১৮ মাসের মধ্যে জন্ম তিনটি শিশুর। বারবাডোজের এক মাইল এদিক-ওদিকে। কাকতালীয়ভাবে তিনজনেরই পারিবারিক নামের আদ্যক্ষর ‘ডব্লু’। কে জানত, এটিই তিনজনকে এমন এক সূত্রে গেঁথে ফেলবে!
একসূত্রে গেঁথেছে ক্রিকেট। এক দলে তিনজন-চারজন গ্রেট ব্যাটসম্যান তো কতই খেলেছেন। আলাদা করেই বলতে হয়েছে তাঁদের নাম। নামের আদ্যক্ষর এক হওয়ায় তাঁরা তিনজন হয়ে গেলেন অবিচ্ছেদ্য। ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভার্টন উইকস ও ক্লাইড ওয়ালকটের আলাদা পরিচয়ও থাকল, কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাস এই তিনজনকে চিনল দুটি শব্দেই—থ্রি ডব্লুস।
ওরেল, ওয়ালকট আর উইকস এখন পাশাপাশি শুয়ে। তাঁদের নামে নাম দেওয়া ক্রিকেট মাঠের পাশে। ব্রিজটাউনের উপকণ্ঠে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট মাঠটির নাম ‘থ্রি ডব্লুস ওভাল’, ওরেল সেখানে শুয়ে আছেন প্রায় ৫৮ বছর। ৩৯ বছর নিঃসঙ্গ থাকার পর পাশে পেয়েছেন ওয়ালকটকে। তিন ডব্লুর অন্যজন, এভার্টন উইকস যোগ দিয়েছেন সবার পরে। ২০২০ সালে। জীবনে তাঁরা একসূত্রে গাঁথা ছিলেন, মরণের পরও তা-ই থাকবেন বলে আগেই ঠিক হয়ে ছিল। ওরেলের শেষ শয্যার পাশে নিজেদের জন্য বরাদ্দ করা জায়গাটা প্রায়ই দেখতে যেতেন উইকস আর ওয়ালকট। লিউকেমিয়া ওরেলকে নিয়ে গেছে মাত্র ৪২ বছর বয়সে। সমাধির পাশেই ওরেলের একটি আবক্ষ মূর্তি। এক পাশে বড় বড় তিনটি স্টাম্প। ওরেলের মৃত্যুদিবসে সেখানে নিয়মিত ফুল দিয়ে আসতেন উইকস ও ওয়ালকট। শেষ দিকে অনেকগুলো বছর উইকসকে একাই যেতে হয়েছে।
ওরেলের সঙ্গে তো পরিচয় হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন আমার জন্মের বছরেই। ক্লাইড ওয়ালকটের সঙ্গেও কখনো দেখা হয়নি। এভার্টন উইকসের সঙ্গে হয়েছিল। ২০০৯ সালে একটা অনুষ্ঠানে উইকসের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই আমি রীতিমতো মুগ্ধ। হাসিখুশি, আমুদে, কথায় কথায় রসিকতা করছেন। দুই বন্ধুর স্মৃতিচারণার সময়ই শুধু একটু উদাস হয়ে গেলেন। বলছিলেন, ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠের পাশে উঁচু ওই বেদির মতো জায়গাটায় দুই বন্ধুর সমাধির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর মনে স্মৃতির ঝড় বয়ে যায়। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড সফরে নিজে ৭টি সেঞ্চুরি করেছিলেন, ওয়ালকটও তা-ই। সেটি ট্যুর ম্যাচ–ট্যাচ মিলিয়ে। ৮৯.৯৩ গড়ে ৫৩৯ রান করে টেস্ট সিরিজে ওরেল ছিলেন সবার ওপরে। ‘থ্রি ডব্লুস’ কথাটার জন্মও তখনই। শুধু নামের আদ্যক্ষরেই মিল নয়, তিনজন ছিলেন হরিহর আত্মা। বড় বড় পার্টনারশিপ তো নিয়মিতই হতো। একই টেস্টে তিনজনই সেঞ্চুরি করেছেন দুবার।
তিনজনই গ্রেট, তবে ব্যাটসম্যান হিসেবে এভার্টন উইকসকে একটু এগিয়ে রাখতে হয়। টেস্ট ক্রিকেটে টানা ৫ ইনিংসে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড আছে তাঁর, টানা ছয়টিই হয়ে যাচ্ছিল, ৯০ রানে বিতর্কিত রানআউটে যা আর হয়নি। ৪৮ টেস্টে ৫৮.৬১ গড়ে ৪৪৪৫ রান, ১৫টি সেঞ্চুরি—এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে ব্যাটসম্যান উইকসকে। ওয়ালকট ছিলেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা, প্রস্থেও খারাপ নয়। প্রচণ্ড পাওয়ার ছিল তাঁর ব্যাটিংয়ের মূল সুর। ৪৪ টেস্টে ৫৬.