ফিলিস্তিনিদের জন্য খাজার লড়াই ক্রিকেটে আরও যেসব ঘটনা মনে করাচ্ছে

পার্থ টেস্টে কালো বাহুবন্ধনী পরে খেলতে নেমেছেন অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার উসমান খাজাএক্স

গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতায় প্রতিবাদমুখর বিশ্ব। খেলার জগৎও এর বাইরে নয়। অনেক খেলোয়াড়ই গাজায় নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার উসমান খাজা তাঁদেরই একজন।

পাকিস্তানের বিপক্ষে আজ সকালে শুরু হওয়া পার্থ টেস্টে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের স্লোগানসংবলিত জুতা পরে খেলার ঘোষণা দিয়েছিলেন খাজা, যাতে লেখা ‘স্বাধীনতা একটি মানবাধিকার’ এবং ‘সবার জীবনই গুরুত্বপূর্ণ’। কিন্তু আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া খেলোয়াড় ও ম্যাচ পরিচালনাকারীরা বার্তাসংবলিত কোনো পোশাক ও সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবেন না। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) খাজাকে সেই নিয়মই মনে করিয়ে দিয়ে স্লোগানসংবলিত জুতা পরতে বারণ করেছিল।

তবে খাজা ভিডিও বার্তায় আইসিসির নিয়মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দেন এবং আজ পার্থ টেস্ট শুরুর আগে গা গরমের সময় স্লোগানসংবলিত জুতা পরে মাঠে নামেন। তবে জুতার ওপর লেখা বার্তাটা টেপ দিয়ে ঢেকে রাখেন।

ম্যাচ শুরুর আগে জুতায় লেখা বার্তা টেপ দিয়ে ঢেকে ফেলেন খাজা
এএফপি

ক্রিকেটে এ ধরনের ঘটনা নতুন না হলেও খেলার মাঠে এমন মানবিক বার্তাকে অনেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মনে করেন। অতীতে বহুবার এমনটা দেখা গেছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি খাজার এই অকুণ্ঠ সমর্থন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে শুরু করে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে হাঁটু গেড়ে বসাসহ অনেক ঘটনার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

১৯৭১ সালে কেপটাউনে একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে মাত্র এক বল হওয়ার পরই মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়েরা। এর মাধ্যমে তাঁরা বর্ণবৈষম্যমূলক শাসনের প্রতিবাদ করেন।

২০০৩ বিশ্বকাপে নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে রবার্ট মুগাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ কালো বাহুবন্ধনী পরে মাঠে নামেন জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা। পরে তাঁরা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের প্রিয় জিম্বাবুয়ের গণতন্ত্রের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে কালো বাহুবন্ধনী পরে খেলেছি।’ ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গার এই কর্মকাণ্ডে জিম্বাবুয়ের রাজনীতিবিদেরা নিন্দা জানালেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

আইসিসি জানায়, ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গা একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনেনি। মুগাবে সরকারের বিরোধিতা করায় ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিশ্বকাপ শেষেই তাঁরা জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের পতনের শুরু সেখান থেকেই।

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার (বাঁয়ে) ও হেনরি ওলোঙ্গা রবার্ট মুগাবে সরকারের বিরোধিতা করে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন
এএফপি

২০১৪ সালে ইংলিশ অলরাউন্ডার মঈন আলীও অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার খাজার মতো ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন। ইংল্যান্ডের একটি ম্যাচে ‘গাজাকে রক্ষা করো’ ও ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’ লেখা রিস্টব্যান্ড পরে খেলতে চেয়েছিলেন মঈন। কিন্তু তাঁকে খাজার মতো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়। ম্যাচ রেফারি ডেভিড বুন বাধা দিলে শেষ পর্যন্ত স্লোগানসংবলিত রিস্টব্যান্ড খুলে রেখেই খেলতে হয়। পরে আইসিসি মঈনের উদ্দেশে বিবৃতিও দেয়, ‘ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম ও পোশাক পরিধানের নিয়ম অনুযায়ী, আইসিসি আন্তর্জাতিক ম্যাচ চলাকালে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত কার্যকলাপ বা কারণগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত বার্তা প্রদর্শনের অনুমতি দিতে পারে না।’

