‘ভালোবাসার ক্রিকেট’ যুক্তি মানে না, তাই হেরে যায় বাংলাদেশ
একটা দলের সিদ্ধান্তগুলোয় যখন যুক্তির চেয়ে আবেগের ঘনঘটা বেশি হয়ে যায়, ক্রিকেটীয় চিন্তা তখন আর কাজ করে না।
যা কিছু স্বীকার করে গেলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, তাই আবার অস্বীকারও করলেন। একবার বললেন, ব্যাটিং উইকেটেও বাজে ব্যাটিং করেছেন বলে গতকালের শেষ ওয়ানডেতে হেরেছেন। আবার বললেন, ব্যাটসম্যানরা যে তুলে তুলে মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন, সেভাবেই খেলতে তাঁরা পছন্দ করেন। কারও পছন্দে, ভালোবাসার ক্রিকেটে বাধা দেওয়া ঠিক হবে না।
তাহলে কারও ‘ভালোবাসা’কে তিনি বাজে ব্যাটিং কেন বললেন! তার চেয়ে ভালোবাসাকেই অনুমোদন করে দিন। বাংলাদেশ খেলুক আকাশে-বাতাসে। পরিস্থিতির দাবির চেয়ে যদি ব্যাটসম্যানদের পছন্দটাই বেশি বিবেচনায় থাকে, তখন আর কিছু বলার নেই। ভালোবাসার জয় হোক। কুশল মেন্ডিসের ব্যাটিং দেখেও কিছু শেখার দরকার নেই।
তারুণ্যের পতাকা উড়িয়ে দলে আসা তাওহিদ হৃদয়ের ব্যাট আক্রমণের ভাষা ভুলে যাচ্ছে। তিনি এখন ফিফটি করেন ৭৫ বলে, ৫১ করেন ৬৫.৩৮ স্ট্রাইক রেটে। এভাবে খেলতেই ভালোবাসেন কি না, কে জানে! আগের ম্যাচ বাংলাদেশ জিতলেও তাঁর ৬৯ বলে ৫১ রানের ইনিংসে ছিল জড়তা। নিন্দুকেরা বলেন, হৃদয়ের চোখে এলপিএল ভাসে। শ্রীলঙ্কায় বড় ইনিংস খেললে দৃষ্টি কাড়তে পারবেন, লঙ্কা লিগের বাজারে কদর বাড়বে। বিশ্বাস হয় না দেশের প্রতিনিধিত্ব করা কেউ এভাবে ভাবতে পারেন।
এর চেয়ে সময়ের দাবি মেনে মেরেকেটে খেলা ইনিংসে জয়ের ক্ষুধা ফুটিয়ে তোলা ব্যাটিং অনেক চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন হতে পারে একজন ব্যাটসম্যানের জন্য। হৃদয় তাহলে কেন স্বার্থপর হবেন! নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা।
আবার আইপিএলপ্রেমী মোস্তাফিজুর রহমানের দিকে তাকালে মনে হয়, ক্রিকেটে স্বার্থপরতা হয়তো পেশাদারত্বেরই একটি অংশ। সেটি তাই অধিনায়ক, কোচ, নির্বাচকদের অলিখিত অনুমোদনও পেয়ে যায়। শ্রীলঙ্কায় ওয়ানডে সিরিজে মোস্তাফিজকে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো লেগেছে। চাবিটা যতক্ষণ ঘুরবে, পুতুল ততক্ষণ দৌড়াবে। তারপর থেমে যাবে। বোলিংয়ের রানআপ, ফিল্ডিং—মোস্তাফিজ যেন থেমে থেমে যান।
পুতুল নিয়ে মাটিতে লেপটে বসা শিশুরা এটা দেখে আনন্দ পেতে পারে। ক্রিকেট মাঠের দর্শকেরা পান না। তাঁরা ভাবেন, মোস্তাফিজের হয়তো জাতীয় দলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। জাতীয় দলের জার্সি তাঁর কাছে একটা আইডেনটিটি মাত্র, যেটা ব্যবহার করে তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দুয়ারে জোরে জোরে কড়া নাড়তে পারেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোস্তাফিজের কাছে এখন ‘সেফটি ফার্স্ট’।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ রকম আরও কিছু বিস্ময় আছে, যেগুলো ঠিক জাতীয় স্বার্থ দেখে বলে মনে হয় না। স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদের কথাই ধরুন। পাকিস্তানের এই সাবেক লেগি বিসিবির একজন ‘দিনমজুর’ কোচ। তাঁর সঙ্গে চুক্তি তিনি নির্দিষ্ট কিছুদিন দলের সঙ্গে থাকবেন। টাকাও পান দিন ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটা অদ্ভূত দর্শন। আমরা মনে করি, আমাদের ক্রিকেটাররা বিদেশি লিগে খেললে আমাদের নাক উঁচু হয়। কাজেই আমরা সে রকম ক্রিকেটারদের কিছু ছাড় দিয়ে আরামে খেলাই। আইপিএলের একজন ক্রিকেটার বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমের শোভা বাড়াচ্ছেন, এটাই তো গর্বের ব্যাপার। তাঁর আবার খেলা কী! দলে আছে, এই যথেষ্ট। মোস্তাফিজকে চতুর্থ পেসার হিসেবে দেখার প্রস্তাবে কোচ ফিল সিমন্স তাই আঁতকে ওঠেন। ফর্ম ফিরে পেতে ‘এ’ দলে খেলার প্রস্তাবে তাঁর মর্যাদাহানির শঙ্কা দেখেন কেউ।
শ্রীলঙ্কা সিরিজে মোস্তাফিজের বলার মতো একমাত্র অর্জন দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জানিত লিয়ানাগের উইকেট। বাংলাদেশকে নিশ্চিত হার থেকে বাঁচিয়েছেন মোস্তাফিজ। তাঁর জন্য জোরে একটা হাততালি। একের পর এক ম্যাচে উদাসী ক্রিকেট খেললেও তিনি আমাদের আইপিএল-গর্ব। তাঁর গায়ে ফুলের টোকাটি যেন না পড়ে। তবু একটা প্রশ্ন—দলে শুধু এটুকু অবদান রাখাই কি তাঁর কাজ!
