সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ফিরে এসেছিল বলেই আনন্দটা আরও বেশি

স্বল্প পুঁজি নিয়েও বাংলাদেশকে জিতিয়ে সমর্থকদের আনন্দে ভাসিয়েছেন বোলাররাবিসিবি

কী ভয়টাই না পেয়েছিলেন, তাই না? ঈদের একটা দিন। আর সেই দিনে এসব কী হচ্ছে! ঈদ অর্থ আনন্দ—কথার অর্থটাই না বদলে যায়!

ভয় পেয়েছিলেন বলেই আনন্দটা এখন দ্বিগুণ বলে অনুমান করি। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটে উঠে গেছে। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টির প্রথম আসরের পর দ্বিতীয় রাউন্ডে এই প্রথম। সেখানে কী হবে না হবে—এখনই তা ভাবার কী দরকার! আনন্দ করুন, উদ্‌যাপন করুন, ইচ্ছা হলে গলা ছেড়ে গান গান।

আরও পড়ুন

তা না হয় গাইলেন। কিন্তু ওই ভয়ের সময়টা? মনে আছে তো, ম্যাচের শুরুটা কেমন ফিরিয়ে আনছিল ২১ বছর আগের স্মৃতি। আপনার বয়সই যদি এর আশপাশে হয়, তাহলে তো আর মনে সেই স্মৃতি থাকার কথা নয়। তবে শুনেছেন নিশ্চয়ই। আগে শুনে না থাকলেও এই ম্যাচ চলার সময় কেউ না কেউ মনে করিয়ে দিয়ে থাকবে ২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডার বিপক্ষে সেই ম্যাচ।

সহযোগী সদস্যদেশের বিপক্ষে বাংলাদেশ আরও অনেকবারই হেরেছে। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তো দেশের মাটিতে হংকংয়ের বিপক্ষেও। তারপরও সহযোগী সদস্যদেশের বিপক্ষে সম্ভাব্য আরেকটি পরাজয় ২১ বছর পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণ তা ঈদের সঙ্গে মিলে যাওয়া।

২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডার কাছে অবিশ্বাস্যভাবে হেরেছিল বাংলাদেশ
আইসিসি ফেসবুক পেজ

কানাডার কাছে সেই পরাজয় মাটি করে দিয়েছিল বাংলাদেশের ঈদের আনন্দ। সেই ম্যাচ তো তা-ও ছিল ঈদের আগের দিন। আর এবারেরটা তো ঈদের দিনই। ঈদের ভোরে টেলিভিশন ছেড়েই আপনি চোখে অবিশ্বাস নিয়ে হয়তো দেখেছেন, কেমন ধ্বংসস্তূপে রূপ নিচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাটিং। প্রথম বলেই বেরিয়ে মারতে গিয়ে তানজিদের আউট, ভুল লাইনে খেলতে গিয়ে নাজমুলের বোল্ড হওয়া, সাকিবের ভুলে মাহমুদউল্লাহর রানআউট, তা পুষিয়ে দিতে ব্যর্থ সাকিবও ফিরে যাওয়ায় বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ৬১!

আরও পড়ুন

তখন তো আর আপনি জানেন না, এক ঘণ্টা পর শুরু ম্যাচে শ্রীলঙ্কা নেদারল্যান্ডসকে উড়িয়ে দেবে। বরং সুপার এইটে ওঠার উদ্‌যাপনটা একটু আগেই করা হয়ে গেছে ভেবে হয়তো একটু লজ্জাই পাচ্ছেন। একটু রাগও হচ্ছে। কাদের ওপর, তা বলার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। রাগ-ক্ষোভ-হতাশা—সবকিছুর লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তো ঠিক করাই আছে।

আপনার মনে তখন গভীর দুশ্চিন্তা, বাংলাদেশ যদি হেরে যায়, আর নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে বসে শ্রীলঙ্কা, তাহলে তো নেট রান রেটের হিসাব আসবে। সেটি কী হবে, কে জানে! সুপার এইট না মরীচিকার মতো মিলিয়ে যায়! পরপর দুই বলে ভুরতেলকে রিশাদের ছয়-চার আর এই দিনে মহামূল্য তাসকিনের অপরাজিত ১২ রানে বাংলাদেশ যখন ১০৬ রানে শেষ করল, ভয়টা তখনো হয়তো মনে জেঁকে বসে আছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসে এর আগে কোনো দল এত রানের পুঁজি নিয়ে জিততে পারেনি। যা কখনো হয়নি, তা কি হবে!

