ বলছি, কারণ মুশফিকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। জরুরি প্রয়োজন হলে এসএমএসই ভরসা। মুশফিকের ফোন পেয়ে তাই বেশ অবাকই হলাম। ঘটনা কী?
ঘটনা হলো, আগের দিন প্রথম আলো তে ছাপা হওয়া একটা রিপোর্টে মুশফিককে নিয়ে কী যেন লেখা হয়েছে, যেটি একদমই সত্যি নয় বলে মুশফিকের দাবি।
যে লেখাটার কথা বলছেন, সেটি তো আমি নিজেই দেখে ছেড়েছি। লেখাটা শুধু মুশফিককে নিয়েও নয়। তাহলে কী নিয়ে মুশফিকের আপত্তি? তাঁর কাছ থেকে সেটি জানার পর পত্রিকায় ছাপা হওয়া লেখাটা আবার পড়লাম। লেখার মাঝখানে তাঁকে নিয়ে দু-তিনটি লাইন। মুশফিকুর রহিমের সহ-অধিনায়কত্ব হারানোর কারণ সম্পর্ক যেখানে লেখা হয়েছে, ‘গত ইংল্যান্ড সফরে এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের কিছু আচরণে ঠিক সন্তুষ্ট ছিলেন না ম্যানেজার তানজীব আহসান সাদ। সফর শেষে ম্যানেজারের প্রতিবেদনে সেটি উল্লেখও করেছিলেন।’
পড়ার পর মনে হলো, এ আর এমন কী! মুশফিককে কী বলব, সেটির প্রস্তুতি নিয়ে তাঁকে ফোন করলাম, ‘মুশফিক, এটা তো এমন সিরিয়াস কিছু নয়। আপনার বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগও করা হয়নি। আর ম্যানেজারের চোখে এমন কিছু পড়লে তিনি তো তা লিখতেই পারেন।’
মুশফিকের কণ্ঠ অসম্ভব গম্ভীর, ‘আপনি কী বলছেন এটা? এটা সিরিয়াস কিছু না? আমার খেলা নিয়ে যার যা ইচ্ছা বলুক, কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাকে কে কীভাবে দেখল, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবাই পড়ে কী ভাববে?’
এবার আমি ব্রহ্মাস্ত্রটা প্রয়োগ করলাম, ‘এটা তো আমাদের কথা নয়। ম্যানেজারের রিপোর্টে এমন কিছু থাকলে আমরা তো তা লিখতেই পারি।’
মুশফিক বললেন, ‘কেউ আপনাদের ভুল বলেছে। ম্যানেজারের রিপোর্টে এমন কিছু নেই। সাদ ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।’
‘ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিচ্ছি’ বলে আপাতত নিষ্কৃতি পেলাম। সাদ ভাইকে ফোন করে জানলাম, মুশফিকের দাবিই সত্যি। আমাদের সোর্স ভুল ছিল। আরও নিশ্চিত করতে সাদ ভাই বিসিবিতে জমা দেওয়া তাঁর রিপোর্টের একটা কপিও আমাকে মেইল করে দিলেন। তাতে মুশফিক নিয়ে একটা লাইনও নেই।
এরপর পত্রিকার রীতি অনুযায়ী সবচেয়ে স্বাভাবিক হতো, মুশফিককে একটা প্রতিবাদপত্র পাঠাতে বলে সেটি ছেপে দেওয়া। কিন্তু আমার মনে হলো, ভুলটা যখন আমরাই করেছি, সেটি বুঝতেও পেরেছি, মুশফিককে কেন প্রতিবাদপত্র পাঠাতে হবে? মানুষ হিসেবে ভালো থাকাটাই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ—এই কথাও মনে খুব দাগ কেটেছিল। আমি তাই ‘দুঃখিত, মুশফিকুর রহিম’ শিরোনাম দিয়ে ছোট্ট একটা বক্স নিউজ করে ফেললাম। ইচ্ছাকৃত না হলেও আমরা যে বড় ভুল লিখেছিলাম, সেটি স্বীকার করে মুশফিকের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ।
সেটি ছাপা হওয়ার দিন ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা রাবীদ ইমামের এসএমএস পেলাম: হোয়াট আ নাইস জেশ্চার!
আমি উত্তর দিলাম: মুশফিকুর রহিম ডিজার্ভস্ ইট, প্রোবাবলি মোর।
কথাটা মন থেকেই বলা।
