যেদিন হারানো মুকুট ফিরে পেয়েছিলেন ব্রায়ান লারা

আবারও চূড়ায় ব্রায়ান লারা। ২০০৪ সালে অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডেএএফপি
২০ বছর আগে এই দিনে ব্রায়ান লারার অপরাজিত ৪০০ রানের সেই ইনিংস। ছয় মাস আগে হারিয়ে ফেলা টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরের রেকর্ডটি আবার নিজের করে নেওয়া। রেকর্ড ভাঙা সেই ইনিংস নিয়ে পরদিনের প্রথম আলোতে উৎপল শুভ্রর লেখাটা আবার পড়তে পারেন।

মাত্র ছয় মাস! ছয় মাসের মধ্যেই হারানো মুকুটটি আবারও ব্রায়ান লারার মাথায়। ৩৬ বছর টিকে থাকা স্যার গ্যারি সোবার্সের রেকর্ডটি ভেঙেছিলেন যে মাঠে, ১০ বছর পর সেন্ট জনসের সেই অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডেই টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরের রেকর্ডটি আবার নতুন করে লিখলেন ব্রায়ান চার্লস লারা। সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই।

তিনবার মুষ্টিযুদ্ধের বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা হারিয়ে তিনবার তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। ব্রায়ান লারার বিশ্ব রেকর্ড পুনরুদ্ধার করাটা ছাড়িয়ে গেল সেই বিস্ময়কেও। হারানো রেকর্ডটা আবার নিজের করে নিয়েই থেমে যাননি। টেস্ট ক্রিকেটের নতুন এক দিগন্তও উন্মোচিত হয়েছে তাঁর ব্যাটে। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন ৪০০ রান। তারপরও ইংল্যান্ডের কোনো বোলার থামাতে পারেননি তাঁকে। লাঞ্চের আধঘণ্টা পর নিজেই থামার সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রায়ান লারা। ৫ উইকেটে ৭৫১ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করলেন অধিনায়ক। অপরাজিত ৪০০ রান, ৭৭৬ মিনিট, ৫৮২ বল, ৪৩টি চার, ৪টি ছয়—টেস্ট ইতিহাসের নতুন এক দ্বার খুলে দিল এই পরিসংখ্যান।

১০ বছর অনেক সময়। এই ১০ বছরে দেখেছেন অনেক উত্থান-পতন, সেদিনের সেই তরুণ ব্রায়ান লারার চেহারাতেও ছাপ ফেলেছে তা। সেই লারা আর এই লারায় পার্থক্য তো আছেই। কিন্তু ব্যাট আর হেলমেট পাশে রেখে উবু হয়ে যখন চুমু খেলেন উইকেটে, লাঞ্চের সময় দুই সারিতে দাঁড়ানো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়রা ব্যাট দিয়ে তোরণ বানিয়ে যখন ‘গার্ড অব অনার’ দিলেন ৩৯০ রানে অপরাজিত ব্রায়ান লারাকে, মনে হলো পুনঃভিনীত হচ্ছে ১০ বছর আগের দৃশ্যই। পার্থক্য একটাই, সেবার রেকর্ড ভাঙার পরপরই স্যার গ্যারি সোবার্স তাঁর উত্তরসূরিকে অভিনন্দন জানাতে ঢুকে গিয়েছিলেন মাঠে, কাল ম্যাথু হেইডেন ঢুকলেন না। ঢুকবেন কীভাবে, তিনি তো তখন অস্ট্রেলিয়ায়।

ম্যাথু হেইডেনের কাছ থেকে রেকর্ডটা আবার নিজের করে নেওয়ার পর
এএফপি

টেলিভিশনের পর্দায় নিশ্চয়ই তাঁর ছয় মাসের সাম্রাজ্যের হাতবদল হতে দেখেছেন ম্যাথু হেইডেন। গত অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পার্থে ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ডটি ভেঙে যখন ৩৮০ করলেন, হেইডেনের কল্পনাতেও ছিল না—যাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিলেন, মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই মুকুটটা ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁকেই। হেইডেনের কী দোষ! লাঞ্চের সময় যখন মাঠ থেকে বেরোচ্ছেন, ডেভিড গাওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লারা নিজেই তো স্বীকার করলেন, রেকর্ডটি হারানোর ছয়-সাত মাসের মধ্যেই আবার তা ফিরে পাবেন, এটি তিনি একদমই ভাবেননি। কোনো দিনই আর ফিরে পাবেন না, এটি ভাবাই তো স্বাভাবিক। এর আগে কেউই তো কোনো দিন পাননি।