৬৮ গড়ে ৩৭৯৮ রান, সেঞ্চুরি তাঁরও ১৫টি। রেকর্ডের দিক থেকে তিনজনের মধ্যে ওরেলই একটু পিছিয়ে। ৫১ টেস্টে ৪৯.৪৮ গড়ে ৩৮৬০ রান। তবে একটা জায়গায় বাকি দুজনকে পেছনে ফেলে ওরেল ছিলেন অনেক এগিয়ে। তিনজনের মধ্যে তাঁর ব্যাটিংই ছিল সবচেয়ে দৃষ্টিসুখকর। নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, ওরেল জীবনে কোনো দিন দৃষ্টিকটু কোনো শট খেলেননি। ওরেলের ব্যাটিং ছিল কবিতা।
তবে ফ্রাঙ্ক ওরেলের মূল পরিচয় এটাও নয়। ব্যাটিংই তাঁর একমাত্র পরিচয় হলে কি আর বারবাডোজের টাকায় তাঁর ছবি ছাপা হয়! ওরেল স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেশগুলোকে প্রথম একসূত্রে গাঁথার জন্য। কালোরা ভালো অধিনায়ক হতে পারে না—এই মিথ ভেঙে দেওয়ার জন্য।
ইংল্যান্ডে লিগ ক্রিকেট খেলতে খেলতেই ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়েছেন। খেলা ছাড়ার পর কাজ করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্ববিদ্যালয়েও। অকালমৃত্যু না হলে রাষ্ট্রদূত-টুত হয়ে যেতেন। বারবাডোজে জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা। পরে অবশ্য ত্রিনিদাদ চলে যান, জীবনের শেষ সময়টা কাটে জ্যামাইকায়, সেখানে পার্লামেন্টের সিনেটরও হন। বারবাডোজের হয়েও ফ্রাঙ্ক ওরেল তাই শুধু বারবাডোজের থাকেননি, হয়ে গেছেন পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজের। রিচি বেনো বলতেন, শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেন, ফ্রাঙ্ক ওরেল ছিলেন পুরো বিশ্বের। ১৯৬০-৬১-এ অস্ট্রেলিয়া সফরে ফ্রাঙ্ক ওরেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবার এমনই হৃদয় হরণ করেছিল যে, তাঁদের বিদায় দিতে রাস্তার দুপাশে মানুষের ঢল নেমেছিল। এর আগে সিরিজ চলাকালেই তাঁর নামে ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি তৈরি হয়ে যায়। ঠিক হয়, এখন থেকে এটিই হবে অস্ট্রেলিয়া–ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজজয়ী দলের পুরস্কার। সিরিজে খেলছেন, এমন একজনের নামে সেই সিরিজেরই ট্রফি—ভাবা যায়! চিন্তাটা এসেছিল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের মাথা থেকে। সে সময় যিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান। ফ্রাঙ্ক ওরেলের মহিমা বোঝাতে এই একটা ঘটনাই বোধ হয় যথেষ্ট।
ক্যারিবিয়ানের তিনটি দ্বীপরাষ্ট্রে কেটেছে জীবন, তারপরও ফ্রাঙ্ক ওরেলের ওপর বারবাডোজের বাড়তি একটা অধিকারবোধ তো আছেই। সেই অধিকারবোধ থেকেই ওরেলের সমাধি বারবাডোজে, ব্রিজটাউনের ঠিক মাঝখানে সবচেয়ে বড় মোড়টির নাম ফ্রাঙ্ক ওরেল রাউন্ড অ্যাবাউট। এরই একটু দূরে খুবই সাধারণ দেখতে একটি ক্লাবের মূল ফটকের নাম স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল গেট।