পাল্লেকেলেতে কাল রাতে সিরিজ হারের পর অধিনায়ক মিরাজ সে রকমই বোঝাতে চাইলেন। তিনি আরেকটি বাড়তি তথ্য দিয়েছেন, যেটা বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখা অনেকেরই অজানা ছিল। মোস্তাফিজ নাকি খুব ভালো ফিল্ডার। হয়তো চোট থেকে ফেরায় পুরোটা ঢেলে দিতে পারেননি। পুরোটা ঢেলে দিলে তিনি দুর্দান্ত।
মিরাজের কথা সত্যি হলে বলতে হয়, মোস্তাফিজের পুরো ঢেলে দেওয়া ক্রিকেট দেখতে আমরা অনেক দিন হলো অপেক্ষমাণের তালিকায়। আগে আইপিএল তাঁর পুরোটা দেখবে, তারপর দেখবে বাংলাদেশ, যদি দেখানোর মতো আর কিছু অবশিষ্ট থাকে তাঁর মধ্যে। এর আগপর্যন্ত জাতীয় দলে তাঁর ধূমকেতু ক্রিকেটই সই।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ রকম আরও কিছু বিস্ময় আছে, যেগুলো ঠিক জাতীয় স্বার্থ দেখে বলে মনে হয় না। স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদের কথাই ধরুন। পাকিস্তানের এই সাবেক লেগি বিসিবির একজন ‘দিনমজুর’ কোচ। তাঁর সঙ্গে চুক্তি তিনি নির্দিষ্ট কিছুদিন দলের সঙ্গে থাকবেন। টাকাও পান দিন ভিত্তিতে।
সেই নির্দিষ্ট দিনগুলো কখন হবে, তা মুশতাক না বিসিবি ঠিক করে, সেটা কৌতূহল–জাগানিয়া ব্যাপার। কারণ, শ্রীলঙ্কা সফরে গল টেস্টের পর দল ছেড়ে যাওয়া স্পিন কোচ আবার ফিরেছেন ক্যান্ডির শেষ ওয়ানডের আগে। তার মানে কাল হওয়া শেষ ওয়ানডে এবং তিনটি টি-টোয়েন্টিসহ দিনমজুর কোচ আপাতত ৮-১০ দিনের অতিথি। কেন, কে জানে! বাংলাদেশ দল এ রকম ভাসমান কোচদের ট্রানজিট হয়ে উঠছে না তো!
দলকে বিক্ষিপ্ত সময় দিয়ে স্পিনারদের উন্নতিতে আসলে কতটুকু কাজে লাগছেন তিনি? এমন যদি হতো লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন শেষ ওয়ানডেটা খেলতেন, মুশতাকের দু-একটি টোটকা কাজে লেগে যেত তাঁর। তাহলেও তাঁর এই এক ম্যাচের জন্য আসাটা সার্থক হতো। কিন্তু কলম্বোয় দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৫ উইকেট পেয়ে বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম শেষ ওয়ানডেতে স্বয়ংক্রিয় পছন্দ হয়ে গেছেন। কাজেই রিশাদকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে টি-টোয়েন্টির জন্য।
অনুশীলনে অন্য ‘সাবসিডিয়ারি’ স্পিনারদের বোলিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা স্পিন কোচ মুশতাক এখন হয়তো একটু কাজ পাবেন, রিশাদকে টোটকা দেবেন। কিন্তু দুই দিনের অতিথির মতো এসে ঝাড়ফুঁক দেওয়া কোচেরা আসলে একটা দলকে কতটা আপন করে নিতে পারেন?
একটা দলের সিদ্ধান্তগুলোয় যখন যুক্তির চেয়ে আবেগের ঘনঘটা বেশি হয়ে যায়, ক্রিকেটীয় চিন্তা তখন আর কাজ করে না। পরিস্থিতি ভিন্ন কিছু দাবি করলেও তখন আর ব্যাটসম্যানদের পছন্দের শটের বাইরে এসে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে খেলতে বলা যায় না, টিম কম্বিনেশনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে কাকে বাদ দিলে কে কী ভাববে তা, সুসম্পর্কের খাতিরে মন মতো রুটিনে দলের সঙ্গী হন স্পিন কোচের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ।
এভাবেই যদি চলবে, তাহলে আর আফসোস কেন! সবাই সবাইকে ভালোবাসুক। ভালোবাসার ক্রিকেট খেলে উজাড় করে দিক সবকিছু। নিজেদেরও, বাংলাদেশ দলকেও।