এক টুকরো ইতিহাস গড়ে ফেলেছিলেন আগের দিনই। ক্রিকেট-অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেলেছেন অনেক আগেই, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হলো আরেকটি ট্রিপল সেঞ্চুরিতে। এত দিন টেস্ট ক্রিকেটে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি ছিল শুধু একজনেরই। এক এবং অদ্বিতীয় স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সেই কীর্তির পাশে বসেও তৃপ্ত হননি লারা। গত পরশু দিনশেষে ৩১৩ রানে অপরাজিত, হেইডেনের রেকর্ড ভাঙতে তখনো প্রয়োজন ৬৮ রান। তখনই বলে দিয়েছিলেন, বিশ্ব রেকর্ডটাকে একদমই দূরের বলে মনে হচ্ছে না, সেটি তাঁর হাতে ওঠারই অপেক্ষায়। রাতে ভালো একটা ঘুম দেবেন, সকালে উঠে ভাববেন ১০ বছর আগের সেই ইনিংসের কথা।

লারা ৪০০ নট আউট। অ্যান্টিগা টেস্টের স্কোরকার্ডে মূর্ত অমর এক কাহিনি
এএফপি

সিরিজের শুরুতেই কথায় কথায় বলেছিলেন, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যেমন প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০০ করেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ৪০০ করাটাও তাঁর লক্ষ্যের তালিকায় আছে।

কাল লাঞ্চের আগেই ফিরে পেলেন হারানো সাম্রাজ্য। ব্রায়ান লারার ব্যাটিংয়ে সব সময়ই দৃশ্যমান অসম্ভবকে সম্ভব করার একটা প্রতিজ্ঞা, তাঁর মতো করে সবকিছু করার দুরন্ত এক দুঃসাহস। এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? বিশ্ব রেকর্ডটা তো যেন-তেনভাবে ভাঙতে পারেন না! হেইডেনকে ছুঁলেন তাই অফ স্পিনার গ্যারেথ ব্যাটির বলে বিশাল এক ছক্কা মেরে। ৩৭৪ থেকে ৩৮০। পরের বলে সুইপ করে চার। ‘কিং অব অল রেকর্ডস’ আবারও এসে লুটিয়ে পড়ল ব্রায়ান লারার পায়ে। অদ্ভুত এক আঁধারের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হেসে উঠল একসঙ্গে। অ্যান্টিগার প্রধানমন্ত্রী মাঠে ঢুকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন লারাকে। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা এমনভাবে ঘিরে দাঁড়ালেন, যেন ব্রায়ান লারা তাঁদেরই একজন। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার গৌরবটাও তো কম নয়!

প্রণমি তোমায়—ম্যাথু হেইডেনের রেকর্ড ভাঙার পর উইকেটে ব্রায়ান লারার চুমু
এএফপি

এই সিরিজের শুরুতেই কথায় কথায় বলেছিলেন, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যেমন প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০০ করেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ৪০০ করাটাও তাঁর লক্ষ্যের তালিকায় আছে। অথচ সিরিজের প্রথম ৬ ইনিংস মিলিয়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে মাত্র ১০০ রান। ডুবতে হয়েছে টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পরপর দুই ইনিংসে শূন্য রানে আউট হওয়ার লজ্জাতেও। এই সিরিজেই ৪৭ রানে অলআউট হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আগের টেস্টেই একটি ইনিংস শেষ হয়েছে ৯৪ রানে। ৩৬ বছর পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অধিনায়ক ব্রায়ান লারাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে সমালোচকদের ধারালো ছুরি। দল হারছে, নিজের ব্যাটেও রান নেই—অতীতে আরও অনেকবারের মতো ‘ব্রায়ান লারা শেষ’ এমন একটা রবও জোরালো হচ্ছিল ক্রমশই।

দশ বছর আগের দৃশ্যের পুনরাভিনয়। ৩৭৫ করার পর সতীর্থরা যেমন লারাকে গার্ড অব অনার দিয়েছিল, তেমনি অপরাজিত ৪০০ করার পরও
এএফপি

৬ ইনিংসে ১০০ রানের পর এক ইনিংসেই অপরাজিত ৪০০—জিনিয়াসদের নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার বিপদটাও কি সবাইকে আবার মনে করিয়ে দিলেন না লারা?