বাংলাদেশের সুপার এইটে ওঠা ঈদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে
বিসিবি

নাজমুল হোসেন দাবি করছেন, ১০৬ রান করার পরও বাংলাদেশ দলের প্রতিটি ক্রিকেটার বিশ্বাস করেছেন, এই ম্যাচ জেতা সম্ভব। তা জেতার পর তো এমন কথা বলবেনই অধিনায়ক। এমন ভাবাটা স্বাভাবিক জেনেই নাজমুল বলে নিলেন, ‘জিতেছি বলে কিন্তু এ কথা বলছি না। আসলেই আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমরা জিতব।’

আরও পড়ুন

ব্যাটে রান নেই। চার ম্যাচে করেছেন মোটে ২৬। তবে নাজমুলের অধিনায়কত্বের বড় ভূমিকা এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায়। তা শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও। ইতিবাচকতার একটা বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ড্রেসিংরুমে। সব খেলোয়াড়ের মনেও। ম্যাচসেরা তানজিম হাসান এ ম্যাচের আগে অধিনায়কের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। ম্যাচ শেষেও। ওই বিশ্বাস থাকার কথাটার পুনরাবৃত্তি তাঁর মুখেও।

বড় কারণ অবশ্যই সেন্ট ভিনসেন্টের উইকেট, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই বিশ্বকাপের নিউইয়র্ককে। ব্যাটিংকে পৃথিবীর কঠিনতম কাজ বানিয়ে দেওয়া নিউইয়র্কের উইকেটের অমন আচরণের তা-ও একটা ব্যাখ্যা ছিল। ড্রপ-ইন উইকেট নাসাউয়ের মাটিতে ঠিকমতো বসার সময় পায়নি। কিন্তু সেন্ট ভিনসেন্টের কী ব্যাখ্যা? যেখানে পরপর দুই ম্যাচে রান করতে ব্যাটসম্যানদের প্রাণান্তকর দশা।

তানজিম হাসানের উদ্‌যাপন। বোলিংয়ে বাংলাদেশের দারুণ শুরু এনে দেওয়ার নায়ক
আইসিসি

নিউইয়র্কের সব ম্যাচের প্রায় একই চেহারা। সেন্ট ভিনসেন্টে আবার তিন ম্যাচে দুই রকম উইকেট। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস প্রথম ম্যাচ বোলারদের জন্য এমন মৃগয়াভূমি হয়ে ওঠেনি। দক্ষিণ আফ্রিকা-নেপাল ম্যাচে ছিল স্পিনরাজ। এদিন আবার দুই ইনিংসে দুই রকম। বাংলাদেশের ইনিংসে রাজত্ব করেছে স্পিন, নেপালের ইনিংসে আবার পেসারদের জয়গাথা। পরপর দুই বলে উইকেট নিয়ে ম্যাচটা শেষ করেছেন সাকিব, নেপালের বাকি ৮টি উইকেটই পেসারদের। এর মধ্যে তানজিম আর মোস্তাফিজকে আলাদা করে নেওয়া উচিত। এই দুজনের ৮ ওভারে মাত্র ১৪ রানে ৭ উইকেট।

১০৬ রান নিয়ে অস্বস্তিটা তানজিমের প্রথম স্পেলেই অনেকটা শেষ। প্রথম বলটিতে চার খেয়েছেন, তৃতীয় বলটি ওয়াইড। এর পরের ১৮টি বল ডট। দ্বিতীয় ওভারে ডাবল উইকেট মেডেন, তৃতীয় ওভারে উইকেট মেডেন, উইকেট নিয়েছেন শেষ বলেও। টানা ৪ ওভারে ৭ রান দিয়ে ৪ উইকেট। শুধু উইকেট সংখ্যা একটি কম, নইলে মোস্তাফিজের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। শেষ ২ ওভারে নেপালের যখন ২২ রান লাগে, ১৯তম ওভার করতে এসে মোস্তাফিজের উইকেট মেডেন। এই বিশ্বকাপে শেষ ৪ ওভারে ইকোনমি রেট অবিশ্বাস্য ১.৬৬!

মোস্তাফিজকে খেলতেই পারেননি নেপালের ব্যাটসম্যানরা
আইসিসি

ডট বলের হিসাবটা না দিলে এদিনের তানজিম-মোস্তাফিজকে বোঝা যাবে না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি নিষ্ফলা বল করার রেকর্ডই করে ফেলেছেন তানজিম। ওয়াইডসহ ২৫টি বল ধরলে এর ২১টিই ডট। ১৯টি ডট বল করে মোস্তাফিজ সামান্যই পিছিয়ে।

দুটি যোগ করুন। দুজনে মিলে ৪০টি ডট বল! টি-টোয়েন্টিতে ১২০ বলের ইনিংস, এক-তৃতীয়াংশকেই নিষ্ফলা বানিয়ে ফেলার এই যুগল কীর্তির আর কোনো উদাহরণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে থাকার কথা নয়। টি-টোয়েন্টিতেই কি আছে?