ক্লাবের নাম এম্পায়ার ক্লাব। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আর দশটা ক্লাব যেমন দেখতে হয়, তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু সেটি আলাদা হয়ে যাচ্ছে একটা কারণেই—এটি ফ্রাঙ্ক ওরেলের ক্লাব। ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় এক বিকেলে এই এম্পায়ার ক্লাবে গিয়ে অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ফ্রাঙ্ক ওরেলের ক্লাব জেনেই গিয়েছি। গিয়ে দেখি একেবারে সুনসান। সবচেয়ে যেটি আশ্চর্য করল, ক্লাবের সামনে ফুটবল মাঠ। দুদিকে গোলপোস্ট, সাত-আট বছরের দুই কিশোর ফুটবল নিয়ে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে দৌড়াচ্ছে। এক পাশের ছোট কংক্রিটের গ্যালারিতে এক প্রেমিক যুগল বসে। একটু দূরে ক্লাবঘরের গেটে তালা দেওয়া। সেটি ধরে ধাক্কাধাক্কি করেও কারও সাড়া মিলছে না। ট্যাক্সি ড্রাইভারই হাঁকডাক করে ডেকে আনলেন একজনকে। ক্লাবঘরের পেছনে তিনি ঘাসে পানি দিচ্ছিলেন।
বয়-বেয়ারার মতো চেহারা। কিন্তু কথা বলে জানা গেল, তিনিও এম্পায়ার ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড়। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি—তিনটিই খেলে এম্পায়ার ক্লাব। রবার্ট ক্লার্ক ১২ বছর হকি খেলেছেন। দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের ট্রফি নিয়ে এম্পায়ার ক্লাবের ফুটবল, ক্রিকেট আর হকি দলের ছবি। একটা দেয়ালে এ পর্যন্ত এম্পায়ার ক্লাবের সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া ১৪ জনের দলের ১৪টি ছবি। এর ১৩ জনই টেস্ট ক্রিকেটার। তাঁদের মধ্যে ফ্রাঙ্ক ওরেল তো থাকবেনই, আছেন এভার্টন উইকসও। তিন ডব্লুর দুজনই খেলেছেন এম্পায়ার ক্লাবে। ওয়ালকটের ক্লাবের নাম স্পার্টান।
ওরেলের অবশ্য এম্পায়ার ক্লাবে না খেলে উপায় ছিল না। ক্লাবের দেয়াল ঘেঁষে রাস্তার ওপারেই ছিল তাঁদের বাড়ি। ‘ছিল’ লিখছি, শুধু ওরেল জীবিত নেই বলে নয়। ওই বাড়িতে ওরেলদের কেউই তখন থাকেন না। ওরেলের স্ত্রী মারা গেছেন অনেক দিন, একমাত্র মেয়েও। মাঝখানে বেশ কয়েক বছরের ব্যবধান ছিল বলে তিনজনের শেষ ঠিকানা হয়েছে একই কবরে। মেয়ের ঘরের এক নাতি আছে বলে শুনেছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর খোঁজ পাইনি।
ফ্রাঙ্ক ওরেলের বাড়িটি অনেক বছর প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে পরিণত হয়েছিল মাদকসেবীদের আস্তানায়। ফ্রাঙ্ক ওরেল জানলে তাঁর জন্য এটি কতটা যন্ত্রণার হতো, শেষ পর্যন্ত এই বোধোদয় হওয়ায় বারবাডোজ সরকার আর পর্যটন বিভাগ মিলে বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করার কাজে হাত দিয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যাবে বলে শুনেছিলাম। বাড়িটাকে ফ্রাঙ্ক ওরেল জাদুঘরে রূপান্তরের কথাও। এরপর আরও তিনবার বারবাডোজে গিয়েছি, ‘থ্রি ডব্লুস’–এর সমাধিক্ষেত্রেও একবার। কিন্তু যাব–যাব করেও ফ্রাঙ্ক ওরেলের বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। সত্যিই সেটি জাদুঘরে রূপ নিয়েছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরও জানি না। লেখাটা শেষ করতে করতে একটা প্রতিজ্ঞামতোই করে ফেললাম, জীবনে আর যদি কখনো বারবাডোজে যাওয়ার সুযোগ হয়, এম্পায়ার ক্লাব আর ফ্রাঙ্ক ওরেলের বাড়িতে আরেকবার অবশ্যই ঘুরে আসব।
তা আজই হঠাৎ এমন ফ্রাঙ্ক ওরেলকে নিয়ে পড়লাম কেন? অকারণে তো অবশ্যই নয়। আজ পৃথিবী ছেড়ে ফ্রাঙ্ক ওরেলের অকালে চলে যাওয়ার দিন।