তখন কে জানত, লর্ডস এত নাটক জমিয়ে রেখেছে

সিরাজকে আউট করে জয়ের উদ্‌যাপন ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দেরএএফপি

অফ স্পিনার শোয়েব বশিরের ঘূর্ণমান বলটা মোহাম্মদ সিরাজের ব্যাটে লেগে গড়িয়ে গেল স্টাম্পের দিকে। লেগ স্টাম্পে মৃদু ঠোকর দিয়ে ফেলে দিল বেল। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা জয়োল্লাসে ছুটতে শুরু করলেন সারা মাঠে। তাতে যোগ দেওয়ার আগে হতাশায় একটু নুয়ে পড়া স্তম্ভিত মোহাম্মদ সিরাজকে সান্ত্বনা দিয়ে যাওয়াটাকে কর্তব্য বলে মনে করলেন জেমি স্মিথ ও জো রুট। যা দেখে ২০০৫ অ্যাশেজে এজবাস্টন টেস্টের শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে থাকতেই পারে কারও। অস্ট্রেলিয়া ২ রানে হেরে যাওয়ার পর উবু হয়ে বসে থাকা ব্রেট লিকে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের সান্ত্বনা দেওয়ার সেই দৃশ্য।

আরও পড়ুন

লর্ডসের পড়ন্ত বিকেলে রবীন্দ্র জাদেজাকে দেখে বেন স্টোকসেরও কি মনে পড়ছিল আরেকটি অ্যাশেজ টেস্টের কথা! ২০১৯ সালের সেই হেডিংলি টেস্ট। শেষ ব্যাটসম্যান জ্যাক লিচ যখন নামছেন, ৪ উইকেটে ২৪৫ থেকে দেখতে না দেখতেই ৯ উইকেটে ২৮৬ হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডের জিততে তখনো দরকার আরও ৭৩ রান। সেটি করে ফেলার পর দুহাত ছড়িয়ে বেন স্টোকসের সেই রণহুংকার লিডসের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ক্রিকেট–বিশ্বেই। একটু যদি মনে করিয়ে দিই, শেষ উইকেট জুটিতে লিচের অবদান ছিল ১ রান এবং সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ১৭৯ রানের জবাবে ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে গিয়েছিল মাত্র ৬৭ রানে!

বিফলে গেল জাদেজার পাল্টা লড়াই
এএফপি

এখানে টেস্ট ইতিহাসে মাত্র নবমবারের মতো একই স্কোরে শেষ হয়েছে দুই দলের প্রথম ইনিংস। শেষ ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ সিরাজ যখন নামছেন, জয়ের লক্ষ্য ১৯৩ থেকে ভারত তখনো ৪৬ রান দূরে। ৯ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর চা-বিরতি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। উইকেটের ঘরে তখনো ‘৯’-ই, ভারতের সঙ্গে জয়ের দূরত্ব নেমে এসেছে ৩০ রানে। জাদেজা অপরাজিত ৫৬ রানে, ২০ বল খেলে ফেলা সিরাজের রান ২। সুনীল গাভাস্কার বলে ফেলছেন, এই টেস্টে ভারতই জিতবে এবং ২০০২ সালে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়ের পর লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গাঙ্গুলী যা করেছিলেন, এবারও ভারতের কেউ জার্সি খুলে মাথার ওপর তা বনবন করে ঘোরাবেন।

আরও পড়ুন

চা–বিরতির পর ২৯তম বলে সিরাজের ওই দুর্ভাগা আউটে অপূর্ণই থেকে গেছে গাভাস্কারের সেই আশা। ২০০৫ এজবাস্টনে ব্যবধান ছিল ২ রান, এখানে ‘২’-এর পাশে আরেকটি ২ বসেছে। ভারত হেরেছে ২২ রানে।

জাদেজার কারণেই তো অমন রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তিতে লর্ডসে আবারও টেস্ট ক্রিকেটের জয়গান। সামান্য, খুব সামান্য বিরতি দিয়েই বলতে হচ্ছে যশপ্রীত বুমরা ও মোহাম্মদ সিরাজের নাম।

শুধু শেষ উইকেট জুটির নির্ধারক হয়ে ওঠাই ২০১৯ হেডিংলি টেনে এনে জাদেজা-স্টোকসকে মিলিয়ে দেওয়ার একমাত্র কারণ নয়। শেষ দিনে এই টেস্টটা আরও বেশি করে হয়ে উঠেছে এই দুই অলরাউন্ডারের লড়াই। অবিশ্বাস্য এক প্রতিরোধের গল্প লিখতে থাকা জাদেজা প্রথম ইনিংসে করেছেন ৭২ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৬১ রানে। ব্যাটিংয়ে স্টোকসের দুই ইনিংস ৪৪ ও ৩৩। ভারতের প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট নিয়েছিলেন স্টোকস, দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট। অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট জিতে সিরিজে ২-১-এ এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ তো আছেই, যাতে বাড়তি রং ছড়িয়েছে ম্যাচসেরার ট্রফিটাও হাতে ওঠায়।

জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা ইংল্যান্ড দল
এএফপি

স্টোকস বনাম জাদেজা লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত তাই স্টোকসই জয়ী। কিন্তু জাদেজাকেই–বা ‘পরাজিত’ বলবেন কীভাবে! দল হয়তো হেরেছে, কিন্তু তিনি তো অপরাজিত। ১৮১ বলে অপরাজিত ৬১–এর মহিমা তো অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও বেশি।

আরও পড়ুন

জাদেজার কারণেই তো অমন রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তিতে লর্ডসে আবারও টেস্ট ক্রিকেটের জয়গান। সামান্য, খুব সামান্য বিরতি দিয়েই বলতে হচ্ছে যশপ্রীত বুমরা ও মোহাম্মদ সিরাজের নাম। রান করেছেন মাত্র ৫ ও ৪। কিন্তু ১০ নম্বর বুমরা খেলেছেন ৫৪ বল, ১১ নম্বর সিরাজ ৩০। নবম উইকেটে জাদেজার সঙ্গে ১৩২ বলে বুমরার ৩৫ রানের পার্টনারশিপ, ৮০ বলে সিরাজের ২৩ রানের। আগের দিনের ৪ উইকেটে ৫৮ রান নিয়ে খেলতে নামা ভারত যখন জফরা আর্চার আর বেন স্টোকসের তোপে লাঞ্চের সময়ই ৮ উইকেটে ১১২, তখন কে ভেবেছিল, এই ম্যাচ আরও ঘণ্টা আড়াই এমন অনিশ্চয়তার দোলায় দুলবে! আরেকটু যদি পিছিয়ে যান, কে এল রাহুলকে আউট করে স্টোকস ভারতকে ৬ উইকেটে ৮১ বানিয়ে ফেলার পরই তো মনে হয়েছিল এই ম্যাচে ইংল্যান্ড হেসেখেলে জিতবে। এর আগেই যে ডেঞ্জারম্যান ঋষভ পন্তকে দারুণ এক বলে বোল্ড করে দিয়েছেন আর্চার।

তখন কেই–বা ভেবেছিলেন, এই টেস্ট এমন নাটক জমিয়ে রেখেছে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ইংল্যান্ড: ৩৮৭ ও ১৯২

ভারত: ৩৮৭ ও ৭৪.৫ ওভারে ১৭০ (জাদেজা ৬১*, রাহুল ৩৯; স্টোকস ৩/৪৮, আর্চার ৩/৫৫, কার্স ২/৩০)।

ফল: ইংল্যান্ড ২২ রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)

সিরিজ: ৫–ম্যাচ সিরিজে ইংল্যান্ড ২–১–এ এগিয়ে।