আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায়
কেন তামিমের এমন অবসর
পারফরম্যান্স নিয়ে বিতর্ক, বোর্ডের চাপ, চোট নিয়ে সন্দেহ, অধিনায়কত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়েই এমন সিদ্ধান্ত।
তামিম ইকবাল তাঁর বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে একটা অনুরোধ করেছেন। তাঁর অবসরের আলোচনা যেন ওখানেই শেষ করে দেওয়া হয়। এটা নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করার দরকার নেই। কেন, কী, আরও কী হতে পারত, কেন হতে পারত—এসব যেন কেউ জানতে না চান।
গতকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অকস্মাৎ বিদায় বলার দিনে করা তাঁর এই অনুরোধ রাখতে পারলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু তিনি তামিম ইকবাল বলেই সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সবাইকে বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে একজন মহাতারকার বিদায় ময়নাতদন্তহীন কী করে থাকে!
আসন্ন এশিয়া কাপ আর বিশ্বকাপে অধিনায়ক তামিমের ওড়ানো ঝান্ডার তলে বাংলাদেশ খেলবে, এটাই ঠিক করা ছিল। অথচ ব্যাট হাতে দেশকে আরও কিছু দেওয়ার ক্ষুধা নিয়েও ৩৪ বছর বয়সেই কিনা তিনি বলে দিলেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে গতকালের (পরশু) ম্যাচটিই আমার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এই মুহূর্ত থেকে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছি...।’
কিন্তু কেন? কী এমন হলো যে একটা সিরিজের মাঝপথে সাংবাদিকদের ডেকে তামিমকে নিজ শহর চট্টগ্রামেই বলে দিতে হলো, ওই মুহূর্ত থেকে তিনি আর নেই! তামিমের এই সিদ্ধান্ত দলের মধ্যেও বিস্ময় ছড়িয়ে দিয়েছে। সতীর্থ ক্রিকেটাররা ভেবেছিলেন, বড়জোর ওয়ানডের অধিনায়কত্বই ছাড়বেন তামিম। তিনি যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে যাচ্ছেন, সেটা কারও কল্পনায়ও ছিল না।
কাল দুপুরে আবেগঘন সংবাদ সম্মেলনে তামিম তাঁর অবসরের কারণ ব্যাখ্যা করেননি। অশ্রুভেজা নয়নে, কান্নার দমকে বারবার থেমে একটা সময়ে নিজের কথা শেষ করেন। এরপর কাউকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই উঠে চলে যান টাওয়ার ইন হোটেলের কৃষ্ণচূড়া হল থেকে। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে রয়ে যায় কৌতূহলের বুদ্বুদ—তামিম কেন হঠাৎ খেলা ছেড়ে দিলেন!
দিলেন, কারণ তিনি স্বস্তিতে ছিলেন না। না বাংলাদেশ দলের একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে, না ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে। বিসিবির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাঝেমধ্যেই তাঁকে নিয়ে সমালোচনার বাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া, তাঁর চোট–আঘাতকে সন্দেহের চোখে দেখা, পারফরম্যান্স নিয়ে বিতর্ক, ওয়ানডে দলের অধিনায়ক হিসেবে অনিশ্চয়তার দোলাচল—সবকিছু মিলিয়েই অবসরের সিদ্ধান্ত।
কেউ কেউ এতে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পরোক্ষ ভূমিকার কথাও বলছেন। শ্রীলঙ্কান এই কোচের দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেওয়ার পেছনে বোর্ডের কাছে যাঁদের সুপারিশ ছিল, তামিম ছিলেন তাঁদের মধে৵ অন্যতম। অথচ সেই হাথুরুসিংহেও নাকি বিভিন্নভাবে তাঁকে বেশ চাপে রেখেছিলেন, যেটা মেনে নিতে পারছিলেন না তামিম। আর টেস্ট এবং টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গে একটা দূরত্ব তো ছিলই। সব মিলিয়ে দলের ভেতর ও বাইরের পরিবেশটা নিজের জন্য অবমাননাকর এবং অসম্মানজনক মনে হচ্ছিল তামিমের।
অবসরের চিন্তা অবশ্য তাঁর আরও আগে থেকেই ছিল। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি গত বছরই ছেড়েছেন, ঠিক করে রেখেছিলেন পালা করে টেস্ট আর ওয়ানডে ক্রিকেটকেও বিদায় বলবেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে চলতি সিরিজের একমাত্র টেস্টের সময়ই যেমন দু–একজন সতীর্থকে তামিম বলেছেন, টেস্ট ম্যাচ আর খেলবেন না। তবে জানা গেছে, ওয়ানডে ক্রিকেটটা অন্তত আগামী অক্টোবর–নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ভারত বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলার ইচ্ছা তাঁর ছিল।
সে কারণেই প্রশ্নটা বেশি করে উঠছে—বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আফগানিস্তান সিরিজের দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই কেন অবসর নিয়ে নিলেন তামিম? বিষয়টা তা–ও কিছুটা স্বাভাবিক লাগত যদি তিনি সিরিজ শেষ করে সিদ্ধান্ত জানাতেন। সিরিজের মাঝপথে অবসর নিয়েছেন বলেই সেটি আর স্বাভাবিক থাকছে না।
