এবারও কি ব্যাটসম্যান–অলরাউন্ডারের কেউ সেরা হবেন

২০০৭ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হন পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি (বাঁয়ে), ভারতের বিরাট কোহলি এই স্বীকৃতি পান টানা দুবার—২০১৪ ও ২০১৬ সালেএএফপি, আইসিসি

এই প্রশ্নের উত্তর জানলে লেখে কোন বোকা! বাজিটাজি ধরে একাকার করে ফেলা যেত! তা-ও না পারলে অন্তত একটা টিয়া পাখি ও কিছু পুরোনো খাম নিয়ে বসা যেত রাস্তার পাশে।

আসলে জানা নেই বলেই লিখতে হচ্ছে। তবে টিয়ার ঠোঁটে তুলে নেওয়া খামে কী লেখা, তা দেখতে যান অনেকেই। এখানেও আলাদা নয়। যাঁরা লেখাটা পড়ছেন এবং যিনি লিখছেন, কেউ-ই আসলে উত্তরটা জানেন না। বিশ্বকাপ কে বা কারা মাতাবেন, তা আগে থেকে কীভাবে বলা সম্ভব!

তেমনি ভাগ্য বলাও সম্ভব না। পেটের টানে, কখনো-বা আগ্রহীর চাপে বলতে হয়। টিয়ার মালিক শনি, রাহু, কেতুর গতিবিধি দেখে বলে দেন, তেমনি ক্রিকেটেও গতিবিধি দেখা হয়, তবে অন্য কিছুর। জাত, ফর্ম, বড় মঞ্চে কেমন—এসব। পণ্ডিত থেকে ভক্তরা সেসব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ধরে নেন, অমুক ও তমুক কিংবা ওঁদের ভালো করার সম্ভাবনা আছে। কখনো মেলে, কখনো না। মেলে কতটা, সেটার রূপক-প্রমাণ হতে পারেন ফুটপাতে বসা সেই টিয়া পাখির মালিক। অন্য কোথাও কি আর বসা হয়! লোকের ভিড়ও কিন্তু কমে না। মানুষ জানতে চায়।

ইন্টারনেট আসার আগে পত্রপত্রিকা ছিল সেসব জানার মাধ্যম। চায়ের কাপে যুক্তিতর্কের ঝড় উঠেছে তারপর। কিন্তু এখন মনের মধ্যে একটি তালিকা প্রস্তুত করাই থাকে এবং তা সব সময় আপডেটেড হয়। আর পত্রপত্রিকার অপেক্ষায় থাকতে হয় না। এখন, যা যা জানতে চাই, আঙুলের স্পর্শেই পাই। পত্রপত্রিকার বাজির ঘোড়াদের সঙ্গে বরং নিজেদেরগুলো মিলিয়ে দেখার আনন্দ-ই বেশি। কমন না পড়লে যাচাই করা যায় তৎক্ষণাৎ। টিয়া পাখির সামনে বসে থাকা সেই কাস্টমারের মতোই। জীবন নিয়ে তাঁর নিজের রূপরেখার সঙ্গে টাকায় কেনা বুলিগুলো মেলায়। সে যা হোক, একটি ‘কমন’ ব্যাপার দিয়ে শুরু করা যাক—

শহীদ আফ্রিদি, তিলকরত্নে দিলশান, কেভিন পিটারসেন, শেন ওয়াটসন, বিরাট কোহলি (দুবার), ডেভিড ওয়ার্নার ও স্যাম কারেন।

এখন পর্যন্ত শুধু স্যাম কারেনই বোলিং পারফরম্যান্স দিয়ে টুর্নামেন্টসেরা হয়েছেন
শামসুল হক

ধারাবাহিকভাবে সবাই একেকটি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। মোট সাতটি নামের মধ্যে ছয়টি নামই বড় মাপের তারকাদের। নিজের সেরা সময়ে সেরাদের কাতারেই ছিলেন। কারেন ভালো অলরাউন্ডার, কিন্তু ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে কারেন কি আপনার এই তালিকায় ছিলেন? থাকলে খুব ভালো, কিন্তু না থাকলে বলতে হয়, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বড় তারকাদের আসর। ছোটদের জন্য সুযোগ নেই, তা নয়। একটি-দুটি ইনিংস বা স্পেলও বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হাতে পুরস্কারের কথা উঠলে এবারও কমন তালিকাটাই আগে আসবে।

এই তালিকাটা কিন্তু প্রতি বিশ্বকাপের আগেই তৈরি হয়। এমন কিছু ক্রিকেটার সেসব তালিকায় থাকেন, যাঁরা এরই মধ্যে কিংবদন্তি কিংবা সেটা হওয়ার পথে। ফর্মের হিসাব–নিকাশ তাঁদের ক্ষেত্রে চলে না। পরীক্ষিত, মঞ্চটাও বড় এবং তাঁরাও বড় মাপের খেলোয়াড় হওয়ায় মাতানোর তালিকায় ওপরের দিকেই থাকেন।

