উদযাপনের অন্য নাম মিরাজ

আটে নেমে সেঞ্চুরি করেছেন মিরাজছবি: শামসুল হক

‘অবিশ্বাস্য’, ‘বিস্ময়কর’—এসব তো আগের ম্যাচেই লেখা হয়ে গেছে। আজ কি লেখা যায়? বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে আরেকটি রোমাঞ্চকর কীর্তির মহিমা প্রকাশে কোন বিশেষণের অলংকার পরানো যায় তাঁকে? মেহেদী হাসান মিরাজের কোন কীর্তিটা আসলে বড়?

মধুর এক সমস্যাই বটে। প্রতিদিন ভালো খেলবেন, ম্যাচ জেতাবেন, আর প্রতিদিনই মিরাজকে বিশেষণের অলংকারে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু বিশেষণেরও তো একটা ‘স্টক’ আছে। মিরাজ যে সে ‘স্টক’ ফুরিয়ে দিচ্ছেন!

জানি এই লাইনটা পড়ার পর কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে উঠবেন এই বলে যে, অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে ভেঙে যাবে। দুইটা ম্যাচ ভালো খেলেছে বলেই কাউকে এমন আকাশে তুলে দেওয়া কেন ভাই! এরপর যখন আবার খারাপ খেলতে শুরু করবেন, তখন কী করবেন?

তখন সমালোচনা হবে। লেখা হবে মিরাজ এই ভুলটা করেছেন, ওই ভুলটা তাঁর করা ঠিক হয়নি।

কিন্তু যখন তিনি সাফল্যের পঙ্খীরাজে চড়ে ব্যাটটাকে অগ্নীশিখা, বলটাকে ঘূর্ণি গোলক বানিয়ে প্রতিপক্ষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাংলাদেশের জয়ের পতাকা ওড়াচ্ছেন, তখন তো বিশেষণের মালাই তাঁর প্রাপ্য। সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ‘খারাপ সময়ে’র কথা ভেবে আজই কেন তাঁর সাফল্যের গল্পে হাতকড়া পরানো! সেদিনের মতো আজও বরং উদ্‌যাপনের আরেক নাম হোক ‘মিরাজ’।

ক্রিকেটে একটা কথা চির সত্যি। আজ যার ব্যাটে রান নেই, আজ যার হাতে উইকেট নেই; কাল তিনিই এমন কিছু করে দিতে পারেন, যেটাতে তাঁর ব্যর্থতার কথা সবাই ভুলে যাবে। সমালোচকেরা লজ্জাবনত হবেন। আবার উল্টোটাও হয়। দুই ম্যাচের ব্যর্থতাই সাফল্যকে ঢেকে দিয়ে নেতিবাচক আলোচনায় ‘খলনায়ক’ বানিয়ে দিতে পারে যে কাউকে।

ক্রিকেটাররা এটা জেনেই ক্রিকেট খেলেন। যাঁরা সেই বিরুদ্ধ স্রোত পার হয়ে সাফল্যের তিরে পৌঁছাতে পারেন, তারাই সত্যিকারের বীর, বড় ক্রিকেটার।

চোখে লেগে থাকার মতো সেঞ্চুরিতে মিরাজ যাঁকে আজ ভারতের বিপক্ষে জয়ের পার্শ্বনায়ক বানিয়ে দিলেন, সেই মাহমুদউল্লাহর কথাই ধরুন। টি-টোয়েন্টির ব্যর্থতা তাঁকে সম্প্রতি এতটাই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিল যে অনেকে ভুলেই গিয়েছিলেন তাঁর ওয়ানডের ফর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ভুলে গিয়েছিলেন এই মাহমুদউল্লাহই এক সিরিজ আগে ওয়ানডেতে ৮৪ বলে অপরাজিত ৮০ রানের ইনিংস খেলেছেন।

এসব মাহমুদউল্লাহর ওপর একটা চাপ তৈরি করেছিল নিশ্চিত। পরিসংখ্যান দেখে আপনি না হয় ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণের পারফরম্যান্সকে আলাদা করতে পারেন। কিন্তু সমালোচনাজনিত যে চাপ সেটাকে একজন ক্রিকেটার আলাদা করবেন কীভাবে?

মাহমুদউল্লাহর দুর্ভাগ্য, ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৩৫ বলে ১৪ রান করে আউট হয়ে গেছেন। দল যখন তাঁর ব্যাটে নির্ভরতা খুঁজছিল, তিনি পারেননি আস্থার প্রতিদান দিতে। পরিণতি অনুমিতই ছিল। টি-টোয়েন্টির ব্যর্থতার সমালোচনার ধাক্কা লাগল ওয়ানডের মাহমুদউল্লাহর গায়েও। ভাগ্য ভালো মিরাজ-মোস্তাফিজ মিলে সে ম্যাচে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছেন। নইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র সেদিন মিরাজ-বন্দনার চেয়ে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে নিন্দার ঝড়ই হয়তো বেশি উঠত।

৯৬ বলে ৭৭ রানের ইনিংস খেলেন মাহমুদউল্লাহ
ছবি: শামসুল হক

সেই মাহমুদউল্লাহ আজ কি করেছেন দেখুন। মিরাজ তো পরে এলেন, তার আগে প্রথম ধাক্কাটা তিনিই সামলেছেন। দলের ৬৬ রানে চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব আল হাসান ফিরে যাওয়ার পর উইকেটে এসে প্রথমে মুশফিক ও পরে আফিফকে ফিরে যেতে দেখেছেন। এরপর মিরাজের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহর ১৪৮ রানের জুটি, যেটি শুধু বাংলাদেশকে এক ম্যাচ বাকি থাকতে সিরিজই জিতিয়ে দেয়নি, ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সপ্তম উইকেট জুটিতে এটিই এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি।

ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিতে ইনিংসের শেষ ওভারে ১৫ রান করতে হতো মিরাজকে। শার্দুল ঠাকুরের বলে ফাইন লেগ আর ডিপ মিড উইকেট দিয়ে দুই ছক্কার পর শেষ দুই বলে ২ আর ১ রান নিয়ে মিরাজ ভেসেছেন সেই উদ্‌যাপনে। শূন্যে ঘুষি ছুড়েছেন, হেলমেট আর ব্যাট তুলে তাকালেন ড্রেসিংরুমে থাকা সতীর্থদের দিকে।

উমরান মালিকের বলে উইকেটকিপার লোকেশ রাহুল শূন্যে ভেসে দুর্দান্ত ক্যাচটা না নিলে একই রকম উদ্‌যাপন করতে পারতেন মাহমুদউল্লাহও। টালমাটাল অবস্থায় উইকেটে এসে যেভাবে ধীরে ধীরে ইনিংসের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছেন, ‘অবিশ্বাস্য’ বিশেষণটা আজ তাঁর ইনিংসেরও প্রাপ্য। মাহমুদউল্লাহর ৯৬ বলে ৭৭ রানের ইনিংসটি মনে করিয়ে দিচ্ছিল ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর সেই দুই সেঞ্চুরির কথাও।

তবে আজ তিনি তিন অঙ্কে পৌঁছাননি, জয়ের নায়কও বলা হবে না মাহমুদউল্লাহকে। কিন্তু মিরাজ যে পরপর দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাট হাতে জয়ের কাব্য লিখলেন সেটিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকবে মাহমুদউল্লাহর কৃতিত্বও। কোচ রাসেল ডমিঙ্গো গতকালই বলেছিলেন, দলের ক্রান্তিলগ্নে যে মাহমুদউল্লাহ এখনো ভরসা হতে পারেন, সেই বিশ্বাস তাঁর আছে। মাহমুদউল্লাহ ঠিক তার পরদিনই জানিয়ে দিলেন, ডমিঙ্গো ভুল কিছু বলেননি।

এত কিছু বলা হয়ে গেল, তবু মধুর সে সমস্যার সমাধান তো হলো না! ‘অবিশ্বাস্য’ তো এখন পুরোনো শব্দ। বিস্ময়বালক মিরাজের জন্য ক্লিশে। তাঁকে তাহলে আজ কী বিশেষণে ভূষিত করা যায়? তাঁর কোন কীর্তিটি আসলে বড়? মোস্তাফিজুরকে নিয়ে শেষ উইকেটে ৫১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে ম্যাচ জেতানো, নাকি ৬৯ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর শতরানের ইনিংসে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশকে ২৭১ রানে নিয়ে যাওয়া? পরে বল হাতেও তো নিয়েছেন ২ উইকেট!

বিরাট কোহলিকে বোল্ডের পর ইবাদত হোসেনের উদযাপন
ছবি: শামসুল হক

কোনোটাকেই কোনোটা থেকে পিছিয়ে রাখার উপায় নেই। এর চেয়ে বরং এটা বলে দেওয়াই নিরাপদ যে, মিরাজের তুলনা শুধু মিরাজই। ভারতের বিপক্ষে পর পর দুই ম্যাচে অপরাজিত। একটাতে ফিরেছেন বাংলাদেশকে জিতিয়ে, আরেক ম্যাচে জয়ের ভীত গড়ে দিয়ে। যে ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে, শেষ ওভারের রোমাঞ্চ মাড়িয়ে দ্বিতীয় ওয়ানডেটাও বাংলাদেশ জিতে নিল ৫ রানে। শ্রেয়াস আইয়ার, অক্ষর প্যাটেল, রোহিত শর্মারা জ্বলে উঠেও পারেননি বিজয়ের মশাল জ্বালাতে।

শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি আগের ম্যাচের চেয়েও বেশি উত্তাল ছিল আজ। কানায় কানায় ভরে উঠেছিল গ্যালারি। বাংলাদেশ ইনিংসের বেশির ভাগ সময় তাদের কণ্ঠে স্লোগান—‘মিরাজ... মিরাজ...মিরাজ।’ ম্যাচ শেষে যখন এই প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে, স্টেডিয়ামের বাইরে হাজার হাজার কণ্ঠের উল্লাস ধ্বনি, বিজয়ের আনন্দে ভাসছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের আশপাশ।

৬ উইকেটে ৬৯ রান পড়ে যাওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ, এমন আশা করাটা কঠিনই ছিল তখন। এমনকি আগের ম্যাচে নাটকীয় জয়ের তাজা স্মৃতিও সেই বিশ্বাস আনছিল না মনে। ভারতের মতো দলের বিপক্ষে প্রতিদিনই তো আর বিস্ময়কর কিছু ঘটবে না। কিন্তু বিশ্বাস থেকে যে বিস্ময়বালকের জন্ম, সেই মিরাজ হয়তো আজও একটু অন্যভাবেই ভেবেছেন।

যা আর কেউ করতে চাইবে না, যা আর কেউ করতে পারবে না, মিরাজ সেটাই করে দেখাবেন । যা আর কেউ ভাবতে পারবে না, সেটাই ভাববেন মিরাজ। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে মিরপুরের গ্যালারি হয়ে টেলিভিশনের সামনে বসা দর্শকদের মধ্যেও বোধ হয় এখন তাতে দ্বিমত প্রকাশের লোক নেই।

থাকলে সেটাই হবে অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য কিছু করে দেখানোটা অন্তত মিরাজের জন্য এখন আর অবিশ্বাস্য নয়। সেই পথ পাড়ি দিয়ে এসে মিরাজ এখন আসলেই উদ্‌যাপনের অন্য নাম।