আরও পড়ুন

ভারতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বিশ্বকাপের সময় পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরাও ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ান। বিশ্বকাপ দলে থাকা কয়েকজন খেলোয়াড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনের পতাকা পোস্ট করে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানান। উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ রিজওয়ান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর ম্যাচ জেতানো শতক ‘গাজার ভাইবোনদের’ উৎসর্গ করেন। এ ঘটনায় পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে দখলদার ইসরায়েলের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের মানুষেরা।

দেশপ্রেমের নিদর্শনস্বরূপ সেনাবাহিনীর ক্যাপ পরে খেলতে নেমেছিল ভারতীয় দল
বিসিসিআই

২০১৯ সালের মার্চে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ পরে খেলেতে নেমেছিলেন বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মারা। সে বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতের নিরাপত্তাকর্মীদের বহনকারী গাড়িবহরে হামলা চালায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ। এ ঘটনায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হন। দেশপ্রেমের নিদর্শনস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাই সেনাবাহিনীর ক্যাপ পরে খেলেন কোহলিরা। সশস্ত্র বাহিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে ম্যাচ ফির পুরোটা দানও করে দেন।

সেনাবাহিনীর ক্যাপ পরে খেলার ভাবনা সর্বপ্রথম মহেন্দ্র সিং ধোনির মাথায় এসেছিল। ভারতের সাবেক অধিনায়ক দেশটির সেনাবাহিনীর অবৈতনিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল। উইকেটকিপিংয়ের সময়ও ধোনি সেনাবাহিনীর নকশাকৃত গ্লাভস পরতেন। আর ওই দিন ম্যাচটাও হয়েছিল তাঁর জন্মশহর রাঁচিতে। তবে ম্যাচের পরদিনই পাকিস্তান সরকার খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর অভিযোগ এনে ধোনিদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে এবং আইসিসিকে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। আইসিসি তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ না নিলেও ওই বছরেই ধোনিকে সেনাচিহ্নিত গ্লাভস খুলে অন্য গ্লাভস পরে খেলতে বলেছিল।

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ক্রিকেটাররা এভাবেই হাঁটু গেড়ে বসতেন বসতেন
এএফপি

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরের পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড মারা গেলে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বা ‘কৃষ্ণাঙ্গরাও মানুষ’ আন্দোলন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিন প্রকাশ্যে রাজপথে গলায় হাঁটু চেপে ধরে ফ্লয়েডকে হত্যা করায় খেলার মাঠেও হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানো শুরু হয়। সে বছরের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফর দিয়ে মহামারি করোনার ধাক্কা সামলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে ফেরে। ক্রিকেটে হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ ওই সিরিজ দিয়েই শুরু হয়।

আরও পড়ুন

গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অস্ট্রেলিয়া সফরেও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে পার্থ টেস্ট শুরুর আগে হাঁটু গেড়ে বসেন ডেভিড ওয়ার্নার-স্টিভেন স্মিথরা। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার অনেক সমর্থক ওয়ার্নার-স্মিথদের এ কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁরা ক্রিকেটারদের রাজনীতি ছেড়ে খেলায় মনোযোগী হতে বলেন। পরে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যান্ট কামিন্স জানান, সম–অধিকারের সমর্থনে তাঁর দল হাঁটু গেড়ে বসেছে।

আফগানিস্তানে নারীদের ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেছে তালেবান সরকার
রয়টার্স

এ বছরের জানুয়ারিতে তালেবান–শাসিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে নারীদের অধিকার হরণের অভিযোগ তুলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া। নারীদের প্রতি ‘অগ্রহণযোগ্য’ আচরণের প্রতিবাদ হিসেবে সিরিজ বর্জন করায় কামিন্সের দলের প্রশংসা করেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রীড়ামন্ত্রী আনিকা ওয়েলস।