আগের আটটি আসরের সেরা খেলোয়াড় বিবেচনায় বলা যায় ব্যাটসম্যান এবং অলরাউন্ডারদের সুযোগই বেশি। কারণ, আটটি আসরের সেরা খেলোয়াড়দের চারজন ব্যাটসম্যান এবং তিনজনই অলরাউন্ডার। তাই বলে বোলারদের যে সুযোগ নেই, তা কিন্তু নয়।

এবারও যেমন আছেন বিরাট কোহলি, বাবর আজম, শাহিন আফ্রিদি, জস বাটলার, ডেভিড ওয়ার্নার, রোহিত শর্মা, জনি বেয়ারস্টো, যশপ্রীত বুমরা, রশিদ খান, কেইন উইলিয়ামসন, কাগিসো রাবাদা, প্যাট কামিন্স, হাইনরিখ ক্লাসেন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ডেভিড মিলার, সাকিব আল হাসান…। এঁদের ব্যাপারে আসলে বিশ্লেষণ চলে না। মাতাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কেউ হয়তো শুরু থেকে, কেউ হয়তো দু–এক ম্যাচ পর কিংবা শেষের নকআউট ম্যাচগুলোও হতে পারে। এমনকি পরে না পারলেও আগে থেকে বলার উপায় নেই যে পারবেন না! দিনের পর দিন পারফরম্যান্সের কথাটা কারও বলার সুযোগ তাঁরা নিজেরাই রাখেননি।

একসঙ্গে আফগানিস্তান অধিনায়ক রশিদ খান (বাঁয়ে) ও নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন। বিশ্বকাপ মাতাতে পারেন তাঁরাও
এক্স

কোহলি যেমন আইপিএলেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন। দেদার রান করছেন। স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্নও উড়িয়ে দিচ্ছেন তুড়ি মেরে। ট্রাভিস হেডের স্ট্রাইক রেট আবার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। সেঞ্চুরি আছে দুজনেরই। ওদিকে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে বাবরও দারুণ ফর্মে। অন্য ভাষায় সবই আসলে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মাতানোর প্রস্তুতি।

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে আইপিএল যেহেতু সর্বশেষ ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট—এই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স ধরেই কিছু বিষয় আন্দাজ করা যায়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, মাতানোর সুযোগটা কাদের বেশি? আগের আটটি আসরের সেরা খেলোয়াড় বিবেচনায় বলা যায় ব্যাটসম্যান এবং অলরাউন্ডারদের সুযোগই বেশি। কারণ, আটটি আসরের সেরা খেলোয়াড়দের চারজন ব্যাটসম্যান এবং তিনজনই অলরাউন্ডার। তাই বলে বোলারদের যে সুযোগ নেই, তা কিন্তু নয়। ২০০৭ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শহীদ আফ্রিদির সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে যেমন বোলিংয়ের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। আর এবার ভালো বোলারের সংখ্যাও তো কম নয়।

২০১৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভারে টানা ৪ ছক্কা মেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মহানায়ক বনে গিয়েছিলেন কার্লোস ব্রাফেট
এক্স

আরও একটি ব্যাপার মনে করিয়ে দেওয়া যায়। বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়াদের বাইরে যে কেউ মাতাতে পারেননি, সেটাও ভাবলে ভুল হবে। ২০০৭ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথাই ধরুন, সেরা খেলোয়াড় হলেন আফ্রিদি। কিন্তু বেশির ভাগ লোক মনে রেখেছে যুবরাজ সিংকে। তা স্টুয়ার্ট ব্রডের এক ওভারে ছয় ছক্কায়! কিংবা ২০১৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্মরণ করুন। সেরা খেলোয়াড় হলেন কোহলি। তাঁকে যে লোকে মনে রাখেনি তা নয়, তবে ফাইনালে শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাফেটের টানা চার ছক্কাই সবার আগে মনে হয়। বিশ্বকাপ মাতাতে তাই একাধিক ম্যাচও লাগে না। প্রয়োজন শুধু দলের দরকারের সময় জ্বলে ওঠা!

আরও পড়ুন

সেটি করতে শুধু অভিজ্ঞ ও বড় তারকারা নন, সম্ভাবনাময়, প্রতিশ্রুতিশীল এমনকি কয়েক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাটিয়ে দেওয়া ভালো খেলোয়াড়েরাও হিসাবে থাকবেন। ফর্মে না থাকা কেউ–ও হুট করে জ্বলে উঠতে পারেন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। তাই আগেভাগেই কিছু নাম বলে দেওয়াটা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও। ঠিক যেভাবে লোকে পারবে না জেনেও টিয়া পাখির কাছে নিজের ভাগ্য জানতে যায়।

কিন্তু লাভ কি কিছু হয়?