আসলে তামিমকে সর্বশেষ বারের মতো ক্ষুব্ধ করেছে ওয়ানডে সিরিজের এক দিন আগে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের করা কিছু মন্তব্য। কোমরের ব্যথার কারণে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে তামিম খেলেননি। ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বললেন, তিনি তখনো পুরোপুরি ফিট নন। প্রথম ম্যাচটা খেলেই বোঝার চেষ্টা করবেন ফিটনেসের অবস্থা।
পরে তামিমের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে একটি বাংলা দৈনিককে বিসিবি সভাপতি বলেন, ‘এটি তো আর পাড়ামহল্লার ম্যাচ নয়। আন্তর্জাতিক একটা ম্যাচ। এমন সিরিজের আগের দিন অধিনায়ক বলছে সে ফিট না। কিন্তু খেলবে, খেলে নিজের ফিটনেস বোঝার চেষ্টা করবে। এটা তো পেশাদার কোনো আচরণ হতে পারে না!’ বিসিবি সভাপতি জানিয়েছিলেন, তামিমের বক্তব্যে কোচ হাথুরুসিংহেও নাকি ক্ষুব্ধ।
বোর্ড সভাপতির এমন বক্তব্যের পর প্রথম ওয়ানডেটা খেলেই আর দেরি করলেন না তামিম। পরদিনই দিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা। তার আগে পরশু গভীর রাতে তিনি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সিরিজ কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের বার্তা পাঠান, পরদিন (গতকাল) দুপুরে সবাইকে কিছু বলতে চান। কেন সংবাদ সম্মেলন করবেন, এমন প্রশ্ন তামিম এড়িয়ে গেলেও বিভিন্ন সূত্রে সে রাতেই জানা যায় ক্যারিয়ার নিয়ে বড় কোনো সিদ্ধান্ত জানাতেই তাঁর সাংবাদিকদের ডাকা।
তামিম তাঁর এই পরিকল্পনার কথা বিসিবিকে না জানালেও তিনি যে সংবাদ সম্মেলন করতে যাচ্ছেন, সে খবর পৌঁছে যায় বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ে। শুনে রাতেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ও ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান জালাল ইউনুস তামিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তামিমকে তাঁরা ফোনে পাননি, তামিম তাদের খুদে বার্তারও জবাব দেননি।
তামিমের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিসিবির যোগাযোগ হয় কাল সকালে। বিসিবি সভাপতির ফোন পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলেও বোর্ডের অন্তত দুজন পরিচালক মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। তাঁরা তামিমকে বোঝাতে চেষ্টা করেন এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। বলেন, ভারতে অনুষ্ঠেয় এ বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত তাঁকেই ওয়ানডে দলের অধিনায়ক রাখার চিন্তা বিসিবির।
বোর্ড কর্মকর্তারা তামিমকে এ–ও প্রস্তাব দেন, প্রয়োজনে আফগানিস্তান সিরিজের বাকি দুই ম্যাচে তিনি বিশ্রাম নিতে পারেন। যে কোমরের ব্যথা আর ফিটনেস নিয়ে তাঁর সংগ্রাম, সেটি কাটিয়ে উঠতে এশিয়া কাপের আগে চিকিৎসাও করাতে পারেন, যেন এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে তিনি পুরো ফিট হয়ে খেলতে পারেন। কিন্তু তাতেও সিদ্ধান্ত পাল্টাননি তামিম।
তামিমের অবসরের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিসিবি। তবে কাল রাতেই ঢাকার একটি হোটেলে জরুরি সভায় বসার কথা বোর্ড কর্মকর্তাদের। তামিমের পরিবর্তে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাকি দুই ম্যাচের অধিনায়ক ঠিক হওয়ার কথা সেখানেই। যদিও সেটি একরকম ঠিক করাই আছে। কাগজ–কলমে না হলেও এই সিরিজে সহ–অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল টেস্টের সহ–অধিনায়ক লিটন দাসকে। সে হিসেবে পরের দুই ম্যাচে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ দলকে। আর তামিমের বিকল্প ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ডাকা হয়েছে রনি তালুকদারকে।
১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে একটার পর একটা কীর্তির পালক গেঁথে গেছেন তামিম। সেসবের বিস্তারিত বর্ণনায় না গেলেও ব্যাটসম্যান তামিমের মহিমা বুঝে নেওয়া যায় কিছু সংখ্যাতেই। দেশের হয়ে তিন সংস্করণের ক্রিকেট মিলিয়ে তাঁর ঝুলিতেই সর্বোচ্চ ১৫২০৫ রান, ওয়ানডেতে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি (৮৩১৩) রানের মালিক তিনি, টেস্টে তামিমের রানটাই এখন (৫৫৫৩) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং টি–টোয়েন্টিতে তৃতীয় (১৭০১)।
বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনতার আক্ষেপটা সে কারণেই বেশি—এখনই কেন অবসর নিতে হলো! আরও কিছুদিন কি খেলে যাওয়া যেত না